চিনের হোয়াং হো নদীটিকে বলা হতো ‘দুঃখের নদী’। সেই নদীকে বাঁধ দিয়ে বেঁধে ফেলার পর এই পরিচিতি ঘুচে গেছে। কিন্তু দামোদরের গা থেকে ‘বাংলার দুঃখ’ তকমাটি ঘোচানো গেল না। বহুমুখী নদী পরিকল্পনায় দামোদরের বেঁধে ফেলার সময় কেন্দ্রের আশ্বাস ছিল ফি-বছর আর ভাসবে না বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে নেমে এসে পুরুলিয়া ও বাঁকুড়াকে ছুঁয়ে দামোদর বয়ে গিয়েছে বর্ধমান ও হুগলির বিশাল জনপদের উপর দিয়ে। হুগলি নদীতে মিশে যাওয়ার আগে স্পর্শ করেছে হাওড়া জেলাকেও। বর্ষা মানেই এই জেলার বাসিন্দাদের কাছে দামোদরের রূপ ভয়াল ও ভয়ঙ্কর। শাখানদী দিয়ে বষর্খায় দামোদরের জল ভাসিয়ে দেয় ঘাটাল সহ মেদিনীপুরের একটি বড় অংশকেও। একাধিক জলাধার ও বিস্তৃত বাঁধ দিয়েও যে দামোদরের বিধ্বংসী ক্ষমতাকে রোখা যায়নি তার প্রমাণ মিলেছে প্রায় প্রতি বর্ষায়। ‘বাংলার দুঃখ’ তকমা ঘোচাতে বহুমুখী নদী পরিকল্পনার নামে দামোদরকে ঘিরে যেসব জলাধার, ব্যারেজ ও বাঁধ নির্মিত হয়, সেগুলিই এখন বাংলার বড় দুঃখের কারণ।
দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন সংক্ষেপে ডিভিসি স্বাধীন ভারতের প্রথম বহুমুখী নদী উপত্যকা প্রকল্প। ১৯৪৮ সালের ৭ জুলাই ভারতীয় গণপরিষদের একটি আইন মোতাবেক এই কর্পোরেশনটি তৈরি হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি ভ্যালি অথরিটির আদলে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন গড়ে ওঠে। প্রথম দিকে ডিভিসি’র মূল উদ্দেশ্য ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ, পরিবেশ সংরক্ষণ, বনসৃজন এবং এই প্রকল্পের আওতাধীন অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের আর্থ-সামাজিক উন্নতি। বিগত কয়েক দশক ধরে অবশ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনই ডিভিসি’তে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়ে আসছে। নিম্ন দামোদর উপত্যকায় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান ও হুগলি জেলার সম্পূর্ণ এবং পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও হাওড়া জেলার কিছু অংশ ডিভিসি প্রকল্পের আওতাধীন। ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গ মিলে এই সমগ্র অঞ্চলের আয়তন ২৪,২৩৫ বর্গকিলোমিটার। সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ ছিল এই প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু সেই লক্ষ্য থেকে অনেকটাই সরে এসেছে ডিভিসি।
এই প্রকল্পের অধীনে ১৯৫৩ সালে তিলাইয়াতে দামোদরের উপনদী বরাকর নদীর উপর একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ১৯৫৫ সালে কোনারে দামোদরের অপর উপনদী কোনার নদীর উপর দ্বিতীয় বাঁধটি নির্মিত হয়। ১৯৫৭ সালে মাইথনে বরাকর নদীর উপর এবং ১৯৫৯ সালে পাঞ্চেতে দামোদর নদীর উপর আরও দু’টি বাঁধ নির্মিত হয়। এই চারটি বাঁধই ডিভিসি’র নিয়ন্ত্রণাধীন প্রধান বাঁধ। ১৯৫৫ সালে দুর্গাপুরে দামোদর নদের দু’ধারে অবস্থিত অন্যান্য খাল ও নদীগুলিতে জল সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ১৯৭৮ সালে বিহার সরকার (বর্তমানে ঝাড়খণ্ড) ডিভিসি’র নিয়ন্ত্রণের বাইরে তেনুঘাটে একটি বাঁধ নির্মাণ করে। এই বাঁধগুলি নির্মাণের পর প্রায় ৭০-৭৫ বছর কেটে গেছে। এই দীর্ঘ বছর ধরে সব বাঁধগুলির জলাধারের নাব্যতা কমেছে পলির আস্তরণে। একইভআবে নদীগুলিরও নাব্যতা কমেছে। কিন্তু এই জলাধারগুলি ও নদীর নাব্যতা বজায় রাখার জন্য কোনও নিয়মিত ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা নেই।
গত কয়েক দশক ধরে বর্ষায় ঝাড়খণ্ডের মালভূমি অঞ্চলে দু-একদিন ভারী বৃষ্টি হলেই দুই কূল ভাসছে দামোদরের। দিন দিন বাড়ছে বন্যায় জলের পরিমাণ। দামোদর ঘিরে যখন বহুমুখী নদী পরিকল্পনার ভাবনা হয়, সরব হন অনেকে। উপরে নদীকে বাঁধলে নিম্নধারায় যে পলি পড়ে অচিরেই নদীবক্ষ বুজে যাবে সেই আশঙ্কার কথা শোনান নদী-বিশেষজ্ঞরা। নদীবক্ষ বুজে যাওয়া মানে বর্ষায় নদীর জলধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়া যার পরিণতি অল্প বর্ষাতেই নদীর দু’কূল ভাসতে থাকা। ইতিমধ্যে পলি জমে জালধারণের ক্ষমতা কমে গিয়েছে মাইথন, পাঞ্চেতেরও।
সমস্যার কিছুটা সুরাহা হতে পারে একমাত্র জলাধারগুলির নিয়মিত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে। কেন্দ্র যে এই কাজে কেন অবহেলা দেখাচ্ছে, তা বোধগম্য নয়।