• facebook
  • twitter
Sunday, 8 September, 2024

যুদ্ধের সেরা জীবনযুদ্ধ চলে অবিরত,অবারিত, আজীবন !

স্বপনকুমার মণ্ডল যুদ্ধভীতি যোদ্ধারও থাকে, বীরের মনেও উঁকি দেয় । সেখানে যুদ্ধকে ধর্মের বর্ম পরিয়ে ধর্মযুদ্ধের কথা বলা হলেও তার ধ্বংসাত্মক হত্যালীলা কখনও মানুষকে প্রাণিত করেনি বা করে না । স্বাধীনতা-যুদ্ধের পরে জয়ীর আনন্দ-উল্লাসের মধ্যেও পরাজিতের গ্লানিবোধেও করুণার উদ্রেক করে, শোকতাপ,বিচ্ছেদবেদনার বিষণ্ণতাবোধ জেগে ওঠে । সেখানে যুদ্ধ মানেই হত্যালীলা, ধ্বংসের নিবিড় আয়োজন । প্রাণসংশয় থেকে

স্বপনকুমার মণ্ডল

যুদ্ধভীতি যোদ্ধারও থাকে, বীরের মনেও উঁকি দেয় । সেখানে যুদ্ধকে ধর্মের বর্ম পরিয়ে ধর্মযুদ্ধের কথা বলা হলেও তার ধ্বংসাত্মক হত্যালীলা কখনও মানুষকে প্রাণিত করেনি বা করে না । স্বাধীনতা-যুদ্ধের পরে জয়ীর আনন্দ-উল্লাসের মধ্যেও পরাজিতের গ্লানিবোধেও করুণার উদ্রেক করে, শোকতাপ,বিচ্ছেদবেদনার বিষণ্ণতাবোধ জেগে ওঠে । সেখানে যুদ্ধ মানেই হত্যালীলা, ধ্বংসের নিবিড় আয়োজন । প্রাণসংশয় থেকে অস্তিত্ব সংকট সবেতেই যুদ্ধের বিভীষিকা মনকে সচকিত করে তোলে । আবার যুদ্ধের ভয়ঙ্কর বিকট অশান্ত মূর্তির পাশেই তার আরও একটি প্রশান্ত মূর্তি আছে যা জীবনকে নতুন জীবনের হাতছানি দিয়ে প্রতিমায় পরিণত হয়। সেখানে যুদ্ধ প্রাণ কেড়ে নেয় না, বরং মৃতপ্রায় জীবনকে প্রাণিত করে অবিরত । শুধু তাই নয়, আহার, নিদ্রা,মৈথুনের পাশবিক জীবন থেকে মানবিক জীবনের উৎকর্ষে তার  অনস্বীকার্য ভূমিকা । আসলে মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে যুদ্ধের বহুমুখী ও বহুমাত্রিক বিস্তার আজীবন জুড়ে । তার নামই জীবনযুদ্ধ। সে যুদ্ধের সঙ্গে জীবনের অবিচ্ছেদ্য যোগ নিরন্তর প্রবহমান । তার মধ্যে মৃত্যুর ভয় নেই, আছে জয় করার দুর্বার দুর্জয় হাতছানি । সেই যুদ্ধকে মানুষ আপনার করে নিয়ে আপনাকেই ছাড়িয়ে ওঠে। জীবনের সিঁড়ির মতোই তার উত্তরণ প্রকৃতি । ক্লান্ত হলেও মানুষ স্বেচ্ছায় তাতে ভর দিয়ে এগিয়ে চলে,উপরে ওঠে। বিশ্বাসই জীবনযুদ্ধের চালিকাশক্তি । সে কারণে এই যুদ্ধ শুধু উত্তরণের পথে সামিল করে না,নতুন জীবনেরও হাতছানি দেয় । স্বাভাবিক ভাবেই, এই যুদ্ধ জয়ের আনন্দ জীবনকে নিরন্তর সচল রাখে, এগিয়ে দেয়, চরৈবেতির মন্ত্রে উজ্জীবিত করে অবিরত । এজন্য এই যুদ্ধ কাউকে হারিয়ে দেয় না, বরং জেতানোর জন্য ওৎ পেতে থাকে । আসলে মানুষের অপরাজেয় জীবনীশক্তিই তার জীবনযুদ্ধের বিশল্যকরণী । তার সঞ্জীবনীসুধায় মানুষের জীবনযুদ্ধ আজীবন জারি থাকে।

আধুনিক বিশ্বে মানুষের অধিকার চেতনার তীব্রতায় যুদ্ধের নৃশংসতায় যেমন মানবসভ্যতাই বিপন্ন হয়ে পড়েছে, জীবনযুদ্ধও তেমনই তীব্রতর সংকটের মুখোমুখি । চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যের অভাবে জীবন যত প্রতিযোগিতামুখর হয়ে ওঠে, তাতে তত প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেমে আসে, জীবনের লড়াই ততই তীব্র আকার ধারণ করে । আর প্রতিদ্বন্দ্বিতাই তো নামান্তরে যুদ্ধ হয়ে ওঠে । আধুনিক বিশ্বে ভোগের তীব্র হাতছানি ও চাহিদাই মানুষের মানবমুখিতাকে পাশবিকতার দিকে সক্রিয় করে তুলেছে । সেখানে ‘বাঁচো ও বাঁচাও’র নীতি বা আদর্শের চেয়ে ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ থেকে ‘চাচা আপন জান বাঁচা’ই নয়, ‘আমাকে আমার মত থাকতে দাও’-এর মতো বিচ্ছিন্নতাবিলাসী ভোগী জীবন আমাদের স্বার্থপর দৈত্যে পরিণত করে। আধুনিকতার মধ্যে যে মানবমুখী চেতনার শ্রীবৃদ্ধিতে কল্যাণকামী মানবতা বিস্তারের প্রবল সম্ভাবনা ছিল, তাই সময়ান্তরে সুবিধাবাদী স্বার্থপর দৈত্যের সংখ্যাবৃদ্ধির সহায়ক হয়ে উঠেছে । সেক্ষেত্রে আধুনিক চেতনায় মানুষের মধ্যেই আত্মসচেতনতা যত নিবিড়তা লাভ করেছে,তত তার মধ্যে সমষ্টিগত কল্যাণচেতনা হ্রাস পেয়েছে, ততই আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা প্রকট হয়ে উঠেছে । এই স্বার্থপরতাই জীবনযুদ্ধকে আরও কঠিন করে তোলে।  এজন্য আধুনিক ভোগসর্বস্ব জীবনে জীবনযুদ্ধ আরও তীব্রতর হয়ে উঠেছে । একে বিচিত্র প্রকৃতির ভোগের হাতছানি, তার সঙ্গে ভোগকে করায়ত্ত করায় তীব্র প্রতিযোগিতায় সামিল হওয়া, তারও উপরে ভোগকে ভালো করে উপভোগ করার অস্থিরতাবোধে সর্বত্র যুদ্ধের দামামা বেজেই চলে। এ যেন কষ্ট করে পড়াশোনা শিখে চাকরি পেয়েও সুখ নেই । কেননা পরিবারের মধ্যে থেকে সবাই মিলে ভোগকে উপভোগ্য করতে না পারার অস্থিরতা চেপে বসে। আসলে ভোগের ধর্মই বিচ্ছিন্নকরণ। আগে একটা রেডিও বা টিভি সবাই মিলে শুনত বা দেখত, এখন হাতে হাতে মোবাইলে ছিন্নমূল পরিবার । সেখানে  প্রত্যেকেরই অতৃপ্ত মনের ক্ষুধা নিরন্তর অস্থির করে তোলে, একই পরিবারের মধ্যেই সকলে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা । সুখের ঠিকানা পেয়েও সুখের কিনারা খুঁজে না পাওয়ার অতৃপ্তি সব পেয়েও কিছুই না পাওয়ার অসন্তোষ আধুনিক মানুষকে কুরে কুরে খায় । এজন্য ভোগের হাতছানিতে পরিবার ভেঙে যায়, একাকিত্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে। আবার একা আত্মসাৎ করতে গিয়েও মনে শান্তি মেলে না। ভোগবিলাস যে জীবনকে শুধু বিচ্ছিন্নই করে না, আরও তীব্রতর প্রতিযোগিতার সামিল করে। অন্যের বেশি ভোগবিলাসে মনের সুখ চলে যায়, আরও বেশি ভোগবিলাসের আয়োজনে আরও যুদ্ধের প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে ওঠে । জীবন যত এগিয়ে যায়,চাহিদার বিকৃত ক্ষুধা তত বাড়ে, জীবনযুদ্ধ ততই কঠিনতর হয়ে ওঠে ।

অন্যদিকে বিপুল জনতার মধ্যে থেকেও মানুষের মনের বিচ্ছিন্নতাবোধ তার জীবনযুদ্ধকে আরও ভারী করে তোলে । সেই ভারে নতজানু মানুষের ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই / লড়াই করে বাঁচতে চাই’ শ্লোগানও একসময় নীরবতা পালন করে। কেননা জীবনযুদ্ধ যে শেষ পর্যন্ত এককের লড়াই, একের লড়াই, নিজের সঙ্গেই নিজের যুদ্ধ । সে যুদ্ধ যে শেষ হবার নয়। অতৃপ্ত জীবনে অনন্ত চাহিদা, নিরন্তর যুদ্ধ । অস্তিত্ব গড়ে তোলা থেকে টিকিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে অন্তহীন উত্তরণের প্রয়াসের মধ্যেই যুদ্ধের সক্রিয়তায় জীবনের পরিচয় স্বাভাবিকতা লাভ করে । সেখানে জীবন ও যুদ্ধের নিবিড় সম্পর্ক । আবার এই যুদ্ধের মধ্যেই জীবনের পরিচয় বর্ণরঙিন হয়ে ওঠে । জীবনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এই যুদ্ধই প্রতিযোগিতাকে সহযোগিতা করে তোলে । এতে ধ্বংসের হাহাকার নেই, আছে সৃষ্টির আনন্দ । নিজের মধ্যেই নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার আত্মশক্তিই এই যুদ্ধের রসদ জুগিয়ে চলে। এই যুদ্ধে কেউ পরাজিত হয় না। কেননা মানুষের বিপুল সম্ভাবনাময় জীবন আজীবন সক্রিয় থাকে। সেখানে যুদ্ধ জয়ের গরিমায় জীবন যেমন প্রাণবন্ত হয়, পরাজয়ের মধ্যেও তেমনই আত্মগৌরব লাভ করে। জীবনে ব্যর্থতার মধ্যে সেই জীবনযুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের গ্লানিবোধের মধ্যেই যোদ্ধার আভিজাত্যবোধ স্বমূর্তি ধারণ করে । এজন্য জীবনের উপান্তে এসে জীবনের ব্যর্থতাবোধেও সেই যুদ্ধ না করার জন্য খেদ গলায় দলা পাকিয়ে ওঠে, আফশোস বাকি জীবনে অবিরত ঝরে পড়ে ।   শুধু তাই নয়, জীবনের অর্জন এই যুদ্ধের মাধ্যমেই অর্জিত হয় । জীবনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করাই এই যুদ্ধের লক্ষ্য । এজন্য এই যুদ্ধের অপর নাম জীবনসংগ্রাম । যার জীবনে এই সংগ্রাম নেই, সে বড় অভাগা। তার জীবনের পাঠ অসমাপ্ত থেকে যায় । তার জীবনটাই গড়ে ওঠে না। জীবনকে খাঁটি ও পূর্ণ করার স্বার্থেই জীবনযুদ্ধ জরুরি । জীবনযুদ্ধ তো আসলে জীবনের পাঠশালা । আজীবন নিরবচ্ছিন্ন ভাবে তার জীবনবোধ গড়ে তোলার পাঠদান করে চলে। অন্যদিকে এই যুদ্ধে হারানোর ভয় না থাকায় প্রাপ্তির প্রবল সম্ভাবনায় এই যুদ্ধ মনকে নিত্যনতুন রূপে আকৃষ্ট করে চলে। অথচ তাতে হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই, হারানোর আতঙ্ক নেই, শুধু জিতিয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা আছে। শুধু তাই নয়, জীবনের মধ্যেই অনন্য জীবনের স্বপ্ন দেখায় এই অপরিহার্য যুদ্ধ । এজন্য তা সবসময়ই স্বাগত ।

অন্যদিকে ক্ষণকালের জীবনকে চিরকালের জীবনে রূপান্তরের সাধনায় জীবনযুদ্ধের জুড়িমেলা ভার । এই যুদ্ধের মাধ্যমেই মেলে জীবনের অমরত্বের হাতছানি । মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকার আয়োজন এই জীবনযুদ্ধের মাধ্যমেই সম্পন্ন হতে পারে। অবশ্য বাইরের যুদ্ধের হতাহত বা নৃশংসতা এই যুদ্ধে না থাকলেও তার মূল্য চোকাতে অপরিসীম কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয় । বাইরের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও জীবনযুদ্ধ অবিরত ও অবারিত চলতেই থাকে। সূর্যের মতো এই যুদ্ধে নিজেকে পুড়িয়ে নিজের আলো ছড়াতে হয় । শুধু তাই নয়, জীবনযুদ্ধ বাইরের সভ্যতাবিমুখ নৃশংস যুদ্ধের চেয়েও কঠিন । কেননা এই যুদ্ধ একান্তভাবেই আত্মগত অন্তঃস্থিত অদৃশ্য যুদ্ধ । এতে বাইরের যুদ্ধের মতো শত্রুমিত্রের স্বচ্ছতা নেই,  কে শত্রু আর কে মিত্র আগাম বোঝা যায় না । পথও অজানা । এজন্য এতে দেহবল জরুরি নয়, কিন্তু মনোবল আবশ্যিক। বাইরের যুদ্ধ রক্তারক্তি না থাকলেও তাতে  প্রতিমুহূর্তে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা । সেক্ষেত্রে আত্মসংযম ও আত্মত্যাগ এবং আত্মশক্তির আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান না হলে জীবনযুদ্ধে বেশি দিন স্থায়ী হওয়া যায় না । এজন্য অনেক বীর যোদ্ধাও জীবনযুদ্ধে অসফল সৈনিক, অনেক অসীম ক্ষমতাশালিও এই যুদ্ধে বিমুখ হয়ে থাকে। অন্যদিকে সফল মানুষমাত্রেই জীবনযুদ্ধের অপরাজেয় সৈনিক। বাইরে যুদ্ধ যেখানে অচিরেই বিরতি নেয়, সময়ান্তরে থেমে যায়, জীবনযুদ্ধ সেখানে একান্ত সংগোপনে নীরবে নিভৃতে অবিরত চলে আমৃত্যু । জীবন যে গোলাপের বিছানা নয়,তা বাইরের যুদ্ধ নয়,অন্তরের যুদ্ধেয় প্রতীয়মান । বাইরের যুদ্ধ একসময় থেমে গেলেও জীবনযুদ্ধ অবিচ্ছিন্ন অবিরল চলে নিরবধি । যুদ্ধের ভয়ঙ্কর প্রতাপ জীবনযুদ্ধের মধ্যে আরও ঘনিয়ে ওঠে,আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। বাইরের যুদ্ধের ধ্বংসলীলাকে কাটিয়ে ওঠার জন্যও জীবনযুদ্ধের বনেদি আয়োজন । এজন্য জীবন জুড়েই জীবনযুদ্ধের আরতি চলে। জীবনের রাজত্বে জীবনযুদ্ধ অনিবার্য । দাসত্বকেই মেনে নিলে এই যুদ্ধের বিরতি মেলে বা থেমে যায় । জীবনযুদ্ধই যে জীবনের উত্তরণ থেকে উৎকর্ষের সোপান ! আর সে কারণেই যুদ্ধের সেরা জীবনযুদ্ধ যা মানুষের অপরাজেয় প্রকৃতিকে চির সবুজ ও সজীব করে রাখে নিরন্তর ।