ওড়িশার গৌরব খালিচোখে নির্ভুল জ্যোতির্বিজ্ঞানী পাঠানী সামন্ত

ধর্ম ও দর্শন বিষয়ে বিশ্বের কাছে ভারতবাসীর অপরিমেয় দান সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু আধ্যাত্মজগতের প্রতি লক্ষ্য দিতে গিয়ে বহির্বিশ্বকেও তাঁরা উপেক্ষা করেননি। ব্যবহারিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতীয় মনস্বিগন যে সব অমূল্য আবিষ্কার করেছিলেন আজ সেগুলি বিশ্বসংস্কৃতির উপকরণ হিসাবে সর্বমানবের সম্পত্তি । প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা আর্যভট্টের সমসাময়িক কাল থেকে দ্বিতীয় ভাস্করাচার্যের সময় পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারায় বিশেষভাবে গড়ে উঠেছিল। এই সময়কে বলা চলে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার স্বর্ণযুগ।

আর্যভট্টকে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের পথিকৃৎ ও প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়। ওড়িশার চন্দ্রশেখর (পাঠানী সামন্ত) অতীত ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। দেশ বিদেশে তার এই কাজের স্বীকৃতি মিলে ছিল। আর সমগ্র বিজ্ঞানশাস্ত্রের ভূমিকা এই জ্যোতির্বিজ্ঞান। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের চিন্তায় যে ক্ষুরধার সূক্ষ্মতা ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন গ্রন্থে তার পরিচয় পাওয়া যায়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর সামন্ত ওড়িশার নয়াগড় জেলার খণ্ডপাড়ায় এক অখ্যাত জনপদে ১৩ই ডিসেম্বর ১৮৩৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সামন্ত শ্যামবন্ধু এবং মাতা বিষ্ণুমালী। শ্যামবন্ধুর তিন সন্তান শৈশবে মারা গেলে পুত্র চন্দ্রশেখরের নাম রাখেন ‘পাঠানী সামন্ত’। তার পুরো নাম মহামহোপাধ্যায় চন্দ্রশেখর সিংহ হরিচন্দন মহাপাত্র সামন্ত। পাঠানী সামন্তের প্রথম শিক্ষা শুরু হয় ওড়িয়া পাঠশালায়। সংস্কৃত শিখেছিলেন এক ব্রাহ্মণের কাছে। এছাড়া সংস্কৃত-ব্যাকরণ, স্মৃতি, পুরাণ, দর্শণ এবং নানা কাব্যগ্রন্থ পাঠ করেন। পরে কাকার কাছ থেকে মাত্র দশ বছর বয়সে জ্যোতির্বিদ্যা এবং আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি শিখতে শুরু করেন। তখন জ্যোতিষশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। চন্দ্রশেখর ১৫বছর বয়স পর্যন্ত রয়্যাল লাইব্রেরিতে পাওয়া বইগুলি পড়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন স্ব-শিক্ষিত জ্যোতির্বিদ। জ্যোতিষ শিখতে গিয়ে তাঁকে জ্যোতিষ সম্পর্কে ধারণা করতে হয়। সে কারণে তাঁকে সূর্যসিদ্ধান্ত পড়তে হয়। “ He was now able to compute the process of planets, and wanted to test the accuracy of the calculation by observation . He constructed a few simple instruments as described in the Siddhanta and took observations of stars and planets”. তিনি ধরে ফেলেন ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’-র ভুল। পর্যবেক্ষনের ফলাফল তিনি তাঁর ‘সিদ্ধান্ত দর্পণ’-এ লিখে রাখেন যে সিদ্ধান্ত বর্নিত অবস্থান থেকে তারারা বেশ কয়েক ডিগ্রি দূরে আছে। মাত্র তিরিশ বছর বয়সে এর প্রথম খণ্ড তিনি রচনা করেন। পরের কুড়ি বছর তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যান।

সেই সময় ভারতে বিশেষ করে ওড়িশায় জ্যোতিবির্দ্যা গবেষণার জন্য কোনো টেলিস্কোপ এবং অন্যান্য যন্ত্র ছিল না। ১৮৯৩এ চন্দ্রশেখরের বয়স ৫৭ বছর। তিনি বাঁশের দূরবীন দিয়ে আকাশের গ্রহ নক্ষত্রের পার্থক্য কত ডিগ্রি তা নির্ণয় করে দিতে পারতেন–“Without the aid of modern accurate astronomical instruments and living in a remote corner of Orissa, –“ অথচ তিনি ইংরেজি জানতেন না। তাঁর বিদেশি ধারণার সঙ্গে পরিচয় ছিল না । পরিমাপের যন্ত্র তৈরি করে সারাদিন ছায়ার দৈর্ঘ্য পরিমাপ করতেন। সূর্য গ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে তার দ্বারা করা গণনায় প্রাপ্ত নির্ভুলতা অসাধারণ বলে মনে হয় । প্রাপ্ত নির্ভুলতা সেই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দ্বারা যন্ত্রের সাহয্যে তৈরি করা প্রায় একই রকম ছিল। তাঁর প্রচেষ্টাকে প্রায়শই ভারতের অন্যান্য মহান জ্যোতির্বিজ্ঞানী যেমন আর্যভট, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত এবং আরও অনেকের সাথে তুলনা করা হয়। চন্দ্রশেখরই একমাত্র ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী যিনি ইউরোপীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের থেকে স্বাধীনভাবে চাঁদের তিনটি অনিয়ম আবিষ্কার করেছিলেন, যা প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে ছিল অজানা।


চন্দ্রশেখরের গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণগুলি তার ‘সিদ্ধান্ত দর্পন’ নামে বইতে সংকলিত হয়েছে। এটি ওড়িয়া ও সংস্কৃত লিপিতে লেখা। তাঁর মূল পাণ্ডুলিপিতে ২৫০০ টি শ্লোক রয়েছে। সেই সময় বাংলার বাঁকুড়া জেলার যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি রেভেনশা কলেজে চাকরির সূত্রে দীর্ঘ ত্রিশ বছর স্থায়ীভাবে ওড়িশাবাসী হয়েছিলেন (১৮৮৯-১৯১৯)। প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার অমূল্য ভাঁড়ারটি সন্ধান তিনি পেলেন ওড়িশায় গিয়ে । এতকাল তাঁর ধারণা ছিল আমাদের সংস্কৃত জ্যোতিষশাস্ত্রের তেমন কোনও গুরুত্ব নেই। দ্বিতীয়বার কটকবাসে তাঁর সেই ধারণা পাল্টে যায়। এই পর্বে তাঁর জীবনের স্মরণীয় ঘটনা হল ওড়িয়া জ্যোতির্বিদ চন্দ্রশেখরকে আবিষ্কার। চন্দ্রশেখরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াকে তিনি তাঁর জীবনের ‘দৈবক্রম’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই সময় একটানা বারো বছর যোগেশচন্দ্র জ্যোতিষচর্চা করেছেন এবং প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যায় মগ্ন থেকেছেন। ওড়িয়া সাহিত্যিক ফকিরমোহন সেনাপতি (১৮৪৩-১৯১৮) একটি কবিতার মাধ্যমে যোগেশচন্দ্রকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তিনি লেখেন-
বনর মালতী পরি পঠানী সামন্তে
সোঢুথিলে যোগেশ তা চিহ্নিলে কেমন্তে।।
চিহ্নিন চিহ্নাই দেলে জগৎ মধ্যর
জুহার যোগেশ ভাই জুহার জুহার।।
এর অর্থ, পণ্ডিতপ্রবর পঠানী সামন্ত বনের মালতী ফুলের মতো ফুটেছিলেন। হে যোগেশ! তুমি তাঁকে কেমন করে চিনলে? তুমি নিজে শুধু তার রস আস্বাদন করনি, সমগ্র জাতিকেও সেই বিমল পাণ্ডিত্যের সুধা পান করিয়েছ। হে যোগেশভাই, তোমাকে নমস্কার, বারবার তোমাকে নমস্কার।

চন্দ্রশেখরের সঙ্গে যোগেশচন্দ্রের সাক্ষাৎকারের ঘটনা ছিল বেশ চিত্তাকর্ষক। ১৮৯৩ সালে কলকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন কটকে আসেন পঞ্জিকা সংস্কারের কাজে। ন্যায়রত্ন মহাশয় আগাম তথ্যের ভিত্তিতে যেতে চান খণ্ডপাড়ায় এবং সাক্ষাৎকার নিতে চান পাঠানি সামন্তের । কিন্তু কাজটি সহজ ছিল না। কারণ সেই জ্যোতিষীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে করদ রাজ্য খণ্ডপাড়ার রাজার অনুমতি প্রয়োজন। অনুমতি এল আর সেই অনুমতি ক্রমে পাঠানি সামন্তকে কটকে আনা হল। সেখানেই যোগেশচন্দ্র রায় প্রথম তাঁকে দর্শন করেন। তিনি বলেন— “One Saturday evening in February 1893, I met the Mahamohopadhyaya at friend’s house for the first time.” সেখানে দেখলেন এক মুণ্ডিত মস্তক বৃদ্ধ, সাধারণ ধূতি জামা পরা ও গায়ে তাঁর চাদর। সেই চাদর কমদামী, নীল রঙে ছোপ লেগে অতিমাত্রায় রঞ্জিত। ইনি জ্যোতির্বিদ চন্দ্রশেখর।

এ হেন জ্যোতির্বিদ চন্দ্রশেখরকে দেশের বাইরে পরিচিত করার মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি। মহেশচন্দ্রের অনুরোধে যোগেশচন্দ্র ‘সিদ্ধান্ত দর্পণ’ প্রকাশে হাত দেন। ১৮৯৯ সালে তাঁর সম্পাদনায় এবং আটমালিক ও ময়ূরভঞ্জের রাজাদের আর্থিক সহায়তায় কলকাতা থেকে দেবনাগরী লিপিতে ‘সিদ্ধান্ত দর্পন’ প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ৫৬ পৃষ্ঠা অধ্যাপক রায় ইংরেজীতে অনুবাদ করেন । অক্সফোর্ড থেকে প্রফেসর ম্যাক্সমুলার (১২ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯) যোগেশচন্দ্রকে এক চিঠিতে লিখলেন “ If the case is as you state in your preface, I have little doubt that the present Viceroy will feel inclined to sanction some grant to that unselfish student. ” ১৯০৪ সালের এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ ভারত সরকার চন্দ্রশেখরকে মাসিক পঞ্চাশ টাকা ভাতা অনুমোদন করেন সাহায্য স্বরূপ । ‘সিদ্ধান্ত দর্পণ’ এর বিশ্বজুড়ে প্রশংসা হল। ‘Nature ’পত্রিকা লিখলেন – Prof. Ray compares the author to Tycho, but we should imagine him a great then Tycho (9-3-1899)”. Knowledge (Nov, 1899) পত্রিকা পিছিয়ে থাকলে না । এই পত্রিকার অভিমত জ্যোতির্বিদ্যার ওপর অসংখ্য কাজের মধ্যে এই কাজ এখনও পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ এবং অনেক নতুন দিক নির্দেশক । ‘Modern Tycho’ এই শিরোনামে ‘Knowledge’ এ এক প্রবন্ধ লিখলেন- E. Walter Maunder, FRAS । এই প্রবন্ধটি পরবর্তীকালে সংকলিত হয় ‘Astronomy without a Telescope’ (১৯০২) গ্রন্থে । মতিলাল ঘোষও অমৃতবাজার পত্রিকায় চন্দ্রশেখরকে নিয়ে এক সম্পাদকীয় লেখেন।

এইভাবে চন্দ্রশেখরকে যেমন যোগেশচন্দ্র রায় বিশ্বের দরবারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তেমনি যোগেশচন্দ্রের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন চন্দ্রশেখর । এই কাজের সূত্রে Royal Microscopical Society ১৯০১ সালে এবং লণ্ডনের Royal Astronomical Society ১৯০২ সালে যোগেশচন্দ্রকে Fellow নির্বাচিত করে। ‘নব্যভারত’ পত্রিকায় পঞ্জিকা সংস্কার ও মান মন্দির স্থাপনে যোগেশচন্দ্র বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখেন। পঞ্জিকা সংস্কার ও মান মন্দির স্থাপন যোগেশচন্দ্রের আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে। তিনি বাংলাদেশে মানমন্দির প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা প্রচার করেছিলেন। সেই সময় ওড়িশার করদ রাজ্যের রাজাদের মানমন্দির ছিল। জ্যোতিষচর্চা করতে গিয়ে যোগেশচন্দ্র বাংলা ভাষায় জ্যোতিষিক-পরিভাষা প্রণয়ন করেন। হিন্দু জ্যোতিষ ও জ্যোতিষিদের বিবরণ রচনা তাঁর স্মরণীয় কীর্তি। তিনি মহাভারতে যুধিষ্ঠিরের আবির্ভাবকাল নির্ণয় করেছেন জ্যোতিষ গণনার সাহায্যে। ‘ভারতী’ পত্রিকায় (১৩০১) লিখেছেন ‘হিন্দু জ্যোতিষীগণের বিবরণ’। বাংলা রামায়নের প্রসিদ্ধ কবি কৃত্তিবাসের জন্ম-সন নির্ণয় করেছেন। তিনি ওড়িশায় একটানা ১২ বছর জ্যোতিষ চর্চা করেছিলেন। তার ফল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Astronomical Land marks in Indian Antiquity’। চন্দ্রশেখরকে নিয়ে ‘নব্যভারত’ পত্রিকাতেই যোগেশচন্দ্র প্রথম লিখেছিলেন। ১৯০৩ সালে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আমাদের জ্যোতিষী ও জ্যোতিষ’ প্রথমভাগ প্রকাশিত হয়।

চন্দ্রশেখর খালি চোখে নির্ভুলতার সাথে তাঁর জ্যোতির্বিদ্যা পর্যবেক্ষণ এবং গণনা তাঁকে বিশ্বের অন্যতম জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসাবে গণ্য করেছে। এই মহান জ্যোতির্বিজ্ঞানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভূবনেশ্বরে পাঠানী সামন্ত প্ল্যানেটেরিয়াম তৈরি করা হয়েছে। তিনি জ্ঞানে সমৃদ্ধ হলেও ধন-সম্পদে সমৃদ্ধ ছিলেন না। দারিদ্র এবং অসুস্থতা সর্বদা তাঁর জীবনের সেরা সঙ্গী ছিল। সারাজীবন অনিদ্রায় ভুগছিলেন এবং জ্বর ও সংক্রমণের ফলে ১১জুন ১৯০৪ সালে ৬৮ বৎসর বয়সে তিনি প্রয়াত হন।