বরুণ দাস
দেশজুড়ে কর্মহীনতা মহামারীর আকার ধারণ করেছে। অতিমারীর সঙ্গে তুলনা করলেও বোধহয় কম বলা হবে। ঘরে ঘরে কর্মহীন বা বেকার মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এমন কোনও ঘর নেই যেখানে একজন না-একজন বেকার খুঁজে পাওয়া যাবে না। এদেশের মতো মানব সম্পদের এমন ব্যাপক অপচয় অন্য কোনও দেশে নেই একথা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ প্রায় দেড়শো কোটির দেশের এই করুণ চিত্র যে ভয়াবহ ও বিস্ফোরক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তা বুঝতে অপারগ দেশের রাজনৈতিক অভিভাবকেরা।
অনেকে হয়তো-বা প্রশ্ন করবেন, সংবাদমাধ্যমের লোকেরাই সব বুঝে ফেলেছেন, বাকিরা বিশেষ করে শাসকদলের (কেন্দ্র এবং রাজ্য) কর্তাব্যক্তিরা বুঝতে অপারগ- এ আবার কেমন কথা? বিষয়টা ঠিক তা নয়। আসলে যাদের এ নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা- তারাই সমস্যাটা থেকে কেমন যেন পাশ কাটিয়ে চলেন। অথচ নির্বাচনের প্রাক্কালে কেন্দ্রীয় শাসকদলের সুপ্রিমো দু’কোটি বেকারের চাকরির প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু জয়ী হয়ে ১১ বছর কাটিয়ে দিলেও সেই নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি পালন করার কথা উচ্চারণ করেন না।
কেন্দ্রে একই দলের সরকার তিন-তিনবার (২০১৪, ২০১৯ এবং ২০২৪) জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আছেন। অনেক প্রতিশ্রুতির বন্যা (সুনামি বলাটাই বোধহয় সঠিক) বইয়ে দিয়েছেন তারা। ‘সাইনিং ইন্ডিয়া’র পর ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ থেকে ‘অচ্ছে দিন’-এর রঙিন স্বপ্ন দেখিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের তথা দিল্লির তখত-তাউস দখল করেছেন। ‘উন্নয়নের সূচক’ হিসেবে জিডিপি-র ক্রমর্ধমান উর্ধগতির কথা বলে চলেছেন। এমন কি, আগামী কতো সালে জিডিপি বৃদ্ধির পরিমাণ কতো দাঁড়াবে- তারও আগাম ইঙ্গিত দিতে তাঁরা পিছপা নন।
অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নয়নশীল ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র হবে- এমন অলীক স্বপ্নের কথাও বলে চলেছেন। যদিও বাস্তবের দিকে তাকালে জিডিপি-র ‘ক্রমর্ধমান উর্ধগতি’র বদলে ক্রমহ্রাসমানতার চিত্রই আমাদের চোখে আসে। দেশ-বিদেশের প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবিদেরাও তেমনটাই মনে করেন। আসলে রাজনীতিবিদেরা যা অনায়াসেই (আসলে ভেবেচিন্তে বলার অভ্যেস তো তাঁদের নেই; কোনওকালে ছিলও না) বলে দিতে পারেন বা বলতে অভ্যস্থ- তা তো একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি সচরাচর উচ্চারণ করতে পারেন না। যেকথা দিয়ে এই উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধের শুরু হয়েছিল-এবার সেকথায় আসা যাক। মতবাদ নির্বিশেষে দেশের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কথা শাসকদল যাই বলুন না কেন, দেশের বেকারত্বই আজ প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনী স্মরণ করালে তাঁরা বলে থাকেন, চাকরিই তো বড়োকথা নয়, আসলে দেখতে হবে কর্মসংস্থান হচ্ছে কিনা। ‘কর্মসংস্থান’-এর পক্ষে তাঁরা নানারকম সরকারি-বেসরকারি তথ্য-পরিসংখ্যান পরিবেশন করেন। যার সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল বা সম্বন্ধই নেই। মানুষকে বোকা বানানোর সচেতন প্ৰয়াস !
বলা বাহুল্য, কোভিড-১৯ এর পর অন্যান্য উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশের মতো এদেশের অর্থনীতিও ভীষণভাবে ধাক্কা খেয়েছে। অনেকেরই চাকরি চলে গেছে, কারও-বা চাকরি থাকলেও বেতন অনেকটাই কমে গেছে, এবং সার্বিকভাবে গোটা দেশ জুড়েই কর্মসংস্থানের প্রভূত সংকোচন ঘটেছে। এমন কি, ছোটোখাটো ব্যবসাও বন্ধ হয়ে গেছে। বড়ো ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ব্যয়-সংকোচন-নীতি নেওয়ার ফলে যারা ওইসব ব্যবসার সঙ্গে কর্মসূত্রে যুক্ত ছিলেন, তাঁরাও হয় কর্মহীন নয়তো কমবেতনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এরফলে একদিকে নতুন চাকরির সম্ভাবনা যেমন শূন্যে এসে পৌঁছেছে, অন্যদিকে যারা চাকরিতে ছিলেন, কোভিড-১৯ এর কারণে তাঁদের অনেকের চাকরি চলে গেছে এবং যাদের আছে, ওই একই কারণে তাদের আর্থিক পরিস্থিতিও সঙ্গিন হয়ে উঠেছে। বহু বিজ্ঞাপিত সাইনিং ইন্ডিয়া, ডিজিটাল ইন্ডিয়া কিংবা অচ্ছে দিন-এর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি-তা কেবল তামাম দেশবাসীর কাছে ছবি হয়েই আছে (রবিঠাকুরের বহুশ্রুত গানের কথায় আমরা বলতে পারি-‘তুমি কী কেবলই ছবি?’)! একে অস্বীকার করি কিভাবে?
রাজ্য সরকারও যে এদিকটায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছেন তাও বলা যাবেনা। অন্ততঃ বাস্তব পরিস্থিতি তা বলে না। রাজ্যের ক্রমবর্ধমান বেকার যুবক-যুবতিদের চাকরি বা কর্মসংস্থানের ওপর বাড়তি জোর দিয়েছেন এমন প্রমাণ তাঁরা রাখতে অপারগ। অথচ তারাও তিন-তিনবার জয়ী হয়ে রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। উল্কার গতিতে নাকি উন্নয়ন-এর রথ ছুটে চলেছে! কিন্তু বেকারত্বের সমস্যা ঘুচলো কোথায়? রাজ্যের প্রধান সমস্যাটিকে তাঁরাও পাশ কাটিয়ে চলতে চান-এমন অভিযোগ উঠেছে।
যদিও একথা তাঁরাও স্বীকার করেন না। বরং তাঁরাও নানাবিধ সরকারি-বেসরকারি তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে প্রমাণ করতে ব্যস্ত যে, তাঁদের আমলে কতো সংখ্যক বেকারের চাকরি হয়েছে। কতোটা পরিমাণে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। একথা ঠিক যে, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানে এ রাজ্যে বেশ আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনে বিজনেস সামিট বা মিট হয়েছে বেশ কয়েকবার। আয়োজকদের কথায়, ‘সাফল্যের সঙ্গে।’ দেশের পাশাপাশি বিদেশের অনেক উদ্যোগপতিরাও সেই বিজনেস সামিট বা মিট-এ উপস্থিত হয়ে নানাবিধ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কিন্তু দিনের শেষে দেখা গেছে, দেশি-বিদেশি প্রতিশ্রুতিই সার- ওই প্রতিশ্রুতি (বা মৌ-MOU)-র কোনও বাস্তবায়ন ঘটেনি। সামিট শেষে যে যার নিজের রাজ্যে বা দেশে ফিরে গেছেন, প্রতিশ্রুতি ফাইল-বন্দি হয়ে পড়ে থেকেছে। এবং পরের বার রাজ্যের বিজনেস সামিট বা মিট-এ নতুন উদ্যোগপতিরাও উপস্থিত হয়ে নানাবিধ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তারও পরিণতি একই হয়েছে! এটা এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা বটে। এমন কি, দেশের এক নামী ক্রিকেটারও বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে নতুন উদ্যোগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এখনও তা আদৌ বাস্তবের মুখে দেখেনি। এবং কবে দেখবে তাও কিন্তু আমাদের অনেকেরই হয়তো অজানা। এই কঠিন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সাধারণ নিম্মবিত্ত ঘরের মানুষ বাধ্য হচ্ছেন অন্যভাবে রোজগারের বিকল্প পথের সন্ধান করতে। কী সেই বিকল্প পথ? হকারিকেই বেছে নিচ্ছেন। পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য এছাড়া আর অন্য উপায়ই বা কী? হয়তো ধার-দেনা করে সামান্য পুঁজি সংগ্রহ করে কলকাতার রাজপথের পাশেই বসে পড়ছেন বিক্রির নানাবিধ পশরা নিয়ে। কোথাও-বা মহানগরের ব্যস্ত পথের দখল নিয়ে।
ফুটপাত তো অনেক আগেই হকারদের দখলে চলে গেছে। কলকাতার ব্যস্ত রাস্তার দু’দিক তো বটেই, এখন মূল রাস্তার ওপরও হকারদের ব্যবসা করতে দেখা যায়। একে তো রাস্তার দু’পাশের প্রতিষ্ঠিত বড়ো দোকানের মালিকেরা ফুটপাতের অনেকটা অংশই দখল করে তাঁদের মালপত্তর রাখেন। দোকানের মধ্যে প্রশস্ত জায়গা থাকতেও। অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে চলতে হয় নিত্য পথযাত্রীদের। একটু অসতর্ক হলেই নিত্যযাত্রীদের মাথা কিংবা চোখে লেগে বিপদ ঘটতে পারে। কিন্তু সেকথা বুঝবেন কে? কারণ অভিযোগ শোনার কেউ নেই।
অন্যদিকে কলকাতা শহর ও শহরতলির সমস্ত ব্যস্ত রাস্তাই আজ নতুন নতুন হকারদের জবর-দখলে চলে যাওয়ায় প্রতিটি ব্যস্ত রাস্তাই এখন হকারদের ব্যবসাকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আর এভাবেই কলকাতার রাজপথ এবং সাধারণ গলিপথও হারিয়েছে তাঁর স্বাভাবিক ও সুস্থ চেহারা ও চরিত্র। এই চরিত্র বদলের চালচিত্র কলকাতা মহানগর জুড়ে আমাদের সবারই নজরে পড়বে। আপনি বুঝতেই পারবেন না-কোনটা পথ আর কোনটা হকারদের ব্যবসা কেন্দ্র বা বাজার। সবটাই যেন স্থানীয় পৌরপ্রশাসনের এক নিয়ন্ত্রণহীন এলাকা।
ফুটপাতের পাশাপাশি হাওড়া এবং কলকাতা মহানগর সহ শহরতলির সবগুলি আন্ডারপাস আজ বাজারে পর্যবসিত হয়েছে। কাঁচামাল থেকে জামা-কাপড়-কী নেই সেখানে? সুস্থভাবে হেঁটে যাওয়ার উপায় নেই। ক্রমশঃ সেই অস্থায়ী বাজারের পরিধি বেড়েই চলেছে। একইসঙ্গে অতিদ্রুত সঙ্কুচিত হচ্ছে পথচলার প্রয়োজনীয় পরিসরটুকু। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, এরপর তো কলকাতায় শুধু পথচলার জন্যেই আলাদা ফ্লাইওভার তৈরি করতে হবে! তা নাহলে কলকাতা শহর ও শহরতলির মানুষজন চলাফেরাই করতে পারবেন না।
যারা শিয়ালদা হয়ে নিয়মিত চলাফেরা করেন তাঁরা দেখেছেন এবং ভুক্তভোগীও যে, শিয়ালদা মেট্রোরেল স্টেশন চত্বর রাতারাতি হকারদের দখলে চলে গেছে। ওই রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করা যায় না। স্টেশন চত্বরের চারদিক ঘিরে মহিলা-পুরুষ হকারদের পশরার ডালিতে ভরে গেছে। জুতো-জামাকাপড় থেকে কাঁচা শাক-সবজি, ফলমূল সহ পকোড়া এবং স্থায়ী শামিয়ানা টাঙিয়ে বিরিয়ানির দোকান পর্যন্ত জাঁকিয়ে বসেছে। স্টেশনে যাওয়া-আসার ব্যস্ত পথে গায়ে ধাক্কা লাগে হকার ভাইবোনদের সঙ্গে। তারা বিরক্তি নিয়ে তাকান।
যেন গূঢ় কোনও অপরাধ করে ফেলেছেন নিত্যযাত্রীরা। অশালীন মন্তব্য করতেও অনেকে পিছপা নন। এখানে হকারদের কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই। যে যেখানে পারছেন, প্রতিদিন পশরা নিয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। হকারির পরিসর ক্রমশঃ বাড়ছে। কাউকেই ন্যূনতম পরোয়া করছেন না তাঁরা। অনেকেরই ভাবখানা এই যে, কলকাতা মহানগরের রাজপথ থেকে সাধারণ পথঘাট মানেই তাঁদের নিজস্ব সম্পত্তি। এখানে নিত্য পথযাত্রীদের চলাফেরা নয়, হকারি বা ব্যবসা-বাণিজ্য করার আইনি অধিকার যেন একমাত্র তাদেরই। ওই চত্বরে কলকাতা পুরসভা আবর্জনা পরিষ্কারও করে না। জঞ্জালে ভরা থাকে মেট্রো স্টেশনের চারদিক। বিশেষ করে পচনশীল কাঁচামাল ও ফলের বর্জ্য জিনিসে। এছাড়া রাতে পথে থাকা মানুষের মূত্র-বিষ্ঠার চাপ তো আছেই। বর্ষা-বাদলের দিনে এক ভয়ংকর অসহনীয় নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যা চলাফেরার পক্ষে তো বটেই, জন-স্বাস্থ্যের পক্ষেও চূড়ান্ত ক্ষতিকর। কিন্তু রেল (মেট্রো কিংবা সাধারণ রেল) কিংবা পুরসভা- কারও কোনও নজর নেই। কী এক অদ্ভুত আর নৈরাজ্য্য-ভরা পরিস্থিতির মধ্যে চলেছি আমরা?
সচল কলকাতাকে অচল করে দেওয়ার যাবতীয় কর্মকান্ডই চলছে জোর কদমে। স্থানীয় প্রশাসন সব দেখেশুনেও একেবারেই উদাসীন। এক বৌদ্ধিক নীরবতায় নির্বিকার। অবাক লাগে এই ভেবে যে, হকার ভাইদের সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার কেউ নেই! কিংবা এ বিষয়ে আইন থাকলেও তা বাস্তবায়নে কেউ এগিয়ে আসেন না! স্থানীয় পুরপিতা, বিধায়ক কিংবা সাংসদ কী এই সীমাহীন অরাজকতা দেখেন না? পুলিশ- প্রশাসনই-বা কী করছেন? কলকাতাকে স্থবির করে দেওয়াই কী এদের একমাত্র লক্ষ্য?
হকার সংগঠনের কর্মকর্তাদেরও কী কোনও দায়িত্ব নেই এদিকে নজর দেওয়ার? যাতে হকারদের সুষ্ঠুভাবে ব্যবসার পাশাপাশি নিত্যযাত্রীরাও সুস্থভাবে চলাফেরা করতে পারেন? রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র তথা কলকাতার ব্যস্ত পথঘাটও সচল থাকতে পারে?