স্বামী বিবেকানন্দের অর্থনৈতিক জ্ঞান বিদেশি পন্ডিতদের বিস্মিত করেছিল

ফাইল চিত্র

ড. কুমারেশ চক্রবর্তী

১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর! শিকাগো বিশ্ব ধর্ম সভা! এখানে স্বামী বিবেকানন্দের ঐতিহাসিক ভাষণের কথা সকলের জানা! ভারত সহ সারা পৃথিবী সেদিন চিনেছিল প্রকৃত ভারতবর্ষকে এবং শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য বিবেকানন্দকে। এসব কথা ভারত সহ সারা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুদেরই জানা কিন্তু অনেকেরই কাছেই অজানা এর দিন পাঁচ আগে আর একটি অর্থনৈতিক মহাসম্মেলনে বিবেকানন্দের আরেকটি চিরস্মরণীয় বক্তৃতার কথা। সেদিন আমেরিকার সোশ্যাল সাইন্স কর্তৃক আয়োজিত অর্থনীতি সংক্রান্ত একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন ছিল। সেই সম্মেলনে অতিথি বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। সেই সভায় স্বামী বিবেকানন্দ অর্থনীতি বিষয়ে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা শুনে আমেরিকা এবং বিশ্বের তাবড় তাবর অর্থনৈতিক পন্ডিতরা একেবারে মুগ্ধ হয়ে যান। বিবেকানন্দের অর্থনৈতিক সংক্রান্ত জ্ঞান দেখে তারা বিস্মিত। একজন সন্ন্যাসী অর্থনীতির উপর আধুনিক গভীর জ্ঞান কি করে অর্জন করে? তারা ধরেই নিলেন এই হিন্দু সন্ন্যাসীর এটা অলৌকিক প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ।

মহাসম্মেলন চলাকালীন এবং পরে আমেরিকা সহ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা অর্থনৈতিক পন্ডিতরা বিবেকানন্দের সঙ্গে এসে আলাপ পরিচয় করলেন, অনেক কথা বললেন, অনেক প্রশ্ন করলেন। তারপর তারা বুঝলেন বিবেকানন্দের বক্তৃতায় তারাও মন্ত্রমুগ্ধ হলেও এর মধ্যে কোন মন্ত্র নেই। স্বামীজী যা অর্জন করেছেন তার প্রধান মাধ্যম হল তার কঠিন কঠোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং গভীর পড়াশোনা।


আসলে অনেকেরই অজানা যে স্বামীজী ভারতে থাকাকালীন এবং ভারতের বাইরে অর্থনীতির ওপর প্রচুর বইপত্র পড়তেন কারণ তার চিন্তা ছিল দেশের কোটি কোটি মানুষের দুঃখ দারিদ্র দূর করতে হবে। তিনি জানতেন এটা মন্ত্র দ্বারা সম্ভব নয়, এর জন্য চাই উন্নত অর্থনীতি। আর সেই চেষ্টায় তিনি সর্বদাই বিভিন্ন গ্রন্থ অধ্যয়ন করতেন রাস্তা খুঁজে পাওয়ার জন্য। স্বামী বিবেকানন্দের অনেক প্রতিভার মধ্যে একটি অলৌকিক প্রতিভা ছিল এই অধ্যয়ন সংক্রান্ত। তিনি অসম্ভব দ্রুত বই পড়তে পারতেন এবং শুধু পড়া নয় তা প্রায় কণ্ঠস্থ হয়ে থাকতো। সাধারণ মানুষের পক্ষে একটা বই পড়তে যদি পাঁচ দিন সময় লাগে বিবেকানন্দের পক্ষে সেটা এক ঘন্টাতেই হয়ে যায়। এটাও তার একটা জন্মগত প্রতিভা যা পরবর্তীকাল কালে আরো চর্চার মধ্য দিয়ে আরো উন্নত হয়েছিল।

সেই অর্থনৈতিক মহা সম্মেলনে বিবেকানন্দ উন্নত রাষ্ট্রগুলির ক্ষেত্রে শিল্পায়নের উপর গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি শিল্প উন্নত দেশগুলিকে শিল্প ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন। কারণ একেবারেই গ্রামাঞ্চলে যে হাজার হাজার গরীব মানুষ বাস করে শিল্প তাদের স্পর্শ করতে পারেনা। সেখানে প্রয়োজন তাদের মত অর্থনীতি অর্থাৎ তিনি শিল্পের সঙ্গে সঙ্গে কৃষির ওপর জোর দিতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু অবাক কান্ড বিদেশীরা স্বামী বিবেকানন্দের অর্থনৈতিক পরামর্শ গ্রহণ করলেও ভারত বিবেকানন্দের অর্থনৈতিক চিন্তাকে কখনো গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি বাংলাতেও বিবেকানন্দের অর্থনৈতিক চিন্তা গুরুত্ব পায়নি। অবশ্য এটা বলাই ভালো স্বামী বিবেকানন্দের অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা সম্পর্কে বাঙালিদের ধারণা অতি সামান্য, তাই তার চিন্তাধারায় গুরুত্ব দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

তৎকালীন নবজাগরণের যুগে স্বামী বিবেকানন্দকে সকলেই সমাজ ও ধর্মীয় জগতেই সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলেন। সেই সময় ভারতের মনীষীদের মধ্যে অর্থনীতির সংক্রান্ত ব্যাপারে যারা গুরুত্ব পেয়েছেন তার মধ্যে প্রধান হলেন রাজা রামমোহন রায়। এছাড়া দাদাভাই নৌরোজি, রমেশচন্দ্র দত্ত, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে। এছাড়া কিছুটা স্বীকৃতি পেয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু এখানে স্বামী বিবেকানন্দের নাম কখনো উল্লেখ করা হয়নি।

শিকাগো ধর্ম সম্মেলনের আগে ৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার বিষয়ে ছিল ‘ভারতে রূপোর ব্যবহার’। এখানে তিনি অনুন্নত গরিব দেশ হিসেবে ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্নয়নের পথ আলোচনা করেছিলেন। সেই আলোচনায় ফুটে উঠেছিল ভারত সম্পর্কে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর অগাধ পাণ্ডিত্য। শ্রোতারা সকলেই অবাক হয়েছিলেন, ধর্ম-কর্ম নিয়ে থাকা একজন সন্ন্যাসীর পক্ষে এই ধরনের জ্ঞান অর্জন কিভাবে সম্ভব হয়! পরের দিন আমেরিকা সহ বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্রে বিশেষ করে অর্থনীতির সংক্রান্ত কাগজগুলোতে স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা এবং তার জ্ঞানের প্রশংসা ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল, এর মধ্যে আমেরিকার একটি জনপ্রিয় দৈনিক সংবাদপত্র ছিল। যার নাম Saratogain। ওই পত্রিকায় বিবেকানন্দের বক্তৃতা গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয় এবং অর্থনীতি সংক্রান্ত তাঁর গভীর জ্ঞানের ও পান্ডিত্যের কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছিল।

৬ সেপ্টেম্বরের বক্তৃতার পরে বহু আমেরিকান পন্ডিত ও পাশ্চাত্য অর্থনীতিবিদরা বিবেকানন্দের অর্থনৈতিক চিন্তার প্রশংসা করেছিলেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন পাশ্চাত্য পন্ডিত এরিক হ্যামন্ড। তিনি Reminiscences of Swami Vivekananda গ্রন্থে বলেছেন, স্বামী বিবেকানন্দ ইতিহাস ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে সমান জ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ এটা প্রমাণ করে দিয়েছেন।

বিবেকানন্দ তার ধর্মীয় জীবনে প্রবেশের আগে এবং পরে খুব নিবিড়ভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। জাত পাত সবকিছু অপেক্ষা করে সকলের কাছেই গেছেন।সকলের সুবিধা এই অসুবিধের কথা শুনেছেন। আর সাধন পর্বে ভারত পরিক্রমা তাঁকে পরিপূর্ণতা দান করেছিল। এই সময়ে বিবেকানন্দ ভারতের প্রায় প্রতিটি শহরে গ্রামে নগরে বন্দরে গিয়েছেন। বিশেষ করে প্রান্তিক গ্রামগুলির অতি দরিদ্র মানুষের সঙ্গে মিশেছেন তাদের সঙ্গে থেকেছেন, উপলব্ধি করেছেন তাদের দুঃখ কষ্ট বেদনা থেকে মুক্তির উপায়। এইসব বাস্তব অভিজ্ঞতা তাকে আরো পরিণত ও সমৃদ্ধ করে। তাছাড়া সবার উপরে ছিল তাঁর গুরু ঠাকুর রামকৃষ্ণের আশীর্বাদ। তিনি নরেন্দ্রনাথ কে তার মনের মতন করে শুধু গড়ে তুলেছিলেন তা নয় তাঁর সর্বস্ব দিয়ে গিয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ রূপী স্বামী বিবেকানন্দকে। স্বামী বিবেকানন্দ তারই আদর্শে তারই মতে, পথে চিরকাল চলেছেন।তাঁকে অদৃশ্য থেকে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ।তাঁর সেই কথাগুলো বিবেকানন্দকে সর্বদাই অনুপ্রাণিত করেছে। শুধু মনে রাখেন নি, সবাইকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, জীবের দয়া নয়, শিব জ্ঞানে জীব সেবাই হচ্ছে আসল ধর্ম আসল মন্ত্র। তাই রামকৃষ্ণের ভাবাদর্শকে বিবেকানন্দ এত সুন্দর ভাবে এত সুস্পষ্ট ভাবে সর্বক্ষেত্রেই ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন ,সেটা ধর্মের বিশ্ব সম্মেলন হোক অথবা অর্থনীতির আন্তর্জাতিক সম্মেলন হোক। তিনি মনে করেন এটাই তার গুরুর কৃপা এটাই সেই রামকৃষ্ণের দর্শন।

পাশ্চাতের অর্থনৈতিক পন্ডিতগণ বিবেকানন্দের অর্থচিন্তা এবং অর্থনীতিতে তার গভীর জ্ঞানের স্বীকৃতি দিলেও ভারত কিংবা বাংলার পন্ডিত ব্যক্তিরা কিন্তু স্বামীজীর অর্থচিন্তাকে কোন গুরুত্ব দিতে রাজি নন, বিশেষ করে বাঙালি বুদ্ধিজীবিরা যেমন অধ্যাপক ভবতোষ দত্ত, ড. বি এন গাঙ্গুলী প্রমুখ অর্থনীতিবিদদের মতে স্বামী বিবেকানন্দের সামাজিক রাজনৈতিক ধর্মীয় ক্ষেত্রে অসাধারণ জ্ঞান ও চিন্তা এবং বক্তব্য সারা বিশ্বের সমাদৃত হলেও অর্থনীতি বিষয়ে স্বামীজীর চিন্তা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিলেও বিখ্যাত ফরাসি উপন্যাসিক দার্শনিক মনীষী রোমা রোলা ও সিস্টার নিবেদিতা স্বামীজির অর্থনৈতিক চিন্তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

তাঁরা মনে করেন, বিবেকানন্দের অর্থনৈতিক চিন্তা কার্যকরী হলে গরিব মানুষের দুঃখ দুর্দশা অনেকাংশেই দূর হতে পারে। এই মতের সঙ্গে আধুনিক পশ্চিমি অর্থনীতিবিদেরা অনেকেই একমত। আরো মনে করেন, বিবেকানন্দের অর্থনৈতিক চিন্তার মধ্যে অনেক মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে এবং স্বামী বিবেকানন্দই প্রথম বিশ্বের অর্থনৈতিক সমস্যার মূল বিষযটা কি তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং তা অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় সেটাকে প্রকাশ করে গেছেন। ভারতে এই মতের সমর্থক হলেন অধ্যাপক বিমানবিহারী মজুমদার, ডক্টর সত্যেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অর্থনীতিবিদ সান্তনা দাশগুপ্ত প্রমুখ। তৎকালীন ভারতের অর্থনৈতিক চরম দৈনতা ও ভারতের দারিদ্র্যের প্রধান কারণ হিসেবে স্বামীজি বলেছেন, ইংরেজ সরকারের প্রশাসন এবং ধনী ও অভিজাত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার্থে গরিবের উপর শোষণ ও অত্যাচার।

প্রায় ১০০ বছর পার হয়ে প্রায় একই কথাই পুনরাবৃত্তি করেছেন বিশ্ববিজয়ী নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। যার মধ্যে বিবেকানন্দের অর্থনৈতিক চিন্তার অনেকটা সাদৃশ্য দেখতে পাই। তবুও বিবেকানন্দের অর্থনীতিকে আমরা আজও স্বীকৃতি দান করতে পারি না। এটাও আমাদের চিরকালীন ঔপনিবেশিক দাসত্বের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়।

স্বামীজি বলেছিলেন, অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্নয়ন করতে হলে উৎপাদনের তৃণমূল স্তরে যেতে হবে। কৃষক ও শ্রমিকের দুঃখ কষ্ট দূর করতে হবে, দারিদ্র দূর করতে হবে। তিনিও শিল্পায়ন চেয়েছিলেন। কারণ তাঁর মতে শিল্পায়ন ছাড়া দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি একই সঙ্গে বলেছিলেন, কৃষক দিনমজুর ও কুটির শিল্পের ক্ষতি করে শিল্পায়ন সফল হতে পারেনা। ভাবতে অবাক লাগে আজ থেকে শতাধিক বছর আগেও ভারতের উন্নয়নের জন্য স্বামীজি যা বলেছিলেন আজও তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। অর্থাৎ সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেমন বিবেকানন্দের পথে মুক্তির পথ, অর্থনৈতিক সংস্কার ও শিল্পায়নের ক্ষেত্রেও তেমনি স্বামী বিবেকানন্দের পরামর্শ সবচেয়ে উপযুক্ত মন্ত্র ও মুশকিল আসান সান।