• facebook
  • twitter
Wednesday, 22 January, 2025

স্বামীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত সুভাষ

আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন ছাত্রমহলে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সাহিত্যের খুব প্রচার ছিল। আজকাল নাকি তরুণ সমাজের মধ্যে ওই সাহিত্যের তেমন প্রচার নাই।

ফাইল চিত্র

শিব শঙ্কর দাস

স্বামী বিবেকানন্দ সম্বন্ধে বলতে গেলে নেতাজি সুভাষ বলেছেন আমি আত্মহারা হয়ে যাই। এইরকমের বলিষ্ঠ মানুষ বাঙালির মনকে যেরূপ আকৃষ্ট করে এমন আর কেউ করে না। ত্যাগে বেহিসেবী, কর্মে বিড়ামহীন, প্রেমে সীমাহীন। স্বামীজির জ্ঞান ছিল যেমন গভীর তেমনই বহুমুখী। বোধ হয় স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং একথা নিজ জীবনেই উপলব্ধি করেছিলেন – না হলে মহাপ্রয়ানের পূর্বে তিনি কেনবলে গেলেন ‘বিবেকানন্দ যে কী করে গেলেন আরেক বিবেকানন্দ থাকলে তা বুঝতে পারতেন।’ তবে স্বামীজির দেহত্যাগের আগেই আর এক অন্য বিবেকান্দ জন্ম গ্রহণ করেন এবং যিনি মনে প্রাণে স্বামীজি যা করতে চেয়েছেন বলতে চেয়েছেন বোঝাতে চেয়েছেন তাই করতেই সর্বদা যত্নবান ছিলেন। বীর সন্ন্যাসীর আলোকে উদ্ভাসিত এই দেশনায়ক হলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী নেতা তথা সর্বজন শ্রদ্ধেয় দেশনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র যিনি বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক রূপে বিশ্ব ইতিহাসে বিরাজ করেছেন এবং যতদিন চন্দ্র-সূর্য পৃথিবী গ্রহ থাকবে ততদিন স্বর্ণাক্ষরে সকলের হৃদয়ে বিরাজ করবেন।

১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি যুগশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম এবং ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি বরেণ্য মহান দেশপ্রেমিক সুভাষচন্দ্র বসু জন্মগ্রহণ করেছিলেন। স্বামীজি যখন ‘আমার সমরনীতি’ বলে মাদ্রাজে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন, সেই সময়েই আগে-পরে নেতাজীর জন্ম হয়। স্বামীজীর ভাবনার ফসল হলেন নেতাজি সুভাষ । তাই দেখা যায়, ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে ১৯৪৫ সালে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনার সময়ে নেতাজির নিখোঁজ হওয়া পর্যন্ত স্বামীজির চিন্তা-ভাবনাই নেতাজিকে পরিচালিত করেছিল। সুভাষচন্দ্র ছিলেন আজীবন সংগ্রামী,অক্লান্ত পরিশ্রমী, সীমাহীন মানবপ্রেম, অসীম ব্যক্তিত্ব, দুর্জয় সাহস ও অসাধারণ দেশপ্রেমের প্রতীকস্বরূপ। তাঁর মতো দেশনেতা পৃথিবীর সর্বদেশ, সর্বকালে বিরল ঘটনা। জীবনের শেষদিকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর পতনের পর তার সর্বাধিনায়ক হিসেবে অত্যন্ত দুঃখ-বেদনা ও আঘাতে জর্জরিত হলেও কিন্তু নেতাজির মানসিক প্রশান্তি ও আত্মিক দৃঢ়তা কখনও নষ্ট হয়নি। ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভয়ংকর যুদ্ধের মাটিতে দাঁড়িয়েও তাঁর অবিচল সাহস, দুর্জয় মানসিক শক্তি ও উচ্চ মূল্যবোধ-ভিত্তিক কথাবার্তা তথা দেশপ্রেমের আবেগ বিশ্বের সকল দেশের মানুষের কাছে চিরকাল শিক্ষণীয়। কিন্তু কোথায় পেলেন তিনি এমন মহা-মনীষা – যা পার্থিব চেতনার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে তাঁকে আত্মলোকের সীমাহীন রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছিল? এই প্রসঙ্গে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দেন – তা পেয়েছেন রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের জীবন ও দর্শন থেকে, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের জীবনের দীপ্ত আলোকেই তাঁকে ‘নেতাজী সুভাষ’-এ পরিণত করেছিল। তাঁর ভাষায় – ‘জীবনের প্রতি পদে যেসব দ্বিধা, যেসব সংশয় মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলতো, সুচিন্তিত একটি জীবনদর্শন ছাড়া আর কিছুতেই তাদের জয় করা সম্ভব ছিল না। বিবেকানন্দ এবং রামকৃষ্ণ আমাকে এইরকম একটি আদর্শের সন্ধান দিলেন। এই আদর্শকে জীবনে মূলমন্ত্র হিসাবে গ্রহণ করার ফলে বহু সমস্যা, বহু সংকট আমি সহজেই পার হয়ে এসেছি।”

বস্তুত, অমৃতপুত্র নেতাজি রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের কথা বলতে গিয়ে যেন পাগল হয়ে উঠতেন। স্বামীজির মতোই তিনি ভারতের অতীত সম্পদ নিয়ে সর্বদা গর্ববোধ করতেন এবং দেশের যুবসমাজ ও যুবশক্তির উপর গভীর আস্থাবোধ পোষণ করতেন। তাই নেতাজির চিন্তা, পরিকল্পনা ও কর্মের মধ্যে স্বামীজির বাণী ও রচনাবলী যে নেপথ্যে সর্বদা ক্রিয়া করত তা অতি সহজেই লক্ষ্য করা যায়। আর নেতাজি যে সর্বদা স্বমীজির রচনাবলী পড়তেন, অনুধ্যান করতেন ও সেই উপযোগী কর্ম করতে চাইতেন তা বলাবাহুল্য। তবে নেতাজি তাঁর সমসাময়িক কালের যুবকদের মানসিক অধোগতি ও চারিত্রিক অবনতির কথাও জানতেন। একটি সভায় এই প্রসঙ্গে তাই তিনি বলেছিলেন, “আজকালকার জনসাধারণের মধ্যে এবং বিশেষ করিয়া তরুণ সমাজের মধ্যে একপ্রকার লঘুতা ও বিলাসপ্রিয়তা যেন প্রবেশ করিয়াছে।

আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন ছাত্রমহলে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সাহিত্যের খুব প্রচার ছিল। আজকাল নাকি তরুণ সমাজের মধ্যে ওই সাহিত্যের তেমন প্রচার নাই। তার পরিবর্তে নাকি লঘুতাপূর্ণ এবং সময়ে সময়ে অশ্লীতাপূর্ণ সাহিত্যের খুব প্রচার হইয়াছে। একথা কি সত্য? যদি সত্য হয় তা হইলে ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, কারণ মনুষ্য সমাজ যেরূপ সাহিত্যের দ্বারা পরিপুষ্ট হয় তার মনোবৃত্তি তদ্রূপ গড়িয়া ওঠে। চরিত্র গঠনের জন্য রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সাহিত্য অপেক্ষা উৎকৃষ্ট সাহিত্য আমি কল্পনা করতে পারি না।

তিনি জীবনের শেষপর্বে ও স্বামীজির কর্মের মহান আদর্শ আলোকোজ্জ্বল ত্যাগ ও সুগভীর দেশপ্রেম সুভাষচন্দ্রের মধ্যে জ্বলন্ত আত্মবিশ্বাস ও দীপ্ত প্রেরণা হয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছিল।