কোনো একটা দেশে গণতন্ত্র কতটা শক্তিশালী, প্রতিবেশী দেশ তথা বিশ্বের কাছে সেই দেশের মান-মর্যাদা কতটা – সেটা সে দেশে বসবাসকারী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ কতটা ভালো রয়েছেন তথা কতটা নিরাপদে রয়েছে তাদের জীবন এবং নাগরিক অধিকার তার উপর বহুলাংশে নির্ভর করে। ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশে গত আগস্ট মাসে ছাত্র বিক্ষোভ তথা গণ আন্দোলনে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সে দেশে বসবাসকারী সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর লাগাতার আক্রমণ সংঘটিত হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষ উদার মানসিকতার পরিবর্তে সেখানে কট্টরপন্থা ক্রমশ জাঁকিয়ে বসেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন ও সম্পত্তির উপর চলছে লাগাতার আক্রমণ। তাদের নাগরিক অধিকার লুণ্ঠিত হচ্ছে। তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর নেমে আসছে ধারাবাহিক আক্রমণ। তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে, চলছে লুঠ। সম্প্রতি দেখা গেল, ইসকন নামে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে সেখানকার আদালতে মামলা শুরু হয়েছে, যদিও আদালত সে দাবিকে মান্যতা দেয়নি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নেতা সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময়কৃষ্ণ ইসকনের পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষও বটে। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গত ২৫ নভেম্বর তাকে গ্রেফতার করা হয়। এখন পর্যন্ত তার জামিন মেলেনি। চিন্ময়কৃষ্ণের মুক্তির দাবিতে তাঁর অনুগামীরা বিক্ষোভ শুরু করেছেন। চিন্ময়ের মুক্তির দাবিতে মূলত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ পথে নেমেছেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেখানে মৌলবাদী মানসিকতা ডালপালা মেলেছে। সেই সঙ্গে ভারত বিদ্বেষী মানসিকতাও ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। ভারত বিরোধী মানসিকতার প্রসার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও বিকাশকে ব্যহত করবে বলাই যায়। অনেকেই মনে করছেন, ইসকনকে নিষিদ্ধ করার প্রয়াস এবং সেই সঙ্গে চিন্ময়কৃষ্ণের গ্রেপ্তারি আসলে ভারত বিরোধি মানসিকতার প্রতিফলন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষা বিষয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারত গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত করেছে। সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের এইটাই দাবি, সেখানে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সংঘটিত আক্রমণ অবিলম্বে বন্ধ হোক। বজায় থাকুক শান্তি-শৃংখলা তথা সার্বিক সংহতি ।
সে দেশে বসবাসকারী হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন ও সম্পত্তি যাতে সুরক্ষিত থাকে সে ব্যাপারে সেখানকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে, নিতে হবে কড়া পদক্ষেপ। প্রতিবেশী ভারত সরকারকেও এ ব্যাপারে সদর্থক ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
সাম্প্রতিক দেখা গেছে, তদারকি সরকারের নীরব সমর্থনে এক ধরনের ধর্মীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করার দিকে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। অন্ধ ভারত বিরোধিতার সাথে সেদেশে মৌলবাদী মানসিকতা কিভাবে উত্তোরোত্তর বেড়েই চলেছে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরলে বোঝা যাবে এবং যার ফলশ্রুতিতে সেদেশে বসবাসকারী সংখ্যালঘু মানুষজনের জীবন এবং সম্পত্তি ক্রমশ বিপন্ন হয়ে উঠেছে। চিন্ময়কৃষ্ণ কোন সন্ত্রাসী নন, তিনি কোন সহিংস ঘটনার সঙ্গেও যুক্ত নন। তবু তাকে গ্রেফতার কেন? তিনি বাংলাদেশে ইসকনের অন্যতম সাধু ও বর্তমানে দেশের তিন কোটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ও সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র। বিমানবন্দর থেকে তাকে গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেফতার হতে হয়। গ্রেপ্তারের পরবর্তীতে তার সঙ্গে থাকা পারীষদদের এ বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। এটা কি কোন গণতান্ত্রিক সুস্থ চেতনার লক্ষণ? তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগেও তোলা হয়েছে। এই অভিযোগের কি কোন সারসত্য আছে? পক্ষান্তরে আমরা দেখতে পাই, তাকে গ্রেফতার করা হলেও তিনি প্রিজন ভ্যান থেকেই সকলকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও আন্দোলনের আবেদন জানান। তার বক্তব্য, তিনি কখনোই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরোধী নন, তিনি বাংলাদেশকে ভালবাসেন এবং নিজের প্রাণের দেশ বলেই মনে করেন। বাংলাদেশের সার্বিক প্রগতিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব থাকুক— এই দাবি তিনি দীর্ঘদিন থেকেই করে এসেছেন। এই দাবির পিছনে সত্যিই কি অন্যায্য কিছু আছে?
হাসিনা সরকারের পতনের পর দেখা যাচ্ছে, হাসিনাকে যারা সমর্থন করেছিলেন সেইসব সংবাদমাধ্যমের অফিসে ভাঙচুর চলেছে। আওয়ামি লীগের নেতাকর্মীদের উপর লাগাতার আক্রমণ সংঘটিত হচ্ছে। যা কিছু মুক্তমনা, উদার ও গণতান্ত্রিক তার উপর আক্রমণ সংঘটিত হচ্ছে। শুধু সাংবাদিকদের হুমকি বা আক্রমণ নয়, সংকীর্ণ মৌলবাদী মানসিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী, মেহজাবিন চৌধুরী, বাঁধনের মত বিশিষ্টরা আক্রমণের মুখে পড়েন। সেদেশের অন্যতম খ্যাতিমান ক্রিকেটার সাকিব উল হাসান। তিনি বাংলাদেশকে বহু সাফল্য এবং গৌরব এনে দিয়েছেন। আওয়ামি লীগের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে তাকে দেশের মাঠে টেস্ট খেলতে দেওয়া হয়নি। আগস্ট মাসে হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে চলছে অশান্তি এবং নৈরাজ্য। ছাত্র আন্দোলনে সংঘটিত পরিবর্তনকে অনেকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু সত্যিই কি সেখানে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? তিন মাস পেরিয়ে গেলেও সেখানে এখনও শান্তি অধরাই রয়ে গেছে। জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতে নাজেহাল হচ্ছেন সাধারণয় মানুষ। জনজীবনে নেই স্থিতি। সেদিকে নজর নেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের।
বাংলাদেশকে চিরকালই ভারত সাহায্য এবং সমর্থন দিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় ভারত পাশে দাঁড়িয়েছিল। দিয়েছিল সামরিক ও মানবিক সহায়তা। যার ফলশ্রুতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। হাসিনার আমলে ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক ছিল। ফলত, আর্থিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ভারতের কাছ থেকে ব্যাপক সহযোগিতা পেয়ে এসেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সেখানে নতুন যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তারা ভারত বিরোধী মানসিকতায় পুষ্ট। তারা এখনো পর্যন্ত প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ফলত বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের কাছ থেকে সহযোগিতা পেতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তাদের এই মানসিকতা ভবিষ্যতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা অনেকেই আন্দাজ করতে পারছেন। সেই কারণে অনেকেই এই নতুন সরকারের বিরোধিতা করছেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আক্রোশের মুখোমুখি হবার আশঙ্কায় সেভাবে তারা সক্রিয় হতে পারছেন না।
সরকার পরিবর্তিত হলেও শাসনগত পরিকাঠামো এবং তার সঠিক প্রয়োগ এখনও করে উঠেছে পারেনি সেখানকার নতুন সরকার। সেই কারণে সেখানে একটা ডামাডোল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে । এখনও সেখানে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা ফেরেনি।
প্রায় তিন কোটি সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বাংলাদেশে বসবাস করেন। তাদের উৎসব সুষ্ঠুভাবে হওয়ার জন্য যে পরিমাণ নিরাপত্তা দেওয়ার দরকার ছিল তা দেওয়া হয়নি। ফলত তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছে। সেই কারণে সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ক্রমশ জোট বাঁধছেন। তাতেই সেখানকার শাসক গোষ্ঠীর রাগ, রাগ কট্টরপন্থীদের। কোন দেশে বসবাসকারী সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যদি তাদের জীবন ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোরনিরাপত্তার দাবি তোলে, তাদের ন্যায্য অধিকারের দাবি তোলে সেটা কি অন্যায়? দেশ চালনা করতে গেলে উদার এবং দূরদর্শী মানসিকতায় বিশ্বাসী হতে হবে। সকল জাতি-সম্প্রদায়ের জান-মাল ও নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা দিতে হবে। বিদ্বেষ বা বঞ্চনা নয়, সবাইকে সমানাধিকার দিতে হবে। সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের পথ প্রশস্ত করতে হবে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেশ গঠনের কাজে এগোতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকলে চলবে না। দ্রুত শান্তিপূর্ণ অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্তা করে নির্বাচিত সরকারের হাতে দেশের শাসনক্ষমতা প্রত্যর্পণ করতে হবে। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সহ সকলকে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। মৌলবাদ তথা সংকীর্ণ মনোভাব ত্যাগ করে এগিয়ে যেতে হবে আগামীদিনের বাংলাদেশকে।
বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচার বন্ধ হোকফিরিয়ে দিতে হবে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র। সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা প্রদান করে সুনিশ্চিত করতে হবে দেশের সার্বিক সংহতি। তা না করে কট্টরপন্থাকেই যদি তারা আঁকড়ে ধরতে চায় শান্তি ও প্রগতি তো বহুদূর, কয়েক যুগ পিছিয়ে যাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ‘সোনার বাংলাদেশ’।