• facebook
  • twitter
Sunday, 8 September, 2024

সুন্দরবনেও বইমেলা হয়

সমরশে মণ্ডল কেন এই জঙ্গলের অতি নিকটে সুন্দরবন বইমেলার আয়োজন? লেখাটা শুরু করার ইচ্ছে হল একটি প্রশ্ন দিয়ে৷ সরল নিবেদন, তবুও ঔদ্ধত্যের মতো শোনাবে৷ পল্লীর সমাজবদ্ধ মানুষ অনেক কিছু নিয়ে বাঁচতে চায়৷ সেজন্য একত্রিত হয়ে তাঁরা উপলব্ধি করে সমাজকে কিছু সাধ্যমতো ফেরত দেওয়ার৷ একক মানুষ অনেক কিছু করতে পারে না৷ সেই তাগিদ থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউলিওলজি

symbolic image

সমরশে মণ্ডল

কেন এই জঙ্গলের অতি নিকটে সুন্দরবন বইমেলার আয়োজন? লেখাটা শুরু করার ইচ্ছে হল একটি প্রশ্ন দিয়ে৷ সরল নিবেদন, তবুও ঔদ্ধত্যের মতো শোনাবে৷ পল্লীর সমাজবদ্ধ মানুষ অনেক কিছু নিয়ে বাঁচতে চায়৷ সেজন্য একত্রিত হয়ে তাঁরা উপলব্ধি করে সমাজকে কিছু সাধ্যমতো ফেরত দেওয়ার৷ একক মানুষ অনেক কিছু করতে পারে না৷ সেই তাগিদ থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউলিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সঞ্জিত জোতদার ভাবনা শুরু করেন, নদীঘেরা জল-জঙ্গল পরিবেষ্টিত সুন্দরবনে বইমেলা আয়োজনের৷ সঙ্গে জুটে যান আরও অনেক সক্রিয় মানুষ৷ তাঁরা কেউ কেউ এই দ্বীপগুলো থেকে উঠে এসেছেন, স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন৷ আবার এদের সঙ্গে জুটে গেছেন এলাকার বয়ঃজ্যেষ্ঠ মানুষেরা যাঁরা মাথার উপর আশীর্বাদ স্বরূপ হাত রেখেছেন৷ বয়সের ভারে নু্যব্জ হলেও একটা মেলাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে অল্পবয়সীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সহযোগিতা করেছেন৷ এই বইমেলা শুরু হয় প্রথম ২০২২ সালে ভারতীয় সুন্দরবনের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার অন্তর্গত গোসাবা ব্লকের একটি ঐতিহ্যবাহী দ্বীপ ছোটোমোল্লাখালির মঙ্গলচন্দ্র বিদ্যাপীঠের ক্রীপ্রাঙ্গণে (২৫-২৮ মার্চ)৷ মেলার উদ্বোধন করেন সাহিত্যিক সাধন চট্টোপাধ্যায়৷

যে কথাটা বেশি করে বলার তা হল এই যে বহু কৃতি প্রাক্তনী যারা সকলে জীবনে জীবন যোগ করার অদম্য ইচ্ছে ও আত্মপ্রত্যয় নিয়ে বইমেলার মতো একটা স্বতন্ত্র উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, তা এককথায় জন্মভূমির প্রতি নাড়ির টানে৷ গোটা সমাজ ব্যবস্থার পাশাপাশি সুন্দরবনের জনসমাজও আজ ক্ষয়িষ্ণু, মূল্যবোধহীন, প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে অস্তিত্বের সঙ্কটে দীর্ন-বিদীর্ণ হয়ে শিকড়বিহীন হয়ে পড়েছে৷ সুন্দরবনের মানুষের যে একটি নিজস্ব চিরাচরিত লোকসংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রবহমান ধারা আছে, সেকথা নয়া প্রজন্ম ভুলতে বসেছে. এই ঐতিহ্যের পরম্পরা ও সাংস্কৃতিক চরিত্র যদি বোঝাতে হয় তবে বইমেলার মত উদ্যোগ সব থেকে কার্যকরী প্রচেষ্টা এটা যে একেবারে অভ্যন্তরীন ব্যাপার তা সবাইকে সহজ ও পরিস্কার করে বুঝিয়ে বলা কঠিন. সহজ করে বলা কথাগুলো উপলব্ধি ক্ষমতার সঙ্গে খানিকটা মিলে গেলে বাক্যের সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক স্থাপিত হবে৷ তখনই বইমেলার আয়োজনের সার্থকতা বিষয়ে সুন্দরবনবাসীর আত্ম উন্মোচনের একটা গভীর সংযোগ উপলব্ধ হবে৷

এ বছর সাফল্য-ব্যর্থতা মিলিয়ে সুন্দরবন বইমেলা তৃতীয় বর্ষ সম্পন্ন করেছে৷ কলকাতা শহর থেকে বহু যোজন দূরে সারসা নদীর তীরবর্তী সুন্দরবনের প্রান্তিক জনপদে বছরের পর বছর বইমেলার আয়োজন করা এবং চালিয়ে নিয়ে যাওয়া রীতিমতো দুরুহ ও চ্যালেঞ্জের কাজ৷ বইমেলার মতো অন্যান্য ভাবনা-চিন্তা উঠে এসেছে পল্লীর জনগোষ্ঠীর ভেতর থেকে৷ বইমেলাকে অবলম্বন করে আন্দোলিত হয়েছে দ্বীপের নতুন প্রজন্মের উৎসাহ-উদ্দীপনা, সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ও ভালোবাসা অঞ্চলের অজস্র কবি, লেখক ও গবেষকদের মিলনক্ষেত্র৷ গ্রামের মানুষ বাইমেলার আয়োজন দেখে খুশি হয়েছেন৷ বই তাঁরা হাতে তুলে নিয়ে উলটে পালটে দেখার সুযোগ পেয়েছেন৷ এমনকি অাঁতিপাঁতি করে পড়ারও চেষ্টা করেছেন৷ এঁরা সকলেই এখানকার অতি সাধারণ মানুষ৷ কেউ বা খেয়া মাঝি, ভ্যান চালক, জেলে, কাঠুরে, বাউলে-মউলেরা৷ মেলা কমিটির থিঙ্ক ট্যাঙ্কের শুভ চিন্তা ও উদ্যোগের সফল প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন ঘটেছে৷

গুনীজন ও কৃতি সন্তানদের পাশাপাশি সংবর্ধিত হয়েছেন খেয়ামাঝি ও মৎস্যজীবী মানুষ৷ এমন ব্যতিক্রমী চিন্তা সুন্দরবন বইমেলা ব্যতীত অন্যত্র তেমন চোখে পড়েনি৷ এই মেলায় বিভিন্ন দ্বীপ থেকে আগত বহু মানুষ কলকাতা বইমেলা চাক্ষুষ করেননি৷ অনেকেই করুনাময়ীর কাছে সেন্টাল পার্কের বইমেলায় যাননি৷ এখানকার জনজীবনের অধিকাংশ নিম্মবর্গের মানুষ যাঁরা জীবন অতিবাহিত করেন মাছ-কাঁকড়া ধরে, ভ্যান টেনে, নদীতে জাল টেনে, মধু ভেঙ্গে. এমনকি বহু মানুষ আছেন যারা পরিযায়ী শ্রমিক৷ কাজের জন্য ভিন রাজ্যে যান৷ সেকারণে দ্বীপবাসীর নাগালের মধ্যে ঘরে কাছে এই বইমেলা হাজার টানাটানির সংসারে এক টুকরো রূপোলি চাঁদের মত আশার আলো৷

তাই নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন অভাবী ঘরের ছাত্রছাত্রীদের কাছে এই ঘটনাটি করা ও অবিরাম গ্রন্থপাঠের আনন্দ, আবেগ, পুস্তক প্রীতি জাগিয়ে তোলার একটা শুভ প্রচেষ্টা মাত্র৷ অনেকেই হয়তো বলবেন প্রযুক্তির অতি উন্নতির যুগে গ্রামের প্রথম প্রজন্মের স্কুল-পড়ুয়ারা বইপড়া থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে৷ একথা যেমন অসত্য নয়, ঠিক তেমনি শহরের অর্থবান ঘরের পড়ুয়ারা বইপড়া থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে৷ একথা যেমন অসত্য নয়, ঠিক তেমনি শহরের অর্থবান ঘরের পড়ুয়ারাও ব্যাতিক্রম নয়৷ শিক্ষিত হলেও সাহিত্য পড়বেন, সাহিত্য অনুরাগী হবেন, একথা আজ আর বলা সম্ভব নয়. এজন্য ‘কালচারাল ক্যাপিটাল’ লাগে এই আপ্তবাক্যটি স্মরণে রেখে রাজধানী থেকে বহু মাইল দূরে এক অজ পাড়াগাঁয়ে সুন্দরবন বইমেলার আয়োজন৷

সুন্দরবন বইমেলা ২০২৩-এর স্মরণিকা গ্রন্থটির নামকরণ করা হয়েছে ‘পলিমাটি’৷ ‘পলিমাটি’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো নদী ও সমুদ্রের ধারে পলি জমার ফলে গঠিত নতুন ভূমি৷ তাৎপর্যপূুর্ণ ভাবে এই স্মারক গ্রন্থের নামকরণ ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে অর্থপূর্ণ৷ এই তথ্যবহুল সংকলনটি বহু গুনী মানুষ ও গবেষকদের লেখায় সমৃদ্ধ যা ভবিষ্যতের পাঠক ও গবেষকদের কাছে উল্লেখযোগ্য আকর গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে বলে আমার মনে হয়৷ আমাদের পশ্চিমবঙ্গে সাহিত্য সংস্কৃতির আকাশে সুন্দরবন বইমেলা একটি উজ্জ্বল সংযোজন নানান ঘটনার প্রেক্ষিতে আমরা অনেকেই জানি কলকাতা বইমেলা একবার আগুনে ভষ্মীভূত হয়েছিল৷ তখন মেলা হোত কলকাতা ময়দানে৷ একইভাবে যে সুন্দরবনের একটি দ্বীপে বইমেলার আয়োজন হচ্ছে, সে দ্বীপ বহুবার বন্যা, ঝড়ের প্রকোপে বানভাসি হয়েছে৷ তখন কত শত বই বন্যার জলে ভেসে যাওয়ার হিসেব রাখিনি, সার্ভেও করিনি৷ কেবলমাত্র আমরা সার্ভে করেছি কত ধান গেল, চাল গেল, কত বাড়ি ভেঙে পড়লো, কত জমির ফসল নষ্ট হলো৷ নষ্ট হয়ে যাওয়া বই এবং পত্রপত্রিকার সন্ধান দ্বীপের সব হারানো মানুষ খোঁজ রাখেনি৷ আয়লা আমফানের পর দ্বীপের মানুষের কাছে গর্বের বিষয় বলে চিহ্নিত হোত যে গ্রামীন পাবলিক লাইব্রেরিগুলো, সেগুলো ক্রমশ আজ ধ্বংসের মুখোমুখি৷