• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

ভাঙে পাড় গড়ে না কূল

মহম্মদ শাহবুদ্দিন নদী যেমন রাখে, তেমন কেড়েও নেয়৷ বাংলায় বর্ষা এলে নদীর পাড়ে চলে অবিরাম ভাঙা-গড়া৷ বদলে যায় জন্মভিটের মানচিত্র৷ অন্যদিকে নদীর জলস্তর কমায় শীতের মরশুমেও ভাহে নদী পাড়৷ নদীর পারে বসবাস তাই চিরকাল সুখের হয় না৷ ভাঙন কালের অন্য রূপ অন্য চেহারা৷ যে জনপদ ছিল গঙ্গার তীর ধরে, তা চলে যায় জলের তলায়৷ স্ফীত

আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি। (Photo by Dibyangshu SARKAR / AFP)

মহম্মদ শাহবুদ্দিন

নদী যেমন রাখে, তেমন কেড়েও নেয়৷ বাংলায় বর্ষা এলে নদীর পাড়ে চলে অবিরাম ভাঙা-গড়া৷ বদলে যায় জন্মভিটের মানচিত্র৷ অন্যদিকে নদীর জলস্তর কমায় শীতের মরশুমেও ভাহে নদী পাড়৷ নদীর পারে বসবাস তাই চিরকাল সুখের হয় না৷ ভাঙন কালের অন্য রূপ অন্য চেহারা৷ যে জনপদ ছিল গঙ্গার তীর ধরে, তা চলে যায় জলের তলায়৷ স্ফীত জলের চাপে ভাঙে খেত বসতি৷ প্রতি বর্ষায় পাল্টে যায় নদী তীরের জীবন৷ যে নদী বয়ে যেত দূরে, বয়ে আনত নোনা বাতাস, সেই নদীই এখন আছড়ে পড়ছে উঠোনের গায়ে৷ গ্রাস করে নিকোনো দাওয়া, গোয়াল ঘর, ধানের গোলা৷ নদী পাড় ভাঙার আগ্রাসন নিয়ে আসে বার বার বছর বছর৷ বর্ষাকাল তখন ভাঙনকাল৷ ভাঙন বলতে আমরা মূলত বুঝি নদী ও মোহনা উপকূলের ভাঙনকে৷ জলের প্রবাহ, প্লাবন, জোয়ারভাঁটা, ঝড়ের গতির সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসে পাড় ভেঙে পড়াই হল ভাঙন৷ ভাঙনের পিছনে বড় কারণ উপকূলের দুর্বল ভূমি৷ নদীতীরের মাটির স্তরের প্রকৃতিই নদীর ভূমিক্ষয়ের প্রবণতাকে নির্ধারণ করে৷ গঙ্গা ও তার শাখা নদীর প্রবাহপথ অতীতে বহুবার বদলেছে৷ গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদীগুলির মধ্যে এই প্রবণতা বেশি৷ পলির সঞ্চয় পূর্ব ভারতের নদীর বৈশিষ্ট্য৷ তাই মাটির ক্ষয় প্রবণতাও বেশি৷ নদীর অভ্যন্তরীণ গতি বিন্যাস এখানে বার বার পাল্টেছে৷ নদীর এই অস্থির গতিপ্রবাহ যেমন থামেনি, তেমন ভাঙনকে রোধ করা যায়নি৷ অনেক সময় বর্ষার ভরা নদীতে ভাঙন দেখা যায় না৷ জলস্তর উঁচু থাকার ফলে নদীপাড়ের ভেতরে প্রবিষ্ট জল বেরিয়ে আসতে পারে না৷ বর্ষার পর জলস্তর নেমে গেলে দুর্বল মাটিতে তখন চলে ক্ষয়পর্ব৷ শুরু হয় নদী পাড়ের ভাঙন৷

পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় সমস্যার বড় দিক হল উপকূলের ভাঙন৷ এই ভাঙনের সাথে ভাঙছে উপকূলের জনপদ৷ জলস্ফীতি গ্রাস করছে সাগরের বুকে জেগে থাকা দ্বীপগুলিকে৷ আমাদের গাঙ্গেয় সমভূমির দক্ষিণাংশ ঢেকে রয়েছে দোঅাঁশ মাটিতে৷ সাগরের কাছ এই মাটি হয়ে উঠেছে আরও লবণাক্ত৷ সুন্দরবন জুড়ে তাই লবণাক্ত জলের উদ্ভিদ৷ অন্যদিকে পশ্চিম ও মধ্যবঙ্গে রয়েছে ল্যাটেরাইট লালমাটি৷ তার পাশে রয়েছে পাথুরে রুক্ষ বেলেমাটি৷ আবার হিমালয়ের নীচু অং‌ে্শ মিশে আছে খরস্রোতা ধাতু জলের সঙ্গে মিশে থাকা পার্বত্য মাটি৷ এই ভিন্ন প্রকৃতির মাটির ক্ষয়ও ভিন্ন প্রকৃতির৷ নদী বিজ্ঞানীরা মনে করেন সাগর অভিমুখী দক্ষিণবঙ্গের নদীগুলি জটিল ঘুরপথে প্রবাহিত হয়, ফলে যে পলি সমুদ্রে এসে পড়ার কথা, তা বার বার জোয়ারের টানে নদী উপকূলে ফিরে এসে আবার নদী পাড়ে ছড়িয়ে পড়ে৷ ফলে অতি বর্ষণে ভাঙন আরও বড় চেহারা নেয়৷

বর্ষাকালে দক্ষিণবঙ্গের প্রান্তিক অঞ্চলগুলি ভাঙনের কবলে পড়ছে বেশি৷ উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলের মানুষের ভবিষ্যৎ এক কঠিন প্রশ্নচিহ্নের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে৷ গৃহহারা মানুষ বসত ছেড়ে জীবনে অন্য অবলম্বনকে আাঁকড়ে ধরবে, এখানেও থেকে যাচ্ছে অনিশ্চয়তা৷ যারা গৃহহীন হচ্ছেন, তারা কেন্দ্রীয় সরকারের আবাস যোজনা থেকে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন, কারণ তাঁরা জলে তলিয়ে যাওয়া জমির ঠিকমতো হদিশও দিতে পারছেন না৷ বন্যায় ঘূর্ণি ঝড়ে সব উড়ে গেলেও ভিটে মাটিটুকু পড়ে থাকে, কিন্ত্ত ভাঙনের আঘাতে এক ধাক্কায় মানুষের পায়ের তলার মাটিটা হারিয়ে যায়৷ উপগ্রহ ছবিতে ভূবিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছন গঙ্গার ভাঙন প্রবণতা আরও পূর্ব দিকে প্রসারিত হয়ে চলেছে৷ তাঁরা লক্ষ্য করছেন নদী উপত্যকাগুলিতে গভীর খাত সৃষ্টি হচ্ছে কিনা৷ এই খাত বরাবর যথাস্থানে পলি খনন এবং সেই খাতে নদীকে প্রবাহিত করতে পারলে ভাঙন প্রবণতা অনেকটাই কমে যাবে বলে গবেষকরা আশা প্রকাশ করেছেন৷ মালদা জেলার ভুতনি দিয়ারার নদী প্রণালীর মধ্যে এমন গভীর খাত লক্ষ্য করা গেছে৷ কালিয়াচক, মানিকচক, রতুয়া মালদার ভাঙনপ্রবণ এলাকা৷ প্রতি বছর নদীভাঙনে তীরবর্তী গ্রামের পরিধি ছোট হয়ে আসছে৷

মালদার মালতীপুর বিধানসভার বিধায়ক আব্দুর রহিম বক্সি জানালেন, একসময় গঙ্গা থেকে সীমান্তবর্তী ফুলহার নদীর দূরত্ব ছিল আট কিমি৷ ভাঙনে শেষ হয়ে গেছে সাত কিমি৷ বাকি আর এক কিমি৷ জলে তলিয়ে গেছে মুলিরামতলা সহ বহু গ্রাম৷ কালিয়াচক, মানিকচক প্রতি বছর বন্যার কবলে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়৷ এর প্রতিরোধে বহু প্রয়াস চলেছে৷ রাজ্য সরকারও হাত বাড়িয়েছে৷ বিধায়কের কথা অনুযায়ী মালদায় নদী ভাঙন একটা জাতীয় বিপর্যয়ের রূপ নিয়েছে৷ গঙ্গা, ভাগীরথী, হুগলির মতো নদীর ভাঙন রোধে পাথর, বাঁশের খাঁচা ও বালির বস্তার ব্যবহার চলেছে বহুদিন৷ এতেও কিন্ত্ত ভাঙন প্রতিরোধ বার বার ব্যর্থ হচ্ছে৷ নদীর দু’পাড় বরাবর পাথরের আাচ্ছাদন নির্মাণের ওপর বিজ্ঞানীরা বেশি জোর দিতে চাইছেন৷ প্রকল্পটি ব্যয়সাপেক্ষ হলেও নদীর গতিপথ রোধ করতে তা অনেকটা সক্ষম হবে৷ অতি বর্ষার দু’কূল ছাপানো জলও এতে দিশা পাবে৷ শুধু তাই নয়, প্লাবনের জল পাড়ের মাটির গভীরে প্রবেশের শক্তিও অএনকটা হারিয়ে ফেলবে৷ পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ভাঙনের ছবির দিকে তাকালে দেখব, প্রতি বছর বর্ষার মরশুমে ভুটান পাহাড় থেকে নেমে আসা নদী আলিপুরদুয়ারের কুমারগ্রামে মানুষের জীবনে নিয়ে আসে ভয়ানক দুর্দশা৷ ডুয়ার্সে বর্ষা প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তিস্তা, তোর্সা, করতোয়া, জলঢাকা নদীতীরের মানুষ ভাঙনের আশঙ্কায় দিন কাটায়৷ এবারে জুনের প্রথমেই শুরু হয়ে গিয়েছিল তিস্তার তাণ্ডব৷ খরস্রোতা প্লাবনের আঘাতে ভেঙে পড়েছে সিকিম, দার্জিলিংয়ের পাহাড়ী পথ৷ মানুষকে উদ্ধারের কাজ এখনও চলছে৷ জুনের শেষ থেকেই কালাজানি নদী ফুঁসতে শুরু করেছে৷ বাঁধভাঙা কালজানির জলে কোচবিহার ২ নং ব্লকের আমবাড়ি পঞ্চায়েতের বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দারা জলবন্দি হয়ে পড়েছেন৷ নদী গবেষকরা ভাগীরথীর জঙ্গীপুরের ডান পাড়, পলাশী-বহরমপুরের মাঝামাঝি অঞ্চল, হুগলির সমুদ্রগড় বলাগড়ের দুই তীর, হাওড়ার উলুবেড়িয়া, সাঁকরাইলের দুই পাড় এবং ফলতার নদীপাড়কে বেশি ভাঙনপ্রবণ বলে চিহ্নিত করেছেন৷ বর্ষার অতিবৃষ্টি শুরু হলেই পাড়ের মাটিতে ফাটল ধরতে শুরু করে৷ তুমুল বৃষ্টির শব্দের সাথে যেখানে মিশে যায়, পাড়ের মাটি ধসার ঝুপঝুপ শব্দ৷

আমাদের পূর্ব উপকূলে প্রায় প্রতিবছর ঘনাচ্ছে একটার পর একটা ঝঞ্ধার কালো মেঘ৷ বঙ্গোপসাগর উপকূলে আয়লা, আমফান, ইয়াসের মতো বিধ্বংসী ঝড় উজাড় করে দিয়েছে মানুষের জীবনের ভিত৷ ২০০৯-এর আয়লা থেকে ২০২১-এর ইয়াস ঝড়, অতিবৃষ্টি আর নদীর ভাঙনের ফলে এক কোটিরও বেশি মানুষের জীবনে বিপর্যয় এনেছে৷ এবারের ঘূর্ণিঝড় রেমালে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে উকূল বঙ্গের নদীবাঁধে৷ কূল ছাড়িয়ে জলপ্লাবিত করেছে জনবসতি এলাকা৷ নদীর ভাঙন বাঁচাতে গড়ে উঠেছে নানান সরকারি প্রকল্প৷ ২০০৫ সালে প্রবর্তিত জাতীয় পরিবেশ নীতির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে নদী ও সাগর উপকূলের ভাঙন সমস্যাকে৷ বর্ষায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও ভাঙনের প্রকোপ সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ওপরও এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷ নদীতীরে যেমন জলপ্রবাহের ধারায় বাঁধা, তেমনই এই প্রবাহ ভূখণ্ডের বাঁধনে বাঁধা৷ ভাঙনের এই মুখ শহরের বাঁধানো ঘাটের নয়, এই মুখ বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের৷ ভাঙছে মালদা, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, হাওড়া, দুই ২৪ পরগনার নদীপাড়৷ বিধ্বংসী রূপ নিচ্ছে নদীর ভাঙন৷ পাল্টে যাচ্ছে নদীতীরের মানচিত্র৷

নদীর সমস্যা নিয়ে গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল৷ প্রথমে ১৮৫৩ সালে ইংল্যান্ডের জলসেচ বিজ্ঞানী স্যার আর্থার থমাস কটন গঙ্গাল পলি সমস্যা ও নাব্যতা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন৷ এর ১০৪ বছর পর ১৯৫৭ সালে এ দেশে আমন্ত্রিত হন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নদীবিজ্ঞানী ডব্লু হেনসেন ও জে জে ড্রনকার্স৷ তাঁরা ফরাক্কায় গঙ্গীর ওপর বাঁধ তৈরির পরামর্শ দেন৷ তেরো বছর দরে প্রযুক্তিবিদদের দীর্ঘ পরিশ্রমে ফরাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে বেঁধে ফেলা হয় গঙ্গাকে৷ আমরা আশা করেছিলাম শুখা মরশুমে ফরাক্কা থেকে চল্লিশ হাজার কিউসেক জল ভাগীরথী-হুগলিতে প্রবাহিত করানো যাবে৷ ধুয়ে যাবে পলির স্তর৷ কিন্ত্ত পাল্টে গিয়েছে নদীর অববাহিকার চরিত্র৷ হুগলির নাব্যতা এখনও রয়ে গিয়েছে৷ যে পলি সাগরের ধুয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে বছর বছর পলিস্তর জমা হচ্ছে৷ অববাহিকার উজানে পলির স্তর আশানুরূপভাবে স্থানচূ্যত হচ্ছে না৷ টানা বর্ষায় তাই বার বার জলে ভরে উঠছে নদী৷ ভেঙে ফেলছে আমাদের স্থলভাগের বন্ধন৷

নদীর ধারা সমৃদ্ধ করে জনপদকে তার যাত্রাপথের দু’পারের উষরভূমি ভরে ওঠে শস্যে৷ গতিপথ পাল্টে যাওয়া নদীই পাড় ভাঙে৷ ভাঙনের জন্য মানুষও দায়ী৷ মানুষ নদী প্রয়োজনে অপরিমিতভাবে তুলে নেয় পাড়ের মাটি৷ দুর্বল হয় মাটির স্তর৷ বর্ষার দু’কূলের প্লাবন দুর্বল মাটিতে ধস নামায়৷ নদীর তীরভূমি, পরিবেশের বাঁধন আমাদের অস্তিত্বের বাঁধন৷ নদীকে বাঁচাতে, নিজেদের বাঁচাতে আসুন সবাই মিলে মাটির বাঁধনকে বেঁধে রাখি৷