তরুণ গোস্বামী
নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ তখন লক্ষ্মৌ ছেড়ে মেটিয়াব্রুজে সংসার পেতেছেন। লক্ষ্মৌর ঢঙে সাজিয়েছেন মেটিয়াব্রুজকে। নিয়ে এসেছেন বিরিয়ানী, ঘুড়ি, পাজামা আর সাথে বাহারী পাঞ্জাবি। নবাব খুব মন দিয়ে সাজিয়েছেন তাঁর চিড়িয়াখানা। একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন তাঁর মেটিয়াব্রুজকে। লক্ষ্মৌ ছাড়ার যন্ত্রণা বুকে শেলের মতো বেঁধে, মন চলে যায় উত্তরপ্রদেশের শহরটিতে।
নবাবের কাছে নানা পেশার, নানা ধর্মের মানুষের আনাগোনা। একজন মুসলমান উকিল ভদ্রলোক প্রায়ই নবাবের কাছে আসতেন। তিনি পেশাতে উকিল কিন্তু তিনি খাদ্যরসিক, গান বাজনার খুব শখ আর তাই নবাবের তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা, ভালবাসা।
একদিন উকিলবাবু এসে নবাবকে এক অদ্ভুত মানুষের গল্প বলছিলেন। উকিলবাবু বলে চলেছেন নবাবকে — জানেন সেদিন বেলেঘাটাতে একটি বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলাম। সেখানে একটি অদ্ভুত সাধুর সাথে যোগাযোগ হল। সাধুর পরনে ছিল ধুতি-পাঞ্জাবি। তিনি সকলের সাথে কথায় গল্পে মেতে উঠেছিলেন। সবসময় মুখে হাসি। গভীর একজোড়া চোখ। সবকিছু দেখছিলেন খুটিয়ে খুটিয়ে। সকলকে নমস্কার করছিলেন হাত জোড়া করে। আমাকেও করলেন, আমিও প্রতি নমস্কার করলাম। কথা বলতে বলতে আবেগতাড়িত হয়ে উঠছেন উকিলবাবু। জানেন নবাব, অবাক করা ব্যাপার হল খেতে বসে। আমার পাশে সাধুটির খাবার জায়গা। খেতে খেতে তিনি আমার থালা থেকে খেতে লাগলেন। আবার নিজের খাবার তুলে দিলেন আমাকে। সাথে নানারকম গল্প। খাওয়া শেষ হলে নিজের বটুয়া থেকে আমাকে মশলা খেতে দিলেন।
ওয়াজেদ আলির সাধুটিকে দেখার খুব ইচ্ছা হল। নাম কী তাঁর? উকিলবাবু বললেন, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। থাকেন দক্ষিণেশ্বরে রানি রাসমণির কালীমন্দিরে।
একদিন দুপুরবেলা কিছু বন্ধুকে নিয়ে মেটিয়াব্রুজ থেকে বজরা করে নবাব রওনা দিলেন, গন্তব্য দক্ষিণেশ্বর। গ্রীষ্মকাল, হাওয়া বইছে। নবাবের খুব আনন্দ একজন মহাপুরুষের সাথে দেখা হবে আর কিছুক্ষণ পর। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। এখন যেখানে মিলেনিয়াম ঘাট, সেখানে এসে নবাব বেঁকে বসলেন। ফিরে চল মেটিয়াব্রুজ আমি যাব না। সবাই অবাক। বেশ তো খোশ মেজাজে ছিলেন, হঠাৎ কী হল! রাজা বললেন, দ্যাখ আমার হঠাৎ একটি ফকিরের কথা মনে পড়ে গেল। ফকিরটি বলেছিলেন— রাজা তোমার মৃত্যু হবে যদি কোনওদিন তোমার কোনও মহাপুরুষের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তাই আর যাব না।
রাজা যদিও দক্ষিণেশ্বরে গেলেন না, তবে সামনে দেখলেন বিরাট দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দির। চারদিকে জঙ্গল, বিরাট জায়গা। তার মধ্যে এক সাধু ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পরনে ধুতি, খালি গা, মুখে স্বর্গীয় হাসি।
ক্রিস্টোফার ইশারউড তাঁর বিখ্যাত রামকৃষ্ণ ও তাঁর শিষ্যগণ গ্রন্থে রামকৃষ্ণকে বলেছেন ফেনোমেনন। ফেনোমেনন প্রকৃতির একটি অবস্থা, যেটিকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। রামকৃষ্ণের জীবন লেখকের কাছে ‘This is the story of a phenomenon.’
সাহিত্যে নোবেলজয়ী লেখক রোমা রোঁলা তাঁর পাশ্চাত্যের পাঠকদের উদ্দেশ্যে লিখলেন পাশ্চাত্যের মানুষ রাতের নিদ্রাকে হত্যা করেছে, আমি রামকৃষ্ণের অমৃত দিয়ে তাদের শুকনো ঠোঁটগুলো ভিজিয়ে দিতে চাই। শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দ আমার শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছেন কারণ তাঁরা মানবতার এই মহাসমুদ্রে অবগাহন করেছিলেন।
অবাক করা মানুষ শ্রীরামকৃষ্ণ। নিজের জীবিতকালে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। ভালবাসা এবং সহজ, সরল জীবন ছিল তাঁর একমাত্র মূলধন। যেখানেই গেছেন আনন্দের হাট বসেছে। প্রতিটি কথা মানুষের মনকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, আনন্দে ভরে দিচ্ছে। দক্ষিণেশ্বরের ঘরটিতে আনন্দের হাট বসেছে। সমাধিতে ডুবে যাচ্ছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। মুখে হাসি। বাম হাতটি বুকের ওপর রাখা আর ডান হতে অনন্ত আকাশকে দেখিয়ে দিচ্ছেন যেন বলছেন হে মানব তুমি মনকে আকাশের মতো উদার কর, কোনও ক্ষুদ্রতা যেন না থাকে। নীচতা যেন তোমাকে স্পর্শ না করে।
কলকাতার ভেদবুদ্ধিকে কটাক্ষ করেছেন ঠাকুর। নরেন্দ্রনাথ যেদিন প্রথম দক্ষিণেশ্বরে গেলেন, সেদিন নরেন্দ্রনাথ চলে যেতেই মা ভবতারিণীকে গিয়ে বললেন, কলকাতার মতো তমোগুণী জায়গাতে এই সত্ত্বগুণী ছেলে কী করে থাকে? মা সারদামণিকে বলেছিলেন, কলকাতার মানুষেরা পোকার মতো কিলবিল করে বেড়াচ্ছে, তুমি ওদের দেখ।
পরাধীন ভারতের রাজধানী কলকাতা। এখানে প্রথম কলেজ তৈরি হয়েছে ঠাকুরের জন্মের অনেক আগে। মেডিকেল কলেজ তৈরি হয়েছে, উঠেছে বড় বড় অট্টালিকা, নাট্যশালা। কলকাতার মানুষরা ম্যাকলের তৈরি করা মানুষ। দেখতে ভারতীদের মতো কিন্তু চিন্তায়, চেতনায় কথায়বার্তায় ইংরেজ। এঁদের একমাত্র কাজ সাহেবদের সাথে দেশের মানুষের যোগসূত্রের কাজ করা।
কলকাতার মানুষের এক বিরাট অংশ বিশ্বাস করে বিভেদে, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের ভেদ, ধনী-দরিদ্রের ভেদ। তাছাড়া আছে নানা ধর্ম, সেখানেও বিভেদ আছে। হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন মতের মধ্যে আছে ঘৃণা, অবজ্ঞা।অহংকারী, নির্মম, নির্দয় মানুষকে কীভাবে জীবনের ছন্দে ফেরানো যায় ঠাকুর ভেবেছেন এবং সমস্যার সমাধান দিয়েছেন।
১লা জানুয়ারি ১৮৮৬ সাল। কলকাতা থেকে গৃহীভক্তরা এসেছেন কাশীপুরের ভাড়াবাড়িতে, যেখানে ঠাকুরের ক্যানসারের চিকিৎসা চলছে। সেদিন তাঁর শরীর একটু ভালো। কানঢাকা টুপি পরে, শীতের পোশাকে সেজেগুজে তিনি দোতলা থেকে নেমে এসেছেন বাগানে, যেখানে ভক্তরা বসে গল্প করছেন, আলাপ করছেন। ঠাকুরের দেখা গিরিশের সাথে। গিরিশ তুমি যে আমাকে অবতার বল, কী দেখেছ আমার মধ্যে? উত্তরে গিরিশ বললেন, ব্যাসদেব, বাল্মিকী যার বর্ণনা দিতে পারে না, আমি আর কী বলব। ঠাকুরের ভাবের পরিবর্তন হল। তোমাদের আর কী বলি, বলি তোমাদের চৈতন্য হোক। এটি প্রথমবার নয়। ১৮৮৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর স্টার থিয়েটারে চৈতন্যলীলা নাটক দেখার পরে বিনোদিনীকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন—মা তোমার চৈতন্য হোক। এরপর শ্যামপুকুর উদ্যানবাটিতে বলেছিলেন তোমরা চৈতন্য হও। বারবার চৈতন্য হওয়ার কথা বলেছেন।
যতদিন এগিয়েছে, আমাদের উপলব্ধি হয়েছে আমাদের মেধা আছে, বুদ্ধি আছে, কিন্তু চৈতন্যের বড় অভাব। চৈতন্য নেই বলে আমাদের মেধা আছে হৃদয় নেই; বুদ্ধি আছে মনন নেই; দৈহিক শক্তি আছে কিন্তু মানুষের জন্য কাজ করার উদ্যমের অভাব। ঠাকুর বুঝেছিলেন এবং স্বামী বিবেকানন্দকে বুঝিয়েছিলেন আসল দেবতা হল মানুষ এবং আসলে ধর্ম হল নীতি। মানুষকে সেবা করাই ধর্ম এবং ঘৃণা করা অধর্ম। যে মানুষের মধ্যে বিশ্বচরাচরকে দেখতে পায় সেই প্রকৃত মানুষ। মানুষের অবয়ব থাকলে সে মানুষ হয় না। ঠাকুর রসিকতা করে বলতেন, লোক না পোক। তিনি বলতেন, মন মুখ এক করার কথা। যখন মানুষ মুখে রং মেখে আর মুখোশ পরে, কৃত্রিমভাবে নিজেকে প্রচার করে, সেটি হয়ে ওঠে সভ্যতার সংকট। সভ্যতা মানে ইট, কাঠ, পাথরের শুধুমাত্র পরিকাঠামোর উন্নতি নয়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চিন্তার ঘটানো নয়, সভ্যতা মানে সংবেদনশীল মানুষ এবং তাদের সংখ্যা যত বাড়বে, তত সভ্যতা এই বর্তমান সংকট থেকে বেরিয়ে আসবে।
১৯৫৫ সালে বিখ্যাত দার্শনিক রাসেল ও বিজ্ঞানী আইনস্টাইন পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়কদের চিঠি পাঠিয়েছিলেন, যার বিষয়বস্তু ছিল ঘৃণামুক্ত, সুন্দর পৃথিবী, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে একটি ধর্মের বিভিন্ন মতের মধ্যে কোনও ঘৃণা থাকবে না। আমাদের ভিতরে একটি শিল্পীসত্তা আছে, তাকে মুক্ত কর, যাতে সে সবর্ত্র শান্তি ছড়িয়ে দিতে পারে। ফ্রয়েড বলেছিলেন, প্রথমে যাকে ঘৃণা করছি, তারপর তার মৃত্যুকামনা করে মানুষ। তাকে অত্যাচার করে, ভয় দেখিয়ে সে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। নিজের অহংকার প্রকাশের বড় মাধ্যম ঘৃণা। অ্যানা ফ্রাঙ্ক’র ডাইরি থেকে আমরা জানতে পারি হিটলারের বন্দীশালাতে আরও শিশুদের সাথে বন্দী ছিল অ্যানা। একদিন সে শুনল জার্মান সেনাদের ভারী বুটের শব্দ। আর কিছুক্ষণের মধ্যে তারা এসে পড়বে। শিশুদের নিয়ে যাওয়া হবে গ্যাস চেম্বারে, কয়েক মিনিটে সব শেষ। অ্যানা লিখেছিল আমাদের মৃত্যু হবে কিন্তু একদিন পৃথিবীতে শান্তি হবেই, ইতি ঘটবে সীমাহীন ঘৃণার।
স্বামীজি বিশ্বাস করতেন শ্রীরামকৃষ্ণের হাত ধরে পৃথিবীতে শান্তি আসবে। মানুষের মন ঘৃণামুক্ত হবে। ঠিক ঠিক করে নিঃস্বার্থ ভালবাসার আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। আমরা দেখব কয়েক বছর আগে দু’টি ধর্মের মানুষদের সংঘর্ষে ইমাম সাহেবের ছেলে মারা যায়। সেই ইমামসাহেব হাত জোড় করে সবাইকে বলেন, আপনারা সংঘর্ষে লিপ্ত হবেন না, শান্ত হোন।
মা সারদামণি একদিন একটি ঘটনা দেখলেন তাঁর ধ্যানে। ঠাকুর তরতর করে নীলাম্বরবাবুর বাড়ির পাশের সিঁড়ি দিয়ে গঙ্গায় গিয়ে হারিয়ে গেলেন। স্বামীজি সেই গঙ্গাজল নিয়ে তা ছেটাচ্ছেন তীরে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য মানুষের উদ্দেশ্যে আর বলছেন জয় রামকৃষ্ণ।
পবিত্র কল্পতরু দিবসে আমাদের প্রার্থনা আমাদের মন যেন ভালবাসায় ভরে ওঠে হিংসা, অহংকার, ঘৃণার যেন সমাপ্তি ঘটে, এই বিশেষ দিনটি থেকে। আমরা যেন চৈতন্যময় হয়ে উঠি আর ছুঁতে পারি অসীমকে।