বাঙ্গালীর সংস্কৃতি

সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতর পর

(৪) বাঙ্গালার সাহিত্য— ঈশ্বরচন্দ্র, প্যারীচাঁদ, বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু, মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, ভূদেব, বিবেকানন্দ, গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল, কালীপ্রসন্ন, দ্বিজেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথ, প্রভাতকুমার, শরৎচন্দ্র প্রমুখ সাহিত্যিকগণ।

(৫) বাঙ্গালার নবীন শিল্প-পদ্ধতি—ভারতীয় প্রাচীন শিল্পের পুনরুদ্ধারের চেষ্টা— অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল ও ইঁহাদের শিষ্যানুশিষ্যগণ।
(৬) নাট্যশিল্পের প্রযোজনায় বাঙ্গালীর কৃতিত্ব, কি রঙ্গমঞ্চের কি চলচ্চিত্রের আধুনিক উন্নতিতে, সমগ্র ভারতে ও বিশ্বে-স্বীকৃত। গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল, অপরেশচন্দ্র, অর্ধন্দুকুমার, শিশিরকুমার প্রভৃতির নবীনত্ব ও কৃতিত্ব অনন্যসাধারণ ছিল। চলচ্চিত্রে বাঙ্গালী প্রযোজকের নাম ভারতবর্ষের গৌরব বৃদ্ধি করিয়াছে।


(৭) রবীন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত বাঙ্গালা সংগীতের নূতন ধারা; শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায় এবং অন্যত্র উদয়শংকর প্রভৃতি বাঙ্গালী নৃত্যকলাবিদগণের দ্বারা প্রবর্তিত ভারতীয় নৃত্যের নূতন ধারা।

(৮) বাঙ্গালার সমাজ-সংস্কার-প্রচেষ্টা ও সংরক্ষণ চেষ্টা—রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ভূদেব, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ, বিপিনচন্দ্র।
(৯) বাঙ্গালায় আরদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন, এবং বঙ্কিম প্রমুখ বাঙ্গালী কর্তৃক ভারত-মাতার কল্পনা। হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণদাস পাল, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, লালমোহন ঘোষ, আনন্দমোহন বসু, অশ্বিনীকুমার দত্ত, শিশিরকুমার ঘোষ, মতিলাল ঘোষ, আনন্দমোহন বসু, অশ্বিনীকুমার দত্ত শিশিরকুমার ঘোষ, মতিলাল ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অম্বিকাচরণ মজুমদার, যাত্রামোহন সেন, বিপিনচন্দ্র পাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ, চিত্তরঞ্জন দাশ, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, সুভাষচন্দ্র বসু।

(১০) কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করিয়া জ্ঞান ও বিজ্ঞান বিষয়ে বাঙ্গালী পণ্ডিতদের গবেষণা— আশুতোষ, রামেন্দ্রসুন্দর, জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র, মেঘনাদ, সত্যেন্দ্রনাথ।
(১১) বাঙ্গালীর প্রশ্নতত্ত্ব ও ইতিহাস বিষয়কসার্থক গবেষণা— রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রামদাস সেন, উমেশচন্দ্র বটব্যাল, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শরৎচন্দ্র দাস, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার, রমাপ্রসাদ চন্দ, শরৎচন্দ্র রায়।

বাঙ্গালা সংস্কৃতিতে যে একাধারে পাণ্ড্যি ও কৃতকারিতার অভাব নাই, তাহা আধুনিক বাঙ্গালার ‘বাচস্পত্য’ সংস্কৃত অভিধানের সংকলয়িতা তারানাথ তর্কবাচস্পতি এবং বাহ্গালা ‘বিশ্বকোষ’কার নগেন্দ্রনাথ বসু দ্বারা প্রমাণিত হইয়াছে।

প্রসঙ্গতঃ বিশিষ্ট বাঙ্গালী সংস্কৃতির কতকগুলি লক্ষণীয় অঙ্গ বা উপজীব্য বস্তু, অনুষ্ঠান ও প্রকাশের উল্লেখ করা গেল। বাঙ্গালার সংস্কৃতির গতির দিগ্দর্শনে ফিরিয়ে আসা যাউক।

মোগল-যুগের মধ্যেই, বাঙ্গালা দেশে ইউরোপীয়—পোর্তুগীস, ওলন্দাজ, ফরাসি, দিনেমার ও ইংরেজ—আসিল। ইংরেজ ধীরে-ধীরে দেশের রাজ্য হইয়া বসিল। বাঙ্গালীর সংস্কৃতিতে ও সাহিত্যে, ইংরেজের সহিত সাহচর্য্যের ফলে, আর একবার যুগান্ত উপস্থিত হইল।

এই যুগান্তর এখনও চলিতেছে। ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগ হইতে আরম্ভ করিয়া এখন পর্য্যন্ত, এই যুগান্তর ব্যাপারে আমরা চারিটি পর্য্যয় বা ক্রম দেখিতে পাই। (১) রামমোহন যুগ, (২) ‘‘ইয়ং-বেঙ্গল’’-এর যুগ, (৩) বঙ্কিম-ভূদেব-বিবেকানন্দ যুগ, ও (৪) অতি আধুনিক যুগ, বা লড়াইয়ের পরের যুগ।
(১) প্রথম যুগে ইউরোপীয় মনের সহিত বাঙ্গালী মনের প্রথম পরিচয়। এই প্রথম পরিচয়ের সময়ে, ভারতের প্রাচীন শিক্ষায় সুশিক্ষত মন একটু সাবধানতা অবলম্বন করিতে চাহিয়াছিল, একেবারে নিজেকে বিকাইয়া দিতে চাহে নাই। রামমোহন এই যুগের প্রতীক। ইনি অসাধারণ-মনীষাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন।

(ক্রমশ)