তাপস চট্টোপাধ্যায়
‘ও (শ্রীমা) সারদা, সরস্বতী— জ্ঞান দিতে এসেছে; জ্ঞানদায়িনী, মহাবুদ্ধিমতী। ও কি যে সে! ও আমার শক্তি। ও রাগ করলে (নিজেকে দেখিয়ে) এর সব নষ্ট হয়ে যাবে। ওর ভেতরে যে আছে, সে ফোঁস করলে— ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরও রক্ষা করতে পারবেন না।’
বিবাহের পরে মাকে (জগদম্বাকে) ব্যাকুল হয়ে ধরেছিলাম, ‘মা আমার পত্নীর ভিতর থেকে কামভাব এককালে দূর করে দে’— ওর (শ্রীশ্রী মা’র) সঙ্গে একত্র বাস করে এইকালে বুঝেছিলাম, মা সে কথা সত্য সত্যই শ্রবণ করেছিলেন।’
শ্রীশ্রী মায়ের প্রতি শ্রীরামকৃষ্ণের এই অপার্থিব অনুভূতি এবং নিষ্কাম উৎসর্জন স্বামী বিবেকানন্দকে নারীশক্তির অপার ঐশ্বর্র্যের দিশা দেখিয়েছিল।
সময়কালটা ছিল অখণ্ড বাংলার নারীশক্তির উন্মেশের এক অভাবনীয় মুহূর্ত। পদে পদে ধর্মীয় রীতিনীতি আর কুসংস্কারের আড়ালে নারীশক্তিকে অবদমিত করে রাখার এক প্রাগৈতিহাসিক পুরুষতন্ত্রের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের মুহূর্ত।
১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে আইনত নিষিদ্ধ হয়েছিল সতীদাহ প্রথা। একদিকে বাল্যবিবাহ আইনত রোধ এবং স্ত্রীশিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে শহর কলকাতায় স্থাপিত হয়েছিল বেথুন স্কুল এবং আরো কয়েকটি নারী শিক্ষাকেন্দ্র, অন্যদিকে আইনি ব্যবস্থায় বিধবা বিবাহ প্রথা চালু হয়েছিল। নারীশক্তির বিজয়োৎসবের সেই ব্রাহ্ম মুহূর্তে ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি মধ্যকলকাতার সিমলা স্ট্রিটে জন্ম নিলেন বাংলা তথা ভারতবর্ষের এক বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ। ঐতিহাসিকদের মতে, পাশ্চাত্যে নারীজাগরণের ইতিহাস অষ্টাদশ শতকের শুরুতেই। এর অন্যতম কারণ ছিল ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব একদিকে মূদ্রণযন্ত্রের আধুনিকীকরণের ফলে বিশ্বজুড়ে সাহিত্য, সংস্কৃতির ঢালাও প্রচার, অন্যদিকে পাশ্চাত্যের ঔপবেশিক নীতির ফলশ্রুতি হিসেবে প্রাচ্যের সাথে ভাবনার আদানপ্রদান। এমনই সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের মাধ্যমে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার নারীশক্তির জাগরণের ধারা বাংলা তথা ভারতবর্ষকে প্রভাবিত করেছিল।
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের কালে ‘মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা’— এই মত প্রবল হয়ে ওঠে। ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে Wollstonecraft, ‘A Vindication of the rights of Women’ রচনা করেন। গোটা বিশ্বে এই গ্রন্থটিকে নারী-পুরুষের সাম্যবাদমূলক প্রথম রচনা বলে মনে করা হয়। সেই কারণেই নারীশক্তির জাগরণের নিরিখে অষ্টাদশ শতকে ‘দ্য এজ অফ এনলাইটমেন্ট’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
স্বামী বিবেকানন্দ পাশ্চাত্যে আসেন ১৮৯৩, বিগত একশো বছরে পাশ্চাতেরে নারীরা একাধিক নারীমুক্তি আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অধিকার অর্জন করেন।
১৮৩০ সালে শুরু হয় দাসপ্রথা উচ্ছেদের আন্দোলন। ১৮৪৮-৪৯-এ বেশ কয়েকটি কলেজ মেয়েদের প্রবেশাধিকার দিতেরাজি হয়। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে এমিলি ডেভিস, লিহ স্মিথ মেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য কলেজ খোলেন। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে একদিকে যেমন ক্যারোলিন নরটন-এর প্রচেষ্টায় বহু বিবাহবিচ্ছিন্না নারী এবং তাদের সন্তান সম্পর্কিত বেশ কিছু সমস্যার সমাধান হয়, অন্যদিকে নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থাপিত হয় ‘সোসাইটি ফর প্রোমোটিং দ্য এমপ্লয়মেন্ট অফ ওমেন।’ পাশ্চাত্যের নারীশক্তির এই দ্রুত এবং অভাবনীয় পরিবর্তন স্বামীজিকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। উচ্ছ্বসিত হয়ে গুরুভাইদের বলেছিলেন, ‘এই রকম জগদম্বা যদি ১০০০ আমাদের দেশে তৈরি করতে পারি, তবে নিশ্চিন্ত হয়ে মরব।’
শিকাগো ধর্ম মহাসভায় স্বামীজির উদাত্ত কণ্ঠে বিশ্বের সমস্ত নারীশক্তিকে ভগিনীস্বরূপ আহ্বান, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের নারীজাতীর কাছে এক নতুন বার্তা বহে এনেছিল। আমেরিকায় নারীরা ভাবতেও পারেননি, কোনও ধর্মগুরু আদিম পাপের কথা না শুনিয়ে তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারেন। যিনি এমন এক সার্বজনীন ধর্মমত প্রচার করেন যেখানে নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, পণ্ডিত-মূর্খ, উচ্চ-নীচ—সকলের জন্য বরাদ্দ থাকে একই আসন। স্বামীজির মুখে বেদান্তের আত্মতত্ত্ব ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার মহিলাদের কাছে চরম সাম্যবাদ এবং পরম স্বাধীনতার বার্তা বহন করে আনল। এখানেই না থেমে তৎকালীন ইউরোপীয় তিন প্রতিবাদী এবং বিদূষী নারী, মার্গারেট নোবেল, সারা বুল এবং জোসেফিন মোকলাউড এদেশে শ্রীশ্রী মা সারদাদেবীর সান্নিধে এসে সেই প্রথম ভারতীয় নারীর শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতার পরিচয় পেলেন। ভারতের আদর্শ নারী সম্পর্কে স্বামীজি ওদেশে যা বলেছিলেন, শ্রীশ্রী মায়ের স্বাধীন চেতনা, বিচারশীলতা ও যুক্তিনিষ্ঠা আর একবার তার সত্যতা প্রমাণ করল। সারা শ্রীশ্রী মা’কে প্রশ্ন করলেন, ‘গুরুর প্রতি আনুগত্য বলতে কী বোঝায়?’ ইতস্তত না করেই মা বললেন, ‘আধ্যাত্মিক বিষয়ে গুরুর সব কথা শুনতে ও মানতে হবে, কিন্তু ঐহিক ব্যাপারে নিজের সদবুদ্ধি অনুসারে কাজ করতে হয়, সে কাজ গুরুর অনুমোদিত না হলেও।
ভারতীয় নারীশক্তির ঐশ্বরিক অবস্থান এবং তার জগোন্মোহিনী রূপের যাবতীয় জ্ঞান যুবক নরেন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন তাঁর আদর্শ শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধে এসে। ইংরেজির ১৮৭২-এর ৫ জুন, বাংলার ১২৮০ বঙ্গাব্দের ১৩ জ্যৈষ্ঠ দক্ষিণেশ্বরের ভবতরিণী মন্দির প্রাঙ্গণে সর্বসমক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর বিবাহিত সহধর্মিনী শ্রীশ্রী মা সারদাদেবীকে ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে যাবতীয় উপাচারে ভবতারিণী রূপে পূজা করলেন, আলোড়িত হল ভারত তথা বিশ্বের আধ্যাত্মিক ধ্যানধারণা। জ্যৈষ্ঠের অমাবস্যার সেই রাতে বেদ, বেদান্ত, উপনিষদের যাবতীয় বাণীর সারমর্ম রচিত হল মা ভবতারিণী মন্দির প্রাঙ্গণে। ভারতীয় নারীর সর্বংসহা রূপে সংযোজিত হল এক শক্তিস্বরুপিনী ঐশ্বরিক সত্ত্বা।
পরমহংসের সংস্পর্শে তরুণ নরেন্দ্রনাথ শুধুমাত্র মোহিত হলেন না, তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মপন্থাও নির্ধারিত করতে সমর্থ হলেন। এমনই প্রেক্ষিতে তিনি বললেন, “The best thermometer to the progress of a nation is its women.” বিশ্ব ইতিহাসের উদাহরণ তুলে তিনি বলেছেন, ‘প্রাচীন গ্রিসে নারী ও পুরুষের অবস্থানে একেবারেই কোনও পার্থক্য ছিল না।’
একইভাবে ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী পরম্পরার ইতিহাসকে উদ্ধৃত করে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘মহান আর্যরা, বাকিদের মধ্যে বুদ্ধ সর্বতা নারীকে পুরুষের সমান অবস্থানে রেখেছেন। তাদের জন্য ধর্মে যৌনতার অস্তিত্ব ছিল না। বেদ ও উপনিষদে নারীরা সর্বোচ্চ সত্য শিক্ষা দিয়েছেন এবং পুরুষদের মতোই সম্মান পেয়েছেন।’
স্বামী বিবেকানন্দের নারীশক্তির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী। শোনা যায়, শিকাগো মহাসভায় যোগদানের ব্যাপারে শ্রীমায়ের উদ্যোগ ছিল অনেক বেশি। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি স্বামীজির অন্তর্দৃষ্টিকে স্বচ্ছ করেছিল, যার মাধ্যমে তিনি সহজেই প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন শ্রীশ্রীমায়ের অলৌকিক শক্তি। স্বামী শিবানন্দকে চিঠিতে স্বামীবিবেকানন্দ লিখেছিলেন, ‘মা ঠাকরুণ কি বস্তু বুঝতে পারনি,এখনও কেউই পার না, ক্রমে পারবে। ভায়া, শক্তি বিনা জগতের উদ্ধার হবে না। আমাদের দেশ সকলের অধম কেন, শক্তিহীনা কেন? —শক্তির অবমাননা সেখানে বলে. মা-ঠাকুরানি ভারতে পুনরায় সেই মহাশক্তি জাগাতে এসেছেন, তাঁকে অবলম্বন করে আবার সব গার্গী, মৈত্রেয়ী জগতে জন্মাবে। সেইজন আগে মায়ের জন্য মঠ তৈরি করতে হবে। মা আর মায়ের মেয়েরা, তারপর বাবা আর বাপের ছেলেরা, এই কথা বুঝতে পারে কি‘ তোমরা এখনো কেউ মাকে বোঝোনি। মায়ের কৃপা আমার ওপর বাপের কৃপার চেয়ে লক্ষ গুণ বড়।’
স্বামীজি বেদ-বেদানন্ত-উপনিষদ পড়ে প্রাচীন ভারতীয় নারীদের শৌর্যের কথা জেনেছিলেন, সহস্র বীরঙ্গনাদের ইতিহাস পড়ে বর্তমান সমাজব্যবস্থায় নারীশক্তির অবমূল্যায়নে ব্যথিত হতেন। একদিকে তিনি সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী, অহল্যাবাঈ, পদ্মিনী, ঝাঁসির রানীর কালজয়ী ব্যক্তিত্বের মধ্যে যেমন অপরিসীম মুগ্ধতা খুঁজে পেতেন, অন্যদিকে পাশ্চাত্যের নারীসমাজের স্বাধীনতা, গতিশীলতা, দক্ষতা তাঁকে আর একবার নবজাগরণের দিশা দেখাতো। এমতাবস্থায় গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অপার আশীর্বাদ এবং তাঁর যাবতীয় শক্তি এবং বিশ্বাসের আধার শ্রীশ্রী মায়ের প্রজ্ঞাকে সম্বল করে একদিন স্বামী বিবেকানন্দ বেরিয়ে পড়লেন ভারতদর্শনে। হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী, সুদীর্ঘ সেই পদযাত্রায় তাঁর যাবতীয় উপলব্ধি প্রকাশিত হলো তাঁরই রচিত ‘স্বদেশমন্ত্র’এ।
‘হে ভারত, ভুলিও না— তোমার নারীজাতীর আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী, ভুলিও না— তোমার উপাস্য উমানাথ সর্বত্যাগী শঙ্কর; ভুলিও না— তোমার বিবাহ, তোমার মন, তোমার জীবন ইন্দ্রিয় সুখের— নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে; ভুলিও না— তুমি জন্ম হইতেই ‘মায়ের’ জন্য বলিপ্রদত্ত। ভুলিও না— তোমার সমাজের সে বিরাট মহামায়ার ছায়ামাত্র…’
ভারতীয় নারীশক্তি আজ আর কারও মুখাপেক্ষী নয়, জল-স্থল-অন্তরীক্ষে, পাহাড়-সমুদ্র অতিক্রম করে আজ তারা মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছে। ভারতবর্ষের নারীশক্তির নবজাগরণ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তাই আজও স্বামীজির নির্দেশিত পথই নব-ভারত নির্মাণে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক।