বাঙালির অধরা

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (File photo: IANS)

খবরটি ছােট। তার শেষে তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য : আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এই বাংলা থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একদিন প্রধানমন্ত্রী হবেন। ভােটের সময় লেখা এখনও দেওয়ালের একটি লিখন জ্বলজ্বল করছে, ‘এসাে পাল্টাই, কোনও বাঙালিকে প্রধানমন্ত্রী বানাই’। পাশে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি– সুতরাং মমতাই যে সেই প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, তার কারণেই তৃণমুলের এই দেওয়াল স্লোগান। যখন দেওয়ালে এটা লেখা হয়েছিল, তখন কোনও কোনও বিরােধী নেতার মূল্যায়নে সবদিক বিচার করলে এই পদের যােগ্য।

বিষয়টি এখন অতীত। এ নিয়ে কোনও কথা অবান্তর, অবাস্তব। তাহলে প্রসঙ্গটি উঠল কেন? সম্প্রতি সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদজ্ঞাপনসূচক বিতর্কে অংশ নিয়ে রাজ্য বিজেপির সভাপতি এবং সাংসদ দিলীপ ঘােষ একটি চাঞ্চল্যকর কথা শােনালেন।

প্রকাশিত খবরানুযায়ী তিনি বলেছেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গকে এক করে একটি দেশ গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গকে মিশিয়ে একটি দেশ তৈরি হলে সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন এবং প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন’। বিজেপি নেতা যা বলেছেন, তা তার নিজের মনে যা এসেছে তাই– বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য না করে অনেকেই তা হয়ত অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেবেন।


কারণ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব সুদৃঢ়, সুসংবদ্ধ। ভারত মনেপ্রাণে বাংলাদেশের মঙ্গল, সমৃদ্ধি কামনা করে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ যাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতির সােপানে উঠতে পারে তার জন্য ভারত আর্থিকভাবে সাহায্য করছে। সহযােগিতা ও সহমর্মিতা দেখাচ্ছে।

সুতরাং সেই দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গকে মিশিয়ে একটি স্বতন্ত্র দেশ। গড়ার পরিকল্পনা এই মুহূর্তে একটি অলীক ভাবনা। তাছাড়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বাংলাদেশকে ভালােবাসেন, সে দেশের মানুষের কল্যাণ ও সুন্দর জীবন কামনা করেন। তিনি নিজেও বলেন, বাংলাদেশে যা ঘটে, এখানে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, আবার এখানে যা ঘটে, তা নিয়েও বাংলাদেশের মানুষ ভাবেন।

তবে একটা সময় ছিল, কিছু বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক কিছু বিশিষ্ট নাগরিক, দুই বাংলার মিলনের স্বপ্ন দেখতেন। তাঁরা এখন আর কেউ জীবিত নেই সম্ভবত। আর থাকলেও স্মৃতিশক্তি হারিয়ে তাঁরা এখন বােধহীন। কিন্তু তাঁদের মনােভাবের কথা এখনও যে কিছু মানুষের মনে থেকে গেছে তা কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই।

সেই ভাবনা ভেবেই তাঁরা আনন্দ পান, যদিও তা বাস্তবের ধারেকাছেও নেই। যাঁরা এই মিলনের স্বপ্ন দেখতেন, তাঁরা বলতেন, কী নেই এই বাংলায়? এত সম্পদ, এত ঐশ্বর্য, একটা পূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে খুব ভালােভাবে বেঁচে থাকার সবকিছু মিলবে এই যুক্ত বাংলায়। বাঙালির মেধা, বাঙালির বুদ্ধি, বাঙালির চেতনাবােধ আর কোনও সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে নেই হয়ত। আর সেই জন্যই এই অবক্ষয়ের যুগে, রাজনৈতিক হানাহানি সত্ত্বেও, শিক্ষা সংস্কৃতিতে সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে মিলনে পশ্চিমবঙ্গ এখনও সবার আগে। এটা বাংলার জনগণের কৃতিত্ব। বাঙালির কৃতিত্ব।

এবার লােকসভা নির্বাচনে বিরােধী অ-বিজেপি দলগুলির প্রার্থীরা প্রয়ােজনীয় সংখ্যক আসনে জয়ী এবং বিজেপি ধরাশায়ী হলে, বিরােধীদের তরফ থেকে কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, এমন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল। এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম সেই তালিকায় এসেছিল। বিজেপি ভােটে পর্যুদস্ত হয়ে বিদায় নেবে এ নিয়ে বিরােধীদের কোনও সন্দেহের অবকাশ ছিল না। যদিও জোট বেঁধে এক হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ার চেষ্টায় তাদের অনেক খামতি ছিল।

তৃণমূল কংগ্রেসের ব্রিগেডের জনসভায় বিরােধীরা যােগ দিয়ে বক্তৃতা শেষে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা নিয়েও আলােচনা হয়েছিল এবং চন্দ্রবাবু নাইডু থেকে আরম্ভ করে কেউ কেউ এই পদে মমতাকে যােগ্য বলে বিবেচনায় এনেছিলেন। কিন্তু এই প্রশ্নে মমতা বলেছিলেন, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন তা ঠিক হবে নির্বাচনের পর। এটা নিয়ে কোনও সমস্যার সৃষ্টি হবে না। যদিও উত্তরপ্রদেশের বিএসপি নেত্রী মায়াবতী তখন এক পায়ের ওপর দাঁড়িয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য।

বিরােধীরা জিতবেনই আর বিজেপি হেরে বিদায় নেবে— এই প্রশ্নে বিভিন্ন মহলে যখন আলােচনা তুঙ্গে, তখন একদিন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখােপাধ্যায় বলেছিলেন, কোনও বাঙালি প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি খুশি হবেন। বাঙালি রাষ্ট্রপতির আসনে বসেছে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পদ এখনও অধরা।

সরাসরি নাম না করলেও, আকারেইঙ্গিতে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই পদের যােগ্য। তাছাড়া রাজ্যের বিশিষ্টজনের মধ্যে কেউ কেউ এবং তাঁর নিজের দলের অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর পদে দিদিকে দেখতে চান বলে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। মমতা নিজে বলেছিলেন, ৪২-এ ৪২ পেয়ে এবার বাংলাই কেন্দ্রে সরকার গঠনে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। অলক্ষ্যে অন্তর্যামী হাসছিলেন।

ভােটের ফল বিরােধীদের সব আশা-আকাঙক্ষায় জল ঢেলে দিল। বিজেপি জিতল, বিরাট সেই জয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি জেতার পর দলীয় সমর্থকদের সমাবেশে, দেশবাসীর উদ্দেশে বললেন, ‘আপনারা এই ফকিরের ঝােলা পূর্ণ করে দিয়েছেন, আপনাদের ধন্যবাদ’।

বাঙালির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযােগ যে আসেনি তা বলা যাবে না। এসেছিল, কিন্তু সে সুযােগ হেলায় হারিয়ে গিয়েছিল। তই সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় যে আশা পােষণ করেন, তা যদি কোনওদিন বাস্তবে ফলে, তাহলে বাঙালিরা পৃথিবী জুড়ে যে যেখানেই থাকুন, খুশি হবেন।