শিবশঙ্কর দাস
কল্পতরু উৎসব ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের এক মহিমান্বিত অধ্যায়, এই দিন ঠাকুর অকাতরে তাঁর ভক্ত শিষ্যদের মনবাঞ্ছা পূরণ করেছেন। যে কোনো দীন-দুঃখী, পাপী-তাপী সকলের কাছে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের ঘরের লোকের ন্যায় তাদের আবদার পূরণ করছেন মা ভবতারিনীর কৃপায়। এক সময়ের এই মহা আধ্যাত্মিক পূর্ণ লগ্ন আজও মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। কল্পতরু উৎসবের একাল ও সেকাল এর যে যোগসূত্র তা আজও কাশীপুর উদ্যানবাটীতে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। বহু ভক্তের আবেগ ও অনেক কিছু চাওয়া পাওয়া যেন ঠাকুর কল্পতরু রূপে অবতীর্ণ হয়ে ভক্তদের মধ্যে বিলিয়ে দিচ্ছেন এই অনুভুতিই ভক্ত ও তাদের প্রানের ঠাকুরের মধ্যে অভূতপূর্ণ মেলবন্ধন ঘটিয়েছে।
১৮৮৬ সালের ১লা জানুয়ারী বিকালে কাশীপুর উদ্যান বাটীতে যেদিন ভগবান শ্রী রামকৃষ্ণ কল্পতরু রূপে গৃহী ভক্তদের কৃপাদান করেছিলেন সেদিনটি ছিল সমগ্র বিশ্ববাসীর আধ্যাত্মিক জগতে এক স্মরনীয় ঘটনা। ঠাকুর দুপুরে বিশ্রামের পর ভ্রাতুষ্পুত্র রামলালের কাছে তাঁর উদ্যান ভ্রমনের ইচ্ছে ব্যক্ত করেন। রামলাল সেই ইচ্ছায় সাড়া দেন। ঠাকুরের সর্বাঙ্গ সুন্দর বস্ত্রে আবৃত । ঠাকুর যখন রামলালকে ধরে বাড়ির দোতলা থেকে নেমে আসেন, তখন একতলার হলঘরের পাশের ছোট ঘরে কয়েকজন সেবক নিদ্রিত ছিলেন। পূর্বরাত্রে ঠাকুরের সেবা অথবা সাধন ভজনের দরুন রাত্রি জাগরনের ফলে তাঁরা ক্লান্ত ছিলেন। ঠাকুরের কিছু বহিরাগত ভক্ত সেদিন যেমন উদ্যানে বেড়াছিলেন তেমনই হলঘরেও কয়েকজন বসেছিলেন। ঠাকুর হলঘরে পশ্চিমদিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন সুড়কির রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকের ফটকের দিকে এগিয়ে যান৷ ঠাকুরকে অসুস্থ শরীর নিয়ে হঠাৎ নিচে নামতে দেখে উপস্থিত কয়েকজন ভক্ত তাঁকে অনুসরণ করেন, সেবক লাটুও ঠাকুরকে একটু অনুসরণ করে অন্যান্য ভক্তদের তাঁর সঙ্গে দেখে ঠাকুরের বসবাসের ঘরখানি পরিস্কার করে দেবার ব্যবস্থা করেন লাটু।
ইংরেজি বছরের প্রথমদিন হিসাবে ছুটি থাকতো আগে ইংরেজ রাজত্বের সময় তাই-ই ছিল, প্রায় ত্রিশ জনের বেশি ভক্ত উদ্যানে এসেছিলেন ছুটি উপভোগ করতে এবং ঠাকুরের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে। কিন্তু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সেদিন সেইভাবে উদ্যানে একাকী বেড়াতে দেখে উপস্থিত ভক্তমন্ডলীর প্রাণে আনন্দের জোয়ার আসে এবং তারা সকলে ঠাকুরকে অনুসরণ করতে থাকেন। ঠাকুরের এই সময়কার রূপ বর্ণনা করে ভক্ত রামচন্দ্র দত্ত তাঁর পরমহংস দেবের জীবন বৃত্তান্ত লিখেছেন— সেদিনকার রূপের কথা স্মরণ হইলে আমার এখন ও আশ্চর্য হইয়া থাকি । “তাঁহার সর্বশরীর বস্ত্রাবৃত ছিল। মুখমন্ডলের জ্যোতিতে দিক মন্ডল আলোকিত হইয়াছিল মুখের যে অত শোভা হইতে পারে তাহা কাহারও জানা ছিল না”।
সেদিন বসতবাটি ও ফটকের মাঝামাঝি ঠাকুর-এসে পৌঁছিলে গিরিশচন্দ্র রামচন্দ্র প্রভৃতি গৃহীভক্তগণ ঠাকুরের কাছে এসে উপস্থিত হন। তাঁদের দেখে ঠাকুর আকস্মাৎ গিরিশচন্দ্রকে প্রশ্ন করেন তুমি যে আমার সম্বন্ধে এত বলে বেড়াও তুমি কি দেখছ বা বুজেছ? ঠাকুরের এই আকস্মিক প্রশ্নে গিরিশচন্দ্র কোনরূপ বিচলিত না হয়ে তৎক্ষনাৎ রাস্তার ওপরেই ঠাকুরের পদতলে জানু পেতে উপবিষ্ট হয়ে দুটি হাত জোর করে গদগদ করে আগাধ বিশ্বাসে উত্তর দেন – ব্যাস বাল্মিকী যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেনি আমি তাঁর সম্বন্ধে বেশি কি আর বলতে পারি। গিরিশচন্দ্রের এই কথা শোনা মাত্রই ঠাকুরের সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হয় এবং তিনি গভীর ভাব সমাধিতে মগ্ন হন। তাঁর সেই সময়কার অপরূপ দিব্যভাব এবং অভূতপূর্ব রূপমাধুর্য দর্শন করে সমবেত ভক্তগন মুগ্ধ হন এবং গিরিশচন্দ্র মহা উল্লাসে বার বার জয় রামকৃষ্ণ ধ্বনি দিয়া ঠাকুরের চরণধুলি গ্রহন করতে থাকেন।
এরপর ঠাকুর বাহ্যদশায় ফিরে এলে সহাস্যবদনে সকল ভক্তের প্রতি কৃপা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চৈতন্য হোক এই আশীর্বাদ উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই ভাবাবিষ্ট হয়ে পরেন। এই সময় ভক্তের ভাবের উল্লাসে ঠাকুরের জয়ধ্বনি দিয়ে ঠাকুরের শ্রীচরণে প্রণাম করেতই তিনি ভাবাবস্তাতেই ভক্তদের বক্ষস্পর্শ করে একে একে সকলকে তোমাদের চৈতন্য হোক এই আশীর্বাদ করতে থাকেন সকলে চিৎকার করিয়া একে অপরকে ডাকতে থাকে ঠাকুরকে প্রাণাম করার হিড়িক পড়ে যায়। সমস্ত ভক্তরা তাঁদের চোখের সম্মুখে দেবত্মর মহিমায় প্রকাশ উপলব্ধি করতে লাগল। সকলেই মন্ত্রমুগ্ধবৎ ঠাকুর রামকৃষ্ণকে নিরীক্ষণ করতে লাগলো। কেহ বা ফুল মালা এনে মন্ত্রচারণ করিতে করিতে ঠাকুরের অঙ্গে উহা নিক্ষেপ করিয়া তাঁহাকে পূজা করিতে লাগিল । কিছুক্ষণ ওইরূপ হইবার পর ঠাকুরের ভাব শান্ত হইতে দেখিয়া ভক্তগণ ও পূর্বের ন্যায় প্রকৃস্থিত হইল এবং কাশীপুর উদ্যান ভ্রমন ওইরূপে পরিসমাপ্ত করে ঠাকুর নিজ কক্ষে গিয়া উপবিষ্ট হলেন।
আজও কাশীপুর উদ্যান বাটিতে সকাল থেকে লক্ষাধিক ভক্তের ঢল নামে ঠাকুরকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এবং নানরকম অনুষ্ঠানসূচীও এই মাঠে অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার নামী দামী শিল্পীরা এতে আংশগ্রহণ করে। বহু স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা ও ক্লাব এই সমস্ত ভক্তদের নানাভাবে সাহায্য করে থাকে। তাদের এই ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আজও কল্পতরু উৎসবকে সাফল্য মণ্ডিত করে তুলতে বধ্য পরিকর যা সেকালে ও একালের এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন।
তবে এই দিনটিতে কাশীপুর উদ্যানবাটীর একটি বৃক্ষতে ভক্তরা আজও একটি কাগজে নিজের মনস্কামনা জানিয়ে ঝুলিয়ে দেয় । বহুভক্ত সেই বৃক্ষকে কল্পতরু বৃক্ষরূপে দন্ডায়মান দেখে তাতে তাদের যতটুকু সামর্থ ততটুকু দান দিয়ে নিজেদের ধন্য ও কৃতার্থ মনে করে। এবং পবিত্র এই দিনটির মাহাত্ম উপলব্ধি করে।