কার্তিককুমার মণ্ডল
ছোটগল্পে সমাজ ও সময়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই দেখি বহু বিচিত্র সামাজিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক আন্দোলনসমূহ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশের স্বাধীনতালাভ, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের নানাবিধ সমস্যা ও সংকট বহু ছোটগল্পের সূতিকাগার। ‘সাহিত্য সমাজের দর্পণ’ বহুচর্চিত কথাটি এই প্রসঙ্গে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। সাহিত্য সৃষ্টির মূলে আছে দেশ-কাল-সমাজের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া নানাবিধ ঘটনার অভিঘাত। একে গল্প সৃষ্টির অনিবার্য প্রেরণাও বলা যেতে পারে। তাই সময়ের অনুবাদ ছোটগল্পে বারেবারেই মূর্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষকরে সময়ের দাবি তাতে নানারৈখিক ভাষ্যরূপ লাভ করে থাকে। সেদিক থেকে আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের বনেদি ভূমিকায় সময়ের পাঠটি অনেকবেশি আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে, তা সময়কেন্দ্রিক ছোটগল্পেই প্রতীয়মান।
আমাদের দেশ কৃষি নির্ভর। কৃষিই সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের প্রধান জীবিকা। তাই এই কৃষিজীবী মানুষের কথা সাহিত্যে তথা ছোটগল্পে উঠে এসেছে বারেবারে। উনিশ শতকে নীল বিদ্রোহ নাটকের দর্পণে প্রতিফলিত হয়েছে কারণ ছোটগল্প তখনও বাংলায় ভূমিষ্ঠ হয়নি। তা নাহলে হয়তো ছোটগল্পেই সর্বাগ্রে তার ছায়া কায়ারূপ লাভ করত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘মহেশ’(বঙ্গবাণী, আশ্বিন ১৩২৯) গল্পে জমিদারের শোষণে কৃষকের দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন। গল্পে শোষিত কৃষক শ্রেণির প্রতিনিধি গফুর জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করলেও বিধাতার কাছে নালিশ করে তবে সে গ্রাম ত্যাগ করেছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই প্রথম কৃষি বনাম শিল্পের দ্বৈরথে কৃষক জীবনের সংকটকে তুলে ধরায় সক্ষম হয়েছেন।
স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে কৃষি নির্ভর এই বাংলায় কৃষি ও কৃষিজীবীকে কেন্দ্র করে ঘটে গেছে দু-দুটি বৃহত্তর আন্দোলন। একটি তেভাগা আন্দোলন(১৯৪৬) অন্যটি নকশালবাড়ি আন্দোলন(১৯৬৭)। স্বাভাবিকভাবেই এই দুই আন্দোলন বাংলা ছোটগল্পকে প্রভাবিত করেছে প্রবলভাবে। তেভাগার সমকালীন সময় জ্বলন্তভাবে ফুটে উঠেছে গল্পকারদের লেখনীতে। গবেষক তুষার পণ্ডিত বলেছেন : “প্রকৃতপ্রস্তাবে শ্রেণী সচেতন গণসংগ্রামের প্রথম চিহ্ন বাংলা সাহিত্যে আঁকা হয়েছে তেভাগা তাড়িত গল্পগুলির অবয়বে। আন্দোলনের অগ্নিময় রূপ, শ্বেত-সন্ত্রাসের বিপরীতে সব-হারানো মানুষের টানটান প্রতিরোধ, ধানের স্বপ্নকামনার উদ্বেলতা, সব মিলিয়ে বাংলা ছোটগল্প পা রেখেছে নতুন অধ্যায়ে।” এক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের(১৯০৮ -১৯৫৬) ‘হারানের নাতজামাই’ ও ‘ছোটবকুলপুরের যাত্রী’ গল্পদুটির নাম প্রথমেই উল্লেখ করতে হয়। এছাড়া ননী ভৌমিকে’র ‘ধানকানা’, ‘সেলিমের মা’, ‘অর্ডার’, ‘বিজ্ঞাপণ’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বন্দুক’, সমরেশ বসু’র ‘প্রতিরোধ’, সুশীল জানা’র ‘সখা’, ‘বউ’ প্রভৃতি গল্পগুলির কথা বলা যায়। যেগুলির প্রতিটিরই প্রেক্ষিত গড়ে উঠেছে তেভাগা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।
স্বাধীনতা উত্তর পরিসরে সত্তর দশক এসছিল একটা পৃথক আত্মবিচার আর আত্ম-আবিষ্কারের দশক হিসেবে। ‘সত্তর দশক মুক্তির দশক’ রাজনীতির এই শ্লোগানে যেমন উন্মাদনা এনেছিল তেমনি একদিকে এনেছিল চরম বিপর্যয় আর অনিশ্চয়তা। মধ্যবিত্ত জীবনে এ এক চরম অস্থিরতার কাল। নকশালদের ব্যক্তিহত্যার রাজনীতি, সন্ত্রাস, জরুরি অবস্থা ঘোষণা আর রাজনৈতিক পালাবদলের ভেতর দিয়ে এ এক স্বতন্ত্র দশক। স্বাভাবিক ভাবেই বাংলা ছোটগল্পে এই সময়ের প্রতিচ্ছবি সমরেশ বসুর ‘শহিদের মা’, ‘বিবেক’, মহাশ্বেতা দেবীর ‘দ্রোপদী’, ‘অপারেশন ? বসাই টুডু’, দেবেশ রায়ের ‘কয়েদ খানা’, নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘খোঁচড়’ প্রভৃতি ছোটগল্পে উঠে এসেছে।
তেভাগা আন্দোলন, নকশালবাড়ি আন্দোলনের পথ বেয়ে একুশ শতকের সূচনা দশকে কৃষির উন্নতির পাশাপাশি যখন আধুনিক মানুষের মননে শিল্পমুখী চেতনা নিবিড়তা লাভ করেছে তখন কৃষি বনাম শিল্পের দ্বৈরথে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে ঘটে গেছে দু-দুটি সাড়া জাগানো আন্দোলন। একটি হল সিঙ্গুরের কৃষিজমি রক্ষা আন্দোলন(২০০৬) অন্যটি নন্দীগ্রামে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির আন্দোলন(২০০৭)। দুটি আন্দোলনই কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলন । একদিকে আধুনিকতার অভিমুখ অর্থাৎ শিল্পায়নের দৃষ্টি অন্যদিকে, কৃষি নির্ভরতার প্রতি দায়বদ্ধতা অর্থাৎ নিশ্চিত জীবনের হাতছানি উভয়ের ছায়া বাংলা ছোটগল্পে কায়ারূপ লাভ করেছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলন ইতিপূর্বে ঘটে যাওয়া কৃষক আন্দোলনের থেকে একটা আলাদা মাত্রা প্রদান করেছে। তেভাগা আন্দোলন ছিল ফসলের অধিকার নিয়ে জোতদারদের বিরুদ্ধে, নাকশালবাড়ির আন্দোলনও ছিল জোতদারদের কাছ থেকে উদ্বৃত্ত জমি ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু সিঙ্গুর- নন্দীগ্রামের লড়াই কৃষিজমি রক্ষার লড়াই। নিজস্ব সত্তা তথা শিকড় বাঁচানোর লড়াই। এই আন্দোলন বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে । বিশেষ করে বাংলা ছোটগল্পের নতুন অভিমুখ তৈরি করেছে। বাংলা ছোটোগল্পে সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রামের পরিসর বিস্তৃত। এত দ্রুততার সঙ্গে এই সময়ের ক্ষতকে তুলে ধরেছে বা যেভাবে বাংলা ছোটগল্পে ছায়া ফেলেছে এবং নানা গল্পের মধ্যে কায়ারূপ লাভ করেছে তা এর আগে লক্ষ করা যায়নি।
আমরা জানি, সাধারণভাবে ছোটগল্পের মধ্যে সময়ের পাঠ, সময়ের অনুবাদ, সময়ের দাবি ও সময়ের আবেদন নানাভাবে বিকশিত হয়। ইতিপূর্বে সংগঠিত কৃষিজমি রক্ষা আন্দোলন এভাবে সাড়া ফেলেনি। আন্দোলনের গভীরতা বোঝা যায় এর তীব্রতায় এবং এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবে। গল্পগুলির সংখ্যার দিকে তাকালে আন্দোলনের প্রভাবটা বোঝা যায়। মাত্র বছর তিনেকের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশটির মতো ছোটগল্প লেখা হয়েছে এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। যা তেভাগা আন্দোলন, নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময়েও হয়নি। তেভাগা আন্দোলন ও নকশালবাড়ি আন্দোলনকে নিয়ে এখনও লেখালেখি হচ্ছে তবে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের মতো ছোটগল্পে এত তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অভিমত উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন : “সব মিলিয়ে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর প্রভাবিত বাংলা গল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে বেশ অনেককাল পর বৈচিত্র্যের সন্ধান পেয়েছেন বাঙালি গল্পপাঠক। শুনতে খুব খারাপ লাগলেও বলতে দ্বিধা থাকছে না, এই নন্দীগ্রাম অথবা সিঙ্গুরের ঘটনা না-ঘটলে সম্ভবত বাংলাগল্পের ভুবন এমনভাবে নূতনের এই ঘণ্টা বাজতো না। চিরাচরিত আত্মমগ্নতার প্রাচীর (যা গ’ড়ে উঠেছিল কমল মজুমদারের হাত ধ’রে। যা এখনকার এই সময়ের ঠিক আগে-আগেই গল্পের প্রধান ছাঁদ হয়ে উঠেছিল) ভেঙে একটা অন্যরকম প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠে আসতো না সাহিত্যের পাতায়।”
শিল্পায়ন নিয়ে কোনো বিরোধ না থাকলেও তার স্থান নির্বাচন নিয়ে ঘোরতর সংকট সৃষ্টি হয়েছে এই বাংলায়। মাটি আর মানুষের অচ্ছেদ্য সম্পর্কের তীব্র সংকটে অনেকগুলি সবুজ প্রাণ হলুদ হয়ে গেছে। অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা প্রশ্ন চিহ্নের সম্মুখে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয় ‘ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়, ছোট ছোট গ্রামগুলি’তে নেমে এসেছে অশান্তির কালো ছায়া। স্বভাবতই সংবেদনশীল গল্পকার তাঁর লেখনীর আঁচড়ে সেই কালো ছায়াকে আলোর সামনে আনায় প্রয়াসী হয়েছেন । এইরকম কিছু গল্পকারের গল্প পড়ে তাঁদের মনের সদর দরজায় পৌঁছাতে বেশি সময় লাগেনি। এত স্পষ্ট ভাষায় শিল্পায়নের অনুষঙ্গগুলি এসেছে যা আগের সময়কেন্দ্রিক গল্পগুলিতে সচরাচর লক্ষ করা যায় নি। একেবারে মূলে আঘাত করার প্রবণতায় এই সময়ের গল্পগুলিকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। অনেক গল্পকার যেমন শিল্পায়ন নিয়ে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গকে সরাসরি গল্পের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করেছেন। তেমনই আবার কেউ কেউ সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামকে বিশেষিত না করেই তার সংকটকে তুলে ধরায় প্রয়াসী হয়েছেন।
