দিনের আলোয় ঢাকা থাকে রাতের আকাশের সহস্র সহস্র তারা। রাত এলে জাগে তারারা। তারার আলোয় রাত সুন্দর, মধুর হয়। রাতের সৌন্দর্য ভোগ করি আমরা। কিন্তু তারাদের নাম-গোত্রের খবর রাখি না। হিসাব রাখি না কোন তারা আকাশ থেকে ঝরে পড়ল। প্রকৃতির এ এক অমোঘ নিয়ম। ভারতের ভাস্কর্য শিল্পাকাশে অনেক উজ্জ্বল তারা দীপ্তমান হয়ে অন্যন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে কালে নিয়মে চলে গেছেন।তাদের মধ্যে কাউকে মনে রেখেছি, কাউকে ভুলে গেছি। ভুলে যাওয়া একজন বাঙালি ভাস্কর, দরদী লেখিকা মীরা মুখোপাধ্যায়। মীরা মুখোপাধ্যায় একাধারে ভাস্কর, চিত্রকলা শিল্পী, শিল্প শিক্ষয়িত্রী অন্যদিকে নিষ্ঠাবান অন্বেষক- জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত খুঁজে বেড়িয়েছেন সেই সব শিল্পীদের যাদের শিল্পকর্ম আজকের দুনিয়ায় ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিল, যিনি শিল্পী ও কারিগরদের প্রভেদ সরাতে চেয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম্য হতে চেয়েছিলেন।
২০২৩ সালে এমনই এক কৃতবিদ ভাস্কর এর জন্মশতবর্ষ অতিক্রান্ত হয় নীরবে। ১৯২৩ সালে কলকাতার বউবাজারের এক একান্নবর্তী পরিবারে মীরা মুখোপাধ্যায়ের জন্ম। চৌদ্দ বছর বয়সে শিল্পশিক্ষার সুযোগ ঘটে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত “সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট স্কুলে” সেখানে তখন ছবি আঁকা শেখাতে কালিপদ ঘোষালের মত শিল্পী। চার বছর চিত্রশিল্পী হিসেবে নিজেকে তৈরি করেন এখানে। বিয়ের পর দিল্লী বসবাসকালে দিল্লির পলিটেকনিকে পেইন্টিং, গ্রাফিক্স,স্কাল্পচার নিয়ে ডিপ্লোমা করেন। শিল্পচর্চার পদ্ধতি ছিল এখানে বেশ কিছুটা ভিন্ন। আধুনিক শিল্প প্রযুক্তিতে দক্ষ ও পেশাদার কারিগর তৈরি ছিল এখানকার মূল উদ্দেশ্য, আমাদের প্রাচীন ভারতের শিল্প ও শিল্পরীতির পরিচয় ছিল না এখানকার পাঠে। একটা সময় শিল্পী দিল্লি থেকে শান্তিনকেতনে এসে কাজ শুরু করেন। এখানে ইন্দোনেশিয়ার শিল্পী আফান্দি কোসোমার এর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আসে। কোসোমার মীরা দেবীর শিল্প দর্শনকে প্রভাবিত করেন।
১৯৫২- ৫৩ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানির ‘একাডেমি ডার বিলডেলহেন কুনস্টেনইন মিউনিখে’ (Akademic der Bildenhen kunsten in Munikh) আসেন। এখানে এসে বেশ কিছুটা সমস্যার মধ্যে পড়লেন। ভাষা, রোজগার সমস্যা তো ছিলই সে সঙ্গে শিল্পচর্চার ধরণ ও ছিল এখানে একেবারেই অন্যরকম। যার জন্য মানিয়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছিল। দেশে ফেরারও উপায় ছিল না। বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল, সামাজিক চাপ একাকীত্ব এই সব ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছিল তাকে। তবুও ধৈর্য ধরে সেখানে থাকলেন।প্রায় দু বছর কাজ করার সুযোগ পান এখানে। ব্রোঞ্জের মতো ধাতু মূর্তি নির্মাণে ঢালাই এর কাজও শেখানো হতো এখানে। জার্মান শিল্প শিক্ষক প্রফেসর স্ট্যাডলার, হাইনরিক কারচনারের মতো শিল্পীর সাহচর্য লাভ করেন। কার্যত বলা যেতে পারে স্ট্যাডলারদের হাত ধরেই মীরা মুখোপাধ্যায়ের অংকনশিল্প থেকে ভাস্কর্যে স্থানান্তরণ ঘটে।
একদিন প্রফেসর স্ট্যাডলার তাকে বলেন ‘তোমাদের দেশে এত প্রাচীন ভাস্কর্যের ঐতিহ্য তুমি তার থেকে কি কিছুই পাওনি?’ চমকে ওঠেন মীরা দেবী। বইপত্র ঘেঁটে চলে ভারতের প্রাচীন ভাস্কর্যের সুলুকসন্ধান।’ মাস্টার্স অফ আর্টস’ শেষ না করেই কলকাতায় ফেরেন ১৯৫৬ তে। এখানে এসে স্থির করলেন খুঁজে বের করতে হবে আমাদের দেশের শিল্প ঐতিহ্যের শিকড়। ভারতে ফিরে বিভিন্ন জায়গায় শিল্পকলার শিক্ষিকা হিসাবে নিযুক্ত হলেও নতুন কিছু করার নেশা সবসময় তাকে অস্থির করে রাখত। একদিন বস্তারের শিল্পীদের তৈরি একটা ঘোড়ার দেখে তিনি মুগ্ধ হন মীরা দেবী। চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৬০ সাল থেকে প্রথমে ছত্রিশগড়ের বস্তারের শিল্পী ও পরে পশ্চিমবঙ্গের ডোকরা শিল্পীদের সঙ্গে থেকে কাজ করে শিক্ষানবিশের মতো জীবন যাপন করেন। মীরা দেবীর শিল্প জীবনে বস্তার পর্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এখানে কাজ শিখতে গিয়ে কারিগরের খোঁজে তিনি গঙ্গামুন্ডা, দান্তেওয়াড়া, ভৈরমগড় অক্লান্তভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এখানকার স্থানীয়দের সঙ্গে থেকে, তাদের জীবনযাত্রা খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এখানকার মানুষদের শিল্পবোধ, খাদ্যাভাস, বৈবাহিক জীবনে প্রেম, দুঃখ, লড়াই সবকিছুই শিল্পীর শিল্পকর্ম ও পরবর্তী কালে তার লেখায় ফুটে উঠেছে।
ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায় লক্ষ করেছিলেন এখানকার মানুষদের ধর্মীয় বিশ্বাস রীতিনীতি ভীষণভাবে তাদের শিল্পবোধকে প্রভাবিত করে। জঙ্গলঘেরা গ্রামে আদিবাসীদের বিভিন্ন স্থানীয় দেব-দেবীর মূর্তির ভাস্কর্য দেখে তার শিল্পচেতনা বোধ আরো উন্নত ও ঋদ্ধ হয়। পরবর্তীকালে বস্তারের শিল্পীদের প্রযুক্তিকে আত্মস্থ করে তিনি নিজে সম্পূর্ণ অন্য রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন ভবিষ্যতে যা তার নিজস্ব শিল্পকর্মের পরিচায়ক হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণত যে পদ্ধতিতে মীরা দেবী কাজ করতেন তাকে বলা হয় লস্ট ওয়াক্স (lost Wax) বা সির পেরদু (cire Perdue)। ধুনো বা মোমজাত দ্রব্য দিয়ে মূর্তি গঠন করার পর বাইরে একটি মাটির খোলস করা হয়। মাঝে রাখা হয় খানিকটা ফাঁক সেখানে তরল ধাতু ঢেলে দেওয়া হয়। এর ফলে যখন গরম তরল ধাতু জমাট বেঁধে বস্তুরূপ ধারণ করে তখন ভেতরের মোমটি গলে যায়। পরে বাইরের খোলসটি ছাড়িয়ে ফেললে ব্রোঞ্জের মূর্তিটি রূপ পায়। এই প্রযুক্তি বস্তারের ধাতু মূর্তির কারিগর ও পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা ডোকরা শিল্পীদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এই পদ্ধতিতে হিন্দুদের দেবদেবী, ছোট ছোট খেলনা, মানতের ঘোড়া তৈরি হতো। এখান থেকেই মীরাদেবী তৈরি করলেন বড় বড় আকারের মূর্তি। বড় মূর্তি তৈরিতে আগে খন্ড খন্ড করে কাস্টিং করার পর সেগুলোকে জোড়া লাগাতে হতো। অত্যন্ত শ্রমসাধ্য কাজ। শিল্প – ঐতিহাসিকরা মনে করেন বিরাট আকারের মূর্তির ধারণা মীরা দেবীর কাজের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। এটি তার মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ইজিস্পিয়ান ও ইট্রুস্কান মূর্তি গুলো দেখার পর।
স্থানীয় মানুষদের শিল্প কর্মে যুক্ত করা এবং নিজের মতো গড়ে পিঠে শিল্পদক্ষ রূপে পরিণত করা ছিল তার শিল্পকর্মের আরো এক সফলতম দিক। মহিলাদের নিয়ে কাঁথা তৈরি কর্মশালা করেছেন, শিখিয়েছেন ঢালাইয়ের কাজ। ইটের গোল উনুন বা ভাটায় কাজ করার সময় তাপ বজায় আছে কিনা সেদিকে তার নজর রেখে শিখিয়েছেন কিভাবে ব্রোঞ্জ মূর্তি গড়তে হয়। এইভাবে দেশি এবং পশ্চিমি ধাঁচের মিশ্র পদ্ধতিতে তার কাজ সাড়া ফেলে শিল্প ক্ষেত্রে- যেখানে তারের কর্মী, মাটির বাহক, মাঝি, জেলে, ঝুড়ি বোনেন যাঁরা তারাই ছিল শিল্প সৃষ্টির প্রধান বিষয়বস্তু।
Ashoka at Kalinga, Earth career, smiths working under a tree, Mother and child, Srishti মতো কাজ মীরা মুখোপাধ্যায়কে ভাস্কর হিসেবে অমর করে রাখবে। জীবনের প্রথম দিকে সম্রাট অশোকের একটি বারো ফুটের ভাস্কর্য শুরু করেন। বানাতে প্রায় তিন বছর সময় নিয়েছিলেন। কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে চন্ডাশোক রূপান্তরিত হন মানব দরদী আদর্শ রাজায়; সেই ভাব ধরা পড়ে তার মূর্তিতে। বর্তমানে দিল্লির ‘মৌর্য শেরাটন’ হোটেল প্রাঙ্গণে স্থান পেয়েছে এ ভাস্কর্য। কাজই তার ধ্যান জ্ঞান তাই কাজের জন্য দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন নানা শিল্প ভাস্কর্য দেখেছেন। সাচির বিরাট ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের প্রতিকৃতি দেখে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে তার শেষ শিল্পকর্ম ১৪ ফুটের ধ্যানস্থ বুদ্ধমূর্তি গড়ার কাজ তিনি শুরু করেন। মূর্তি তৈরি করা কালীন হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ১৯৯৮ সালে প্রয়াত হন, ধ্যানস্থ বুদ্ধমূর্তি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। নিজের পদ্মপুকুরের বাড়ি ছাড়াও মীরা দেবীর শিল্পকর্মের আস্থানা ছিল এলাচি গ্রাম।
অনন্য প্রতিভাধর মীরা মুখোপাধ্যায় প্রফেসর নির্মল বসুর সহায়তায় অ্যান্থ্রোপোলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার হয়ে ভারতের ধাতু শিল্প নির্মাণের কাজের সঙ্গে যুক্ত কারিগর সম্পর্কে গবেষণা করেন। লেখেন ‘মেটাল ক্রাফটসম্যান অব ইন্ডিয়া’ (১৯৭৮), আজও প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে যা পরিচিত। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন সেই সব ধাতু মূর্তির কারিগরদের জন্য যারা উত্তরাধিকার সূত্রে দক্ষতা লাভ করে একটি শিল্প পরম্পরাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করেছেন। Insearch of Biswakarma (বিশ্বকর্মাদের খোঁজে) সেই দলিল সেখান বৌদ্ধসূত্র অবলম্বন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন শ্রেনি বর্জিত এক কর্মজগৎ। তার নিজস্ব আঙ্গিকে তৈরি করা ধাতু মূর্তি প্রদর্শনী হয় ১৯৬০ সালে ম্যাক্স মুলার ভবনে- সেই প্রথম ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হয় কলকাতার দর্শকের। এর আগে কলকাতা, দিল্লিতে গ্রুপ শো হিসাবে তার চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের একাধিক প্রদর্শনী হয়। ১৯৬৬ সালে কলকাতার কেমোল্ড গ্যালারিতে এবং Christie’s মতো বিখ্যাত অকশন হাউসে তার কাজ প্রদর্শিত হয়। সাড়া পড়ে গোটা দুনিয়ায়। এই সময় তার গবেষণা ভাস্কর্য এনে দিয়েছিল দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্বীকৃতি। ১৯৬৮ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি কাছ থেকে স্বর্ণ পদক পান। ১৯৮০ সালে পান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবনীন্দ্রনাথ স্মৃতি পুরস্কার।১৯৯২ সালে ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে সম্মানিত করেন শ্রেষ্ঠ কারিগর হিসেবে। শ্রেষ্ঠ কারিগর বা শিল্পীরূপে নয় মীরা মুখোপাধ্যায় বস্তারের ও ডোকরা শিল্পীদের একজন বলে নিজেকে মনে করতেন। একটা সময় বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনের বৃত্ত থেকে দূরে সরে গিয়ে আত্মমগ্ন এই শিল্পী সৃষ্টি করেছেন অতুলনীয় সব শিল্পকর্ম যা চির ভাস্কর হয়ে থাকলে ও ‘ভাস্কর’ মীরা মুখোপাধ্যায় নিজে রয়ে গেলেন মেঘে ঢাকা তারার মত।
তথ্যসূত্র :
১) শতবর্ষে মীরা মুখোপাধ্যায়, রত্নাবলী চট্টোপাধ্যায়, ‘নন্দন ‘ শারদ ১৪৩০।
২) মীরা মুখোপাধ্যায় বস্তারের দিনলিপি (বইপত্তর, ২০১৮)
৩) মীরা মুখোপাধ্যায় ‘বিশ্বকর্মার সন্ধানে’ (বইপত্তর, ২০১৮)
৪) Sculpture of undulating live:’ Meera Mukherjee’s Arts of Motion’ Sanjukta Sunderson.
৫) মীরা মুখোপাধ্যায় মেটাল ক্রাফটস্ মেন অফ ইন্ডিয়া, মেময়ার ৪৪, অ্যান্থ্রোপলিজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ১৯৭৮।