বর্ধিত হতে চলেছে সুন্দরবন। এই বনাঞ্চল ইতিমধ্যেই ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তাপমা পেয়েছে। এরমধ্যেই ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি (এনটিসিএ) দক্ষিণ ২৪-পরগনার ১,১০০ বর্গকিলোমিটার বনাঞ্চলকে বিদ্যমান বাফার জোনে অন্তর্ভুক্ত করার প্রযুক্তিগত অনুমোদন দিয়েছে। ফলে সুন্দরবন দেশের ৫৫টি অভয়ারণ্যের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম বাঘ সংরক্ষণে পরিণত হবে৷
আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য এখন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল বোর্ড অফ ওয়াইল্ডলাইফ (এনবিডব্লুএল)-এর কাছ থেকে একটি ছাড়পত্র প্রয়োজন। তবে এটা একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
রাজ্যের বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবন বর্তমানে ভারতের সপ্তম বৃহত্তম বাঘ সংরক্ষণাগার। ২,৫৮৫ দশমিক ৮৯ বর্গকিমি জুড়ে বিস্তৃত, সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ বা এসটিআর। দক্ষিণ ২৪-পরগনার তিনটি বন রেঞ্জ- রায়দিঘি, মাতলা এবং রামগঙ্গা-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে৷ তারপরে সুন্দরবন ৩,৬২৯ দশমিক ৫৭ বর্গকিলোমিটারে প্রসারিত হবে।
সম্পূর্ণ সুন্দরবন, অন্ধ্রপ্রদেশের নাগার্জুনসাগর শ্রীশৈলম টাইগার রিজার্ভের থেকে মাত্র ১০০ বর্গকিমি ছোট হবে। শ্রীশৈলম টাইগার রিজার্ভ,দেশের বৃহত্তম বাঘ সংরক্ষণাগার, ৩,৭২৭ দশমিক ৮২ বর্গকিমি জুড়ে বিস্তৃত।
এনটিসিএ-র সদস্য সচিব জিএস ভরদ্বাজ এই প্রতিবেদককে জানান, “সুন্দরবনের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই এনটিসিএ থেকে একটি প্রযুক্তিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে”। কেন্দ্রীয় বনমন্ত্রী ভূপেন্দর যাদবের নেতৃত্বে এনটিসিএ হল পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের অধীনে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা যা বাঘ সংরক্ষণের বিষয়ে প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্ত নেয়।
এনটিসিএ-র এই ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রস্তাবের ভিত্তিতে। তিনটি বন রেঞ্জের সমগ্র এলাকাকে এসটিআর-এ অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে এটি প্রথম পদক্ষেপ। অরণ্য ভবন বিশ্বাস করে, এই ছাড়পত্রের ফলে এই অঞ্চলগুলোতে বাঘ সংরক্ষণে ব্যবস্থাপনার উন্নতি করবে। এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থায়ন বাড়বে।
রাজ্যের বন দফতরের একজন সিনিয়র কর্তা বলেন, আমরা আশা করি যে কোনো সময় ন্যাশনাল বোর্ড অফ ওয়াইল্ডলাইফ (এনবিডব্লুএল) ছাড়পত্র দেবে। সম্ভবত পরবর্তী নবিডব্লুএল-এর সভায়। কারণ প্রস্তাবটি প্রায় সাত মাস ধরে মন্ত্রকের কাছে রয়েছে।” সাধারণ নির্বাচনের কারণে ফেব্রুয়ারির পর থেকে বোর্ডের কোনো সভা অনুষ্ঠিত হয়নি।
ইতিমধ্যে, বর্তমান এসটিআর-এর জেলেরা অনেক সমস্যায় পড়েছে। একবার এসটিআর-এ সঙ্গে তিনটি রেঞ্জ যুক্ত হলে, হাজার হাজার জেলেদের জীবিকা, প্রভাবিত হবে বলে মনে করছেন তারা। তাদের জীবিকাকে সরাসরি প্রভাবিত করে এমন পদক্ষেপ নেওয়ার আগে মৎস্যজীবিদের সাথে কোনও আলোচনা হয়নি। দক্ষিণ বঙ্গ মৎস্যজীবি ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিলন দাস বলেন, ‘আমরা এর সম্পূর্ণ বিরোধিতা করি’।
পরিসংখ্যান অনুসারে সুন্দরবনে, এবার বাঘের সংখ্যা একেবারে সেঞ্চুরি পার করেছে। হয়েছে ১০১। এই তথ্য দিয়েছেন বনপ্রতিমন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদা। মন্ত্রী জানান, গত ২০১০ সালে রাজ্যে বাঘের সংখ্যা ছিল ৭৪টি। সেই সংখ্যা ২০১৪ সালে বেড়ে হয়েছিল ৭৬। তার পরে ২০১৮ সালে আরও বেড়ে বাঘের সংখ্যা হয়েছিল ৮৮টি। ২০২২ সালের সর্বশেষ হিসেবে দেখা গিয়েছে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা হয়েছে ১০১টি।
ওয়াইল্ড লাইফ বোর্ডের মিটিংয়ে সুন্দরবন সম্প্রসারণের প্রস্তাবটা রেখে ছিলেন বাঘ বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ রায় চৌধুরী। কথা হচ্ছিল,রাজ্য বন্যপ্রাণী বোর্ডের সদস্য বিশ্বজিৎ রায় চৌধুরীর সঙ্গে। তাঁর কথায়, “২০২৩ সালের বাঘশুমারি অনুসারে, এসটিআর অর্থাৎ বর্তমান সুন্দরবন টাইগার প্রজেক্ট এলাকায় প্রায় ৮০টি বাঘ রয়েছে। এসটিআর-এর বাইরে দক্ষিণ ২৪-পরগনা বনাঞ্চলে প্রায় ২১টি বাঘ রয়েছে। সুন্দরবনে মোট আনুমানিক ১০১ বাঘের সংখ্যা”।
তাঁর মতে, “সুন্দরবন টাইগার প্রজেক্টের সম্প্রসারণ হলে, আমরা আশা করি যে উন্নত ব্যবস্থাপনার সাথে বাঘের সংখ্যা বাড়তে পারে। কারণ বাঘ-সংরক্ষিত অঞ্চলে শূন্য পদগুলো পূরণ করতে হবে এবং বন এলাকায় আরও ভাল টহল দিতে পারা যাবে। সবাই তো বলছে সুন্দরবনের বাঘ পর্যাপ্ত হয়ে গেছে। সুন্দরবনের ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। এটা মূলত অনেক দিন ধরেই ওয়াইল্ড লাইফ ইন্সটিটিউট বলছিল। যদি ১০১ সংখ্যাটাকে আমরা ঠিক ধরি, তাহলে সত্যিই তাই, সুন্দরবন ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা যা দেখানো হচ্ছে তার থেকে একটু বেশিই হবে। কারণ, সব বাঘ তো আর ক্যামেরা ট্র্যাপে ধরা পড়ে না। আর আমরাও সব বাঘের হদিসও পাই না। কিছু বাঘ যা দেখা যায় তার বাইরেও থাকে। সুতরাং সুন্দরবনের ধারণ ক্ষমতা যা বাঘ তার থেকে বেশি হয়ে যাচ্ছিল। দক্ষিণ ২৪ পরগনা ফরেস্ট ডিভিশনে বাঘের যাতায়াত রয়েছে। সেই জন্য ওয়াইল্ড লাইফ বোর্ডের মিটিংয়ে একটা প্রস্তাব রাখা হয়েছিল, যে দক্ষিণ ২৪ পরগনা ফরেস্ট ডিভিশনে যতগুলো ব্লক আছে তার মধ্যে রামগঙ্গা পর্যন্ত বাঘ যাতায়াত করে। যদি ‘টাইগার প্রজেক্ট’-এর মধ্যে এই অঞ্চলগুলোকে আনা যায় তাহলে বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র বাড়ে। আর এই যে প্রশ্নটা, বাঘ সুন্দরবনের ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে, সেই প্রশ্নটাও উঠে না।”
বিশ্বজিৎবাবু জানান,” ‘ন্যাশনাল টাইগার অথরিটি’ পারমিশন দিয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ওই অঞ্চলগুলো কতদূর পর্যন্ত ‘টাইগার প্রজেক্ট’-এর আওতায় আনা হবে তা নিয়ে এখন সার্ভে হচ্ছে। পুরো ২৪ পরগনাকে নিয়ে তো লাভ নেই কারণ সেখানে বহু মানুষের বাস। তাই যতটুকু নেওয়া সম্ভব। কুলতলীর মত ব্লকগুলো ‘টাইগার প্রজেক্ট’-এর মধ্যে ঢোকানো যায় কিনা সেটা দেখা হচ্ছে। সার্ভে করা হচ্ছে কতখানি নেওয়া যায়। এখনো পর্যন্ত এই পর্যায়েই রয়েছে।”
তাঁর মতে,”সুন্দরবনের যা থাকার কথা তার থেকে বনকর্মী অনেক কম। ‘টাইগার প্রজেক্ট’ বাড়াতে গেলে কর্মী বাড়াতেই হবে। এমনিতেই সুন্দরবনের কর্মীদের যা এ্যলোটেট পোস্ট রয়েছে, তা ভালো সংখ্যাতেই খালি আছে। সেখানে ফরেস্ট গার্ড বা বন শ্রমিক না বাড়ালে পেট্রলিং হবে না ঠিকমত। সুন্দরবনে নিরাপত্তার অভাব। এই নিরাপত্তার অভাবটাকে তো আগে বিলুপ্ত করতে হবে। যে মানুষগুলো পেট্রোল করছে, তারা যদি ভয় পেয়ে থাকে, তাদের সিকিউরিটি না দেখলে তারা তো কাজে উৎসাহ পাবেনা। সেটাও করতে হবে। পাশাপাশি নাম্বার অফ স্টাফ বাড়াতে হবে।”
তিনি জানান, বাংলাদেশের দিক থেকে নিয়মিতভাবে অনুপ্রবেশকারীরা সুন্দরবনে ঢুকছে। প্রচুর মধু হরিণ এসব মেরে নিয়ে যাচ্ছে। বাঘ মারে না হয়তো। অন্যান্য পশু পাখি তো মারছে। তাই সিকিউরিটি খুব বাড়ানোর দরকার। তার জন্য স্টাফও বাড়ানো দরকার। স্পেশাল ফরেস্ট গার্ড এবং বনশ্রমিক এই দুটো পোস্টে। আমার মনে হয় এদের হাতে একটু বেটার আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়া উচিত। যারা পেট্রোলিং করে, তারা একেবারে সেই মানধাতা আমলের বন্দুক ধরে রয়েছে। একটু বেটার অস্ত্র পেলে তারা আরেকটু বেটার টহলদারি চালাতে পারে। এটা উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রেও তাই। উত্তরবঙ্গে তো আমার ক্যামেরা ট্র্যাপে ছবি ধরা আছে চোরা শিকারিরা ঘুরছে একে-ফর্টি সেভেন নিয়ে। সুন্দরবনে সেসব নেই। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যারা ঢোকে অনুপ্রবেশকারীরা তাদের হাতে কিন্তু আমাদের ফরেস্ট গার্ডদের থেকে অনেক উন্নত আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। এটাকে আটকাতেই হবে।”
ফলে, আর কয়েক মাসের মধ্যে সুন্দরবন হতে চলেছে দেশের সবচেয়ে বড় ‘টাইগার প্রজেক্ট’।