বেশকিছু গল্পে সিঙ্গুর আন্দোলনের কথা এসেছে। কোনোটিতে প্রত্যক্ষভাবে আবার কোনোটিতে পরোক্ষভাবে। ২০০৬- এর ডিসেম্বরে সিঙ্গুর আন্দোলনের অব্যবহিত পরিসরেই ২০০৭-এর জানুয়ারিতে ‘এখন বিসংবাদ’ প্রকাশিত গৌতম সরকার সম্পাদিত কবিতা ও গদ্যের সংকলন ‘ভূমিরাক্ষস এবং রাজকুমার’ গ্রন্থের প্রচ্ছদে “কৃষিজমি রক্ষা আন্দোলনের প্রতি সংহতি জ্ঞাপক সাহিত্য সংকলন’ লেখা থেকে অনুমান করা যায় যে সাহিত্য জগতে এই আন্দোলনের প্রভাব ও প্রাসঙ্গিকতা কিরূপ ছিল । এই সংকলনে গদ্যাংশে তিনটি গল্পও রয়েছে । সেগুলিতে উচ্ছেদের কথাই প্রাধান্য লাভ করেছে। গল্প তিনটি হল- শর্মিলা ঘোষের ‘হেই সামালো’, সৌমেন্দ্র গোস্বামীর ‘বপন’, বিষ্ণু বিশ্বাসের ‘ছোট বকুলপুরের পরের স্টেশন’। শুধু তাই নয়, সিঙ্গুরে কীভাবে জোর করে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চলেছে তার পরিচয়ের পাশাপাশি বহিরাগত প্রতিবাদী মানুষের সাহচর্যে কীভাবে প্রতিরোধী গ্রামবাসীদের ভূমিকা সক্রিয় হয়ে উঠেছে, তার পরিচয়ও বর্তমান। তাপসী মালিকের ধর্ষিত হয়ে মৃত্যুর বিষয়টি সেদিক থেকে সিঙ্গুর আন্দোলনকে শুধু অন্যমাত্রায় নিয়ে যায়নি, সে নিজেই নারীর অপরাজিতা শক্তির আলোয় উদ্ভাসিত মানসী প্রতিমায় অভিষিক্ত হয়েছে। মধুময় পালের ‘সেই মেয়েটা জ্বলছে’ গল্পের মধ্য তার পরিচয় বর্তমান। তাপসীর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই গল্পটি লেখা। ‘জলার্ক’ পত্রিকার কলকাতা বইমেলা ২০০৭ সংখ্যায় সেটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
গল্পে মেয়েটির নাম উল্লিখিত না হলেও সে যে তাপসী, তা সহজেই অনুমেয়। তাপসীও গল্পের আধারে অসংখ্য মূর্তি ধারণ করে। কখনও সরাসরি, কখনও ব্যঞ্জনায়। তৃপ্তি সান্ত্রার ‘ছাতিয়ান তলার দিকে’(‘বারোমাস’, শারদীয়া ২০০৭) গল্পে তাপসীর ছায়া কায়া হয়ে উঠেছে। অচিন রায়ের ‘ধরিত্রী’(‘দৈনিক স্টেটসম্যান’, শারদীয়া ১৪১৪) গল্পটি সিঙ্গুর আন্দোলনের প্রেক্ষিতে লেখা হলেও সরাসরি তাপসীর নাম ব্যবহৃত না হলেও তাকে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। আবার তন্বী হালদারের ‘মানসী’তে(‘উবুদশ’ মার্চ ২০০৯) তাপসী মালিক বড়ই উজ্জ্বল। অন্যদিকে অনেক অখ্যাত গল্পকারের লেখনীতে তাপসীর উজ্জ্বল উপস্থিতি বারে বারে লক্ষ করা যায়।, জয়ন্ত পাঠকের ‘মাঝনদী’(‘উবুদশ’ মার্চ ২০০৯), সিদ্ধার্থরঞ্জন চৌধুরীর ‘এবং দাবানল হয়ে উঠছে’(‘উবুদশ’ মার্চ ২০০৯) গল্পে তাপসীর কথা সরাসরি এসেছে। অসংখ্য গল্পে তাপসী মালিকের কথা যেভাবে উঠে এসেছে, তাতে সে সিঙ্গুরের কৃষিজমি রক্ষা আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছে।
নিমাই ঘোষের ‘লাশকাটা ঘরে’, পঙ্কজ চক্রবর্তীর ‘হারাধন বাগের জন্মভূমি’, ‘লক্ষ্মীপূজার ধান’, জীবনময় দত্তের ‘জমি’, মানব মল্লিকের ‘নবজন্ম’, সিস তাতানের ‘বিপ্লবের বৈপ্লবিক রণকৌশল ও কমরেড ড্যাস’, মুর্শিদ এ এম-এর ‘হনন বিলাস’, গোবর্দ্ধন অধিকারীর ‘সিঙ্গুর’ প্রভৃতি গল্পে সিঙ্গুর আন্দোলনের প্রসঙ্গ এসেছে সরাসরি। গল্পগুলিতে উঠে এসেছে জমি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে সরকারের মিথ্যাচারের কথা। পুলিশের সাহচর্যে ক্যাডার বাহিনীর সন্ত্রাসের কথাও সেখানে লক্ষণীয়। আর এই সন্ত্রাস প্রতিরোধে কৃষকের মরণপণ লড়াইয়ের প্রসঙ্গও স্বাভাবিকভাবে উঠে আসে। নানাভাবে সেখানে জমি হারানোর অবসাদে কৃষকের আত্মহত্যার কথা, তাপসী মালিক সহ অন্যান্য শহিদদের কথাও প্রাধান্য লাভ করেছে। আবার পরোক্ষভাবে সিঙ্গুর আন্দোলনের প্রসঙ্গ এসেছে উৎপল ঝা’র ‘বিষফোঁড়া’, সুব্রত নিয়োগীর ‘জলকন্যা’, অচিন্ত্য সেনের ‘ভাগচাষী’, কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বাঘে ছাগলে’, অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর ‘হাইওয়ে’ গল্পে।
অন্যদিকে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সুতীব্র গভীরতা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠেছে। তার প্রতিরোধ প্রকৃতিতে যুদ্ধের যে আবহ তৈরি হয়েছিল, তা শুধু ঐতিহাসিকই নয়, গণআন্দোলনের নব দিগন্তেরও সূচনা করেছে। তার প্রভাবে থিতিয়ে যাওয়া সিঙ্গুর আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। এপ্রসঙ্গে সিদ্ধার্থ বসু’র ‘সূর্যোদয়ের আগে’, তৃষিত বর্মণের ‘অলীক সূর্যোদয়’ গল্পদুটি স্মরণীয়। গণমাধ্যমের প্রত্যক্ষ সম্প্রচারের দৌলতে নন্দীগ্রামের ১৪ মার্চের নারকীয় ঘটনার ছবি জনমানসে ছড়িয়ে পড়ে। নন্দীগ্রামের বীভৎস তাণ্ডবের প্রতিক্রিয়া সচেতন নাগরিককে কীভাবে প্রভাবিত করেছে, তারই পরিচয় উঠে এসেছে জয়ন্ত দে’র গল্পে। গল্পকার জয়ন্ত দে ২৫ মার্চ ২০০৭, ‘বর্তমান’ পত্রিকায় আকাড়া ভাবে নন্দীগ্রামে গণহত্যার প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন তাঁর ‘নির্বাণ’ গল্পে। এতে উঠে এসেছে টি.ভিতে দেখা ১৪ মার্চের সেই ভয়াবহ পাশবিক দৃশ্যের প্রসঙ্গ। সেদিনের নন্দীগ্রামের রক্তাক্ত পরিসরে নারীর প্রতি নিদারুণ বর্বরতার ছবি ‘মীনাক্ষী সেনের ‘অবতার’(‘বর্তিকা’, উৎসব সংখ্যা ১৪১৪) গল্পে উঠে এসেছে। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির কর্মী রাধারানী আড়ি স্বনামে উঠে এসেছে। তাঁকে তাপসীর মতো পুড়িয়ে মারা হয়নি ঠিকই, কিন্তু বেঁচে থেকে বাঁচার লজ্জা মৃত্যুর অধিক হয়ে উঠেছে তাঁর কাছে। রাধারানীর সেই সংগ্রামী ভূমিকা অবশ্য জনমানসে অহঙ্কারের উৎস হয়ে ওঠে, সে স্বনামেই কল্পজগতে আমজনতার কাছে দেবীত্বে উন্নীত হয়েছে, সেটাই গল্পে উঠে এসেছে।
আবার ১৪ মার্চ ২০০৭ এ নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিতে চোদ্দজন নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, তারই প্রতিচ্ছবি অমর মিত্রের ‘একা এবং কয়েকজন’ (শারদীয় ‘বারোমাস’, ২০০৭) গল্পে উঠে এসেছে। এছাড়াও দেবাশিস রায়চৌধুরীর ‘শীতঘুম’, তৃপ্তি সান্ত্রার ‘গিরির বাজারের দিকে’, অলক ঘোষের ‘নকল’, জুলফিকার সুসাং এর ‘প্রতিরোধ’, সুশোভন মুখোপাধ্যায়ের ‘মিছিল’, নলিনী বেরার, ‘চুপ্, এক মিনিট নীরবতা চলছে’, অতীন জানার ‘সটীক বর্ণপরিচয়’, মধুময় পালের ‘সূর্যোদয়ের বিধবা’ প্রভৃতি গল্পে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের কথা নানাভাবে উঠে এসেছে। আবার সমীর রক্ষিত তাঁর ‘জন্মক্রন্দন’ গল্পে নাম না করে নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন।
বেশকিছু ছোটগল্পে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম উভয় আন্দোলনের কথাই একই উঠে এসেছে । যেমন, ‘জীবনবাবুর জীবনতৃষ্ণা’(‘উবুদশ’, মার্চ ২০০৯) গল্পে শুকদেব চট্টোপাধ্যায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পরবর্তী ট্রেড ইউনিয়নের বাস্তব চিত্রকে তুলে ধরায় সচেষ্ট হয়েছেন। তেমনই জুলফিকার সুসাং নন্দীগ্রামের পাশে কীভাবে সর্বস্তরের মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে তারই ছবি তুলে ধরেছেন ‘প্রতিরোধ’ (‘উবুদশ’, নভেম্বর ২০০৯) গল্পে। সিঙ্গুর যা করতে পারেনি নন্দীগ্রাম সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রথম থেকে কীভাবে প্রতিরোধে সামিল হয়েছে সেকথা গল্পে উঠে এসেছে। নন্দীগ্রামের গণ-আন্দোলনে বিপ্লবী বাহিনীর ভূমিকাটিও দেখিয়েছেন গল্পকার। আবার সিদ্ধার্থ সাহা’র ‘সংগ্রাম’ গল্পেও দেখি সর্বস্তরীয় প্রতিবাদের চিত্র। সেখানে দেখি শুধু কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরাই রাজ্যব্যাপী তোলপাড় করেনি, ছাত্র-যুব সমাজও তোলপাড় হয়েছে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। গল্পে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে ঘটে যাওয়া শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এর প্রতিবাদে সামিল হয়েছে তাও দেখিয়েছেন গল্পকার। আবার ‘নাম’ গল্পে সুরঞ্জন প্রামাণিক লোকখেলার আঙ্গিকে জমি অধিগ্রহণের কথাকে তুলে ধরেছেন। কৃষকের জমি হারানোর যন্ত্রণাকে ‘ইলাটিন বিলাটিন সই লো’ নামের লোকছড়ার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন। গল্পে নাম না করে উঠে এসেছে তাপসী মালিকের প্রসঙ্গ, ‘একদিন ভোরবেলা কেউ একজন দেখলো ঝল্সানো এক মেয়ে পড়ে আছে মাঠের মধ্যে’।
সার্বিকভাবে গল্পগুলির আলোচনার শেষে আমরা দেখতে পাই গল্পগুলিতে আন্দোলনের প্রসঙ্গ এসেছে নানাভাবে। গল্পগুলিতে কখনও উঠে এসেছে জমি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে সরকারের মিথ্যাচারের কথা আবার পুলিশের সাহচর্যে ক্যাডার বাহিনীর সন্ত্রাসের কথাও সেখানে লক্ষণীয়। আর এই সন্ত্রাস প্রতিরোধে কৃষকের মরণপণ লড়াইয়ের প্রসঙ্গও স্বাভাবিকভাবে উঠে আসে। নানাভাবে সেখানে জমি হারানোর অবসাদে কৃষকের আত্মহত্যার কথা, তাপসী মালিক সহ অন্যান্য শহিদদের কথাও প্রাধান্য লাভ করেছে। মিডিয়া রাজনীতি, ক্যামেরার সামনে নেতাদের মিথ্যাভাষণ, বুদ্ধিজীবীদের সংগ্রামী ভূমিকার সঙ্গে দোলাচলতাও গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে।৫ সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে লেখা গল্পগুলিতে উল্লিখিত বিষয় সচেতনভাবে কোথাও না কোথাও এসেছে। তবে একটা গল্পে সব বিষয় না থাকলেও সমগ্র গল্পগুলি একত্রিত করলে গল্পের মধ্যেই আমরা পেতে পারি সেই সময়ের ইতিহাস-রাজনীতি-অর্থনীতিকে। অন্যদিকে তেভাগা আন্দোলন, নকশালবাড়ি আন্দোলনের ইতিহাস যেভাবে সময়ের সাহিত্যে দলিল হয়ে উঠেছে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনের ইতিহাসও তেমনই তার সাহিত্যে অতিদ্রুততায় নিবিড়তা লাভ করেছে। সেই সময়ের অনুবাদের আলোয় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনকেন্দ্রিক ছোটগল্পগুলি আপনাতেই পক্ষে-বিপক্ষের বহুমুখী চেতনার ফসলে আবেদনমুখর হয়ে উঠেছে। সেখানে সাহিত্যের অন্যান্য শাখার চেয়ে ছোটগল্পের অবদান অনেক বেশি মনে হয়। সীমিত পরিসরের মধ্যেই তার সময়ের ভাষাচিত্র সজীবতা লাভ করায় তার আবেদন সহজেই মূর্ত হয়ে উঠেছে। সেদিক থেকে গল্পগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য মনে হয়।
১. অনিল আচার্য (সম্পাদনা), ‘সত্তর দশক’ (খণ্ড দুই), অনুষ্টুপ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৪
২. অভিজিৎ সেনগুপ্ত (সংকলন ও সম্পাদনা) ‘উচ্ছেদেরগল্প’, পিপলস্ বুক সোসাইটি, কলকাতা, ১ম প্রকাশ : মার্চ ২০০৮
৩. নির্মল ঘোষ, ‘নকাশালবাদী আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য’, করুণা প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ : ১৩৮৮
৪. বিতনু চট্টোপাধ্যায়, ‘নন্দীগ্রাম – আসলে যা ঘটেছিল’, পত্রভারতী, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৬
৫. মধুময় পাল (সংকলন ও সম্পাদনা) ‘সিঙ্গুরে কৃষিজমি অধিগ্রহণ ও তার প্রতিবাদ- একটি অসম্পূর্ণ দিনলিপি’, আবাদভূমির আগুনবীজ(সিঙ্গুর আন্দোলনের দলিল) , দীপ প্রকাশন, প্রথম প্রকাশ :জানুয়ারি ২০১৭,
৬. সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিক্ষুব্ধ বাঙলা :পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী রাজনীতি (১৯৪৭-২০০৭), র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর ২০১৪
৭. সুকুমার মিত্র, ‘নন্দীগ্রাম ও জঙ্গলমহল : গণ প্রতিরোধের দিনলিপি’, নেক্সাস পাবলিকেশন, প্রথম প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০১২