শিলিগুড়ির বনেদি বাড়ি ও মাতৃপুজো

শিলিগুড়ির কয়েকটি বনেদি পুজোর অন্যতম ৮৩ বছরের প্রাচীন ‘রায় বাড়ির দুর্গাপুজো’। ‘শিলিগুড়ির প্রাচীন দুর্গাপুজো’ প্রসঙ্গে বলা যায় উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে জোতদার দর্পনারায়ণ সিংহ হরসুন্দর জোত-এ (বর্তমানে মিলনপল্লী) নিজের বাড়িতে প্রথম দুর্গাপুজো করেছিলেন। একসময় ‘হাসমি চক’ই ছিল ‘শিলিগুড়ি রোড স্টেশন’। ১৯১৭ সালে এই স্টেশন সংলগ্ন স্থানেই ইবি রেলের হেড ক্লার্ক সূর্যনারায়ণ চক্রবর্তীর উদ্যোগে প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। যা পরবর্তী ১৯২৪ সালে বর্তমান টাউন স্টেশনের রেল কোয়ার্টার্স এলাকায় সরিয়ে আনা হয়। সূর্যনারায়ণ চক্রবর্তী ছিলেন শিলিগুড়ি বারোয়ারি পূজোর পথিকৃৎ। দ্বিতীয় প্রাচীন পুজোটি হল ‘তৃপ্তি টকিজ’-এর (বর্তমানে মিত্র সম্মিলনী) দুর্গাপুজো, যা ১৯২৭ সালে বিশিষ্ট আইনজীবী সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের উদ্যোগে ও মিত্র সম্মিলনীর সদস্যদের সহযোগিতায় শুরু হয়েছিল।

ডা. রসিকলাল ঘোষের বাড়ির বহির্প্রাঙ্গণে ১৯৩২ সালে তৃতীয় প্রাচীন দুর্গাপুজোটি দু’বছর অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৩৪ সালে আনন্দময়ী কালীবাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়। এই সর্বজনীন পুজোর মুল ছিলেন ডা. ব্রজেন্দ্রকুমার বসু রায় চৌধুরী, শিউমঙ্গল সিং এবং ধীরেন্দ্রনাথ রায়। চতুর্থ প্রাচীন দুর্গাপুজোটি ৭৬, বিধান মার্কেট রোডের ঐতিহ্যবাহী ‘রায় বাড়ির দুর্গাপুজো’। ১৯৪২ সালে সুপ্রকাশ রায়ের উদ্যোগে পুজো শুরু হয়েছিল এবং বর্তমানে ধারাবাহিকভাবে পুরনো প্রথা মেনে সাবেকি একচালা মূর্তিতে অত্যন্ত সাড়ম্বরে মা দুর্গার পুজো হয়ে থাকে।

ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর আগে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইত্যাদি অশান্ত পরিস্থিতিতে প্রাণভয়ে ‘রায় পরিবার’ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তাদের জন্মভিটে ছেড়ে কাঠের ট্রেনে শিলিগুড়িতে চলে আসে এবং ইঙ্গ-নেপালি খ্রিষ্টান জর্জ মেহবার্ট-এর বাড়িতে ভাড়া থাকতে শুরু করে। পরবর্তীকালে জর্জ মেহবার্টের জমি থেকে সাড়ে আট কাঠা জমি ক্রয় করে শিলিগুড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে তারা। জর্জ মেহবার্ট ছিলেন যথেষ্ট প্রতিপত্তি সম্পন্ন। তিনি ১৯২৫-২৬ সালে তৎকালীন শিলিগুড়ি মহকুমা শহরের স্যানিটারি কমিটির সভাপতি ছিলেন। ১৯৪২ সালে এই বাড়িতেই প্রথম দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়।
সেদিনের শিলিগুড়ি ছিল অন্যরকম। ঘন জঙ্গলে আবৃত, বিরাট বিরাট গাছ, লতাগুল্ম, ঝোপঝাড, হাতির দল, হিংস্র জন্তু, বন্য শূকর ও কুকুর। ঘরের আশপাশে শেয়ালের ডাক শোনা যেত। লোকসংখ্যা ছিল নিতান্ত কম। ১৯২০ সালে ‘আমার বিপ্লব জিজ্ঞাসা’ গ্রন্থে সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার লিখেছেন, ‘শিলিগুড়ি ছিল ছোট্ট গ্রাম…ক্ষীণ স্রোতা পঞ্চনই নদী মহানন্দার দিকে এগিয়ে চলেছে…উপরের সমস্তটা জুড়ে চাঁদমনি ফরেস্ট…ফরেস্ট শেষ হয়েছে মাটিগাড়া রোডের ওপর। বাঘের ভয়ে হাটের দিন ছাড়া কেউ সে পথে একলা চলতে সাহস করত না।’


যদিও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে নগরায়নের দিকে এগিয়েছে শিলিগুড়ি। অর্থনৈতিক উন্নতির তাগিদে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে প্রচুর কিন্তু সেদিনের পারিবারিক শাসনব্যবস্থার মধ্যেই উন্নতির প্রজন্ম বড় হচ্ছিল ছোট ছোট আনন্দের মধ্য দিয়ে। আমরা সিন্ধু সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কথা জানতে পারি কিন্তু ‘রায় বাড়ি’র পরিবেশ ছিল মাতৃপ্রধান। সুপ্রকাশ রায়ের আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশের পাবনা জেলায়। দেশভাগের আগে দু’ভাই রায়গঞ্জ এবং শিলিগুড়ি চলে এলেও তৃতীয় ভাই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হয়ে আমেরিকায় চলে যান। তিনি ছিলেন একজন লেখক। স্বভাবে সুপ্রকাশ রায় শান্ত, ধীর, স্থির। অপরদিকে তার স্ত্রী শ্যামাঙ্গিনী রায় ছিলেন অত্যন্ত দাপুটে। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার জমিদার রাধিকাপ্রসন্ন মজুমদারের একমাত্র সন্তান শ্যামাঙ্গিনী রায়। সেই সময় পড়াশোনায় বৃত্তি পাওয়া শ্যামাঙ্গিনী রায় ছিলেন বুদ্ধিমতী এবং বৈষয়িক চিন্তার অধিকারী। যার সুফল এখনকার প্রজন্ম এখনও ভোগ করে চলেছে। শোনা যায়, হাতির পিঠে চেপে তিনি বাপের বাড়ি যাওয়া-আসা করতেন এবং নিজের বাড়ি ফিরে আসতেন নানা ধরনের খাদ্য, বাচ্চাদের সারা বছরের জামা কাপড় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে। নিজস্ব বুদ্ধি- বিবেচনা, কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা, অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি তার পারিবারিক শাসন পরিচালনা করেছেন। তাঁর ছয় ছেলে, তাদের স্ত্রী এবং সন্তান মিলে পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৩০-এর উপরে। সে সময় কাঠের পিঁড়িতে বসে খাবার খাওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। প্রত্যেকের পিঁড়ি, গ্লাস আলাদা। যার যার গ্লাস ও পিঁড়িতে তার তার নাম লেখা থাকতো। শিলিগুড়ি শহর জুড়ে তখন ছোট ছোট কাঠের বাড়ি, সে সময় কংক্রিটের তিনতলা বিল্ডিং তুললেন তিনি।

নিচতলায় দোকানঘর ভাড়া দিলেন। নাতি-নাতনির পড়াশোনার তত্ত্বাবধান করতেন নিজেই। শুধু তাই নয়, বাড়ির পুরুষরা কাজে বেরিয়ে গেলে বাচ্চারা দরকারে অদরকারে তাদের মায়েদের কাছে আবদার করে; কখনো হাতি-ঘোড়ার মতন ছোট ছোট বিস্কুট, আইসক্রিম, টিকটিকি চকলেট, বায়োস্কোপ দেখার বায়না আবার কখনো বাচ্চাদের জন্য পেন, পেন্সিল, বই-খাতা কেনারও প্রয়োজন পড়ে। তাই দোকান ভাড়ার টাকা যাতে প্রতিমাসে বাড়ির বউদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার ব্যবস্থা হয় সেইজন্য উইল করলেন। যা বর্তমানেও প্রযোজ্য। তিনি জানতেন, একসময় এই একান্নবর্তী সংসার নাও থাকতে পারে। পরিবারে ভাঙন, বিচ্ছেদ আসতেই পারে। কিন্তু তার ছ’টি সন্তান ও তাদের পরিবার যাতে একটি সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে থাকে, একসঙ্গে থাকে, তাই উইলে লিখলেন, ৬জন সন্তান এবং তাদের পরিবার একই জমিতে নিজস্ব ঘরগুলিতে বসবাস করবে কিন্তু তারা যদি ভাবে, তাদের আয়ত্ত্বাধীন বাড়ি ছেড়ে বা বিক্রি করে অন্য কোথাও যাবে, তবে সেক্ষেত্রে ঘরগুলিতে নতুন ভাড়া যেমন বসানো যাবে না তেমনি বিক্রিও করা যাবে না, যা তাঁর দূরদর্শিতাকে প্রমাণ করে।

অত্যন্ত স্নেহপরায়ণ কিন্তু কঠোর, ভক্তিপ্রবণ শ্যামাঙ্গিনী রায় প্রায় সকল লোকিক ব্রত পালন করতেন। চাপড় ষষ্ঠী, মূলা ষষ্ঠী, নবান্ন, পৌষ-পার্বণ, মনসা পূজো, শিবরাত্রি, অন্যান্য। পৌষ সংক্রান্তিতে গোবর দিয়ে উঠোন লেপে খুব ভোরে সূর্যোদয়ের আগে স্নান সেরে উঠোনের মাঝখানে চালের গুঁড়ো দিয়ে পুষনা-পুষনি এঁকে মাটির সরা পুড়িয়ে চালের পিঠে বানিয়ে গরুদের খাওয়ানোর প্রথা ছিল। তারপর উঠোনময় সারাদিন ধরে চলতো চিতই পিঠে, নকশী পিঠে, বকুল পিঠে, চুসি পিঠের পায়েস, দুধপুলি, নকশী পাটিসাপটা, মুগপুলি, লবঙ্গ লতিকা এবং বাচ্চা থেকে বড়দের কিচিরমিচির।

দুর্গাপুজোয় তিনি নির্জলা উপবাস করতেন। পুজোর প্রতিটি কাজ নিখুঁতভাবে করতেন বা করার নির্দেশ দিতেন। রায় বাড়ির দুর্গাপুজোর প্রথম পুরোহিত ইন্দ্রভূষণ ভট্টাচার্য আসতেন কুশুমন্ডি থেকে। টোলের পণ্ডিত ছিলেন তিনি। সংস্কৃত পড়াতেন। দীর্ঘ ৩৭ বছর ‘রায় বাড়ি’র পুজো করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র সুব্রত গোপাল ভট্টাচার্য (প্রসাদ ভট্টাচার্য) এযাবত পুজো করে আসছেন।

প্রথমদিকে বাংলাদেশের বগুড়া থেকে ঢাকিরা আসতো। দেশভাগের পর ঢাকিরা রায়গঞ্জে চলে এলে পরম্পরা অনুযায়ী তারাই রায় বাড়িতে ঢাক বাজাতো। কিন্তু বর্তমানে তাদের বংশধররা ঢাক বাজায় না, ফলে কুশুমন্ডি থেকে ঢাকিদের আনা হয়।
সাবেকি একচালা মূর্তি উচ্চতা ও চওড়ায় ১২/১৬ ফুট। দুর্গা প্রতিমার বড় বড় ঢাকেশ্বরী চোখ। গায়ের রং বাসন্তী বা উজ্জ্বল হলুদ। সোলার অলংকারে অলংকৃত মা। অসুরের পোশাকে ভেলভেটের ওপর জরির কাজ। শিল্পী নিপুণ হাতে তার শিল্পত্ব তুলে ধরেন সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।

প্রাচীন রীতি মেনে রথের দিন দেবীর কাঠামো পুজো করা হয়। পঞ্চমীতে পঞ্চমীর ