দ্বীপরাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রকৃত অর্থেই নতুন যুগের সূচনা

নির্বাচনের পর বিজয় অনুষ্ঠানের মঞ্চে দিসানায়েকে। ফাইল চিত্র

সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ের পর এবার শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্ট নির্বাচনেও জয় লাভ করল বামপন্থীরা। শ্রীলঙ্কার নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, মার্ক্সবাদী অনুরা দিসানায়েকের দল পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করেছে।‘জনতা বিমুক্তি পেরুমুনা’ (জেভিপি)-র নেতৃত্বাধীন বামপন্থী জোট ‘ন্যাশনাল পিপল্‌‌স পাওয়ার’ (এনপিপি) ২২৫ টি আসনের মধ্যে ১৫৯টি আসন পেয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ছিল ছিল ১১৩ টি আসন। অন্যদিকে, বিরোধী দলের জোট ‘সামগী জনা বালাওয়েগয়া’ (এসজেবি) জোট পেয়েছে মাত্র ৪০টি আসন।আপাতত, অনুরা দিসানায়েকের ‘বামপন্থী’ এনপিপি জোট ৬২ শতাংশের বেশি ভোট নিয়ে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে চলেছে। সাজিথ প্রেমদাসার এসজেবি জোট ১৮ শতাংশ ভোট নিয়ে দ্বিতীয় এবং পূর্বতন রাষ্ট্রপতি রনিল বিক্রমসিঙ্ঘের দল ৫ শতাংশ ভোট নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। অন্যদিকে, রাজাপক্ষে পরিবারের দল এসএলপিপি চতুর্থ স্থানে নেমে গেছে।প্রসঙ্গত, গত সেপ্টেম্বরে মাসে শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে ৪২.৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছিলেন জেভিপি-র নেতা অনুরা দিসানায়েক। ‘সামগী জনা বালাওয়েগয়া’-র নেতা সাজিথ প্রেমদাসা ৩২.৭ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে ১৭.২ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় হন।উল্লেখ্য, ২০২২ সালের শ্রীলঙ্কায় তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের সময় আরাগালয়া বিক্ষোভ আন্দোলনে নেতৃত্বের দেন অনুরা দিসানায়েক। তাঁর সফল নেতৃত্বেই ক্ষমতাচ্যুত হন গোটাবায়া রাজাপক্ষে। ২০১৯ সালে তিনি JVP-র প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও মাত্র ৩.২ শতাংশ ভোট পান।রোহানা শহীদ হওয়ার ঠিক সাড়ে ৩ দশক পরে তাঁর দল শ্রীলঙ্কার সংসদের দখল নিল প্রায় ৬২ শতাংশ ভোট পেয়ে। ২৩৫ আসনের সংসদে ‘কমিউনিস্ট’ জেভিপি-র জোট পেয়েছে ১৫৯ আসন। অবিশ্বাস্য ফল!
রনিল বিক্রমসিংঘে, মাহিন্দা রাজাপাক্ষের মতো মহারথীদের দলগুলি কার্যত মুছে গিয়েছে। প্রকৃতঅর্থেই শ্রীলঙ্কায় ‘লাল ঝড়’, অন্তত সংসদীয় রাজনীতির অর্থে তো বটেই।

কেউ আশা করেননি জেভিপি ৪০-৪৫ শতাংশের বেশি ভোট পাবে। শ্রীলঙ্কার সাংবাদিকরা বলছিলেন, সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেভিপি নেতা অনুড়া কুমারা দিশানায়েকে জয়ী হওয়ার পরেও আমলাদের বিরাট অংশ হাত গুটিয়ে বসেছিলেন। তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন সংসদ নির্বাচনের। আজকের ফল স্পষ্ট রায় দিল শ্রীলঙ্কার সর্বস্তরের জনগণ জেভিপির পক্ষে, বামপন্থীদের পক্ষে। শ্রীলঙ্কার জনগণ তাঁদের ‘পলিটিক্যাল এলিট’দের সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করলেন। দ্বীপরাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রকৃতঅর্থেই নতুন যুগের সূচনা হল।


এই ‘সর্বস্তরের’ শব্দটা জেভিপি-র জন্য বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে প্রথমবার তামিলদের বিরাট অংশ ভোট দিলেন জেভিপি-কে। পুরনো ভুলের পুনরাবৃত্তি না হলে ভান্নি এবং জাফনায় জেভিপি-র জয় শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ইতিহাসের মাইলফলক হয়ে থাকতে পারে।

রাজাপাক্ষে বিরোধী গণঅভ্যুত্থান ‘আরাগালায়া’র পরে শ্রীলঙ্কার পাহাড়ি এলাকা চষে ফেলার ফাঁকে জেভিপি-র ‘তামিল ক্ষত’ ক্রমশ সেরে উঠছিল… আসলে ‘আরাগালায়া’ বদলে দিয়েছিল শ্রীলঙ্কার সমাজকে, রাজনৈতিক দলগুলিকেও। গণঅভ্যুত্থানের পরে কোনও কিছুই আর আগের মতো থাকে না৷ আলো ও অন্ধকারের শক্তিগুলি সক্রিয়তা বাড়ায়৷ সাময়িক নৈরাজ্য পেরিয়ে বোঝা যায় পরিবর্তন ঠিক কতটা হল। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন সদর্থক। খুবই সদর্থক।

দুর্দান্ত নির্বাচনী সাফল্যের পর জেভিপি-কে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলি বাস্তবায়ন করতে হবে। আর কোনও অজুহাত দেওয়ার জায়গা নেই৷ জেভিপি-র নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কমানো। জনগণ তাঁদের পক্ষে। সেই আস্থার মর্যাদা জেভিপি দিতে পারবে কিনা তার উত্তর দেবে সময়।

অনেকে বলেন কমরেড রোহানার পথে জেভিপি এখন আর হাঁটে না। বদলে যাওয়া সময়ের উপযোগী নতুন জেভিপি দুর্দান্ত নির্বাচনী সাফল্য পেল। রোহানা কিন্তু রয়ে গিয়েছেন। জেভিপির ভিতরে কতখানি আছেন জানা নেই অনেকেরই , বাইরে তো আছেন বটেই।

২০২০ সালে অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর, বৃহস্পতিবার দ্বীপ রাষ্ট্রে প্রথমবার সংসদের ভোট ঘিরে ছিল টানটান উত্তেজনা। শ্রীলঙ্কায় সংসদের নির্বাচনে প্রায় ৬৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় ১৩,৩১৪ টি নির্বাচন কেন্দ্রে ভোটদান শুরু হয়। ভোটগ্রহণ চলে বিকেল ৪ টে পর্যন্ত।

এর আগে গত ২১ সেপ্টেম্বর শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেবার ভোটদানের হার ছিল ৭৯ শতাংশ। তার তুলনায় এবার ৬৫ শতাংশ ভোট পড়ায় কলম্বোর রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।

ভোটে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রনিল বিক্রমাসিংঘে, গোতাবায়া রাজাপক্ষে এবং মাহিন্দা রাজাপক্ষেরা দাঁড়াননি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং জোটের পক্ষ থেকেই নির্বাচনে নতুন মুখদের প্রার্থী করা হয়েছে। দিসানায়েকে বলেন, আমরা বিশ্বাস করি যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন যা শ্রীলঙ্কায় একটি টার্নিং পয়েন্ট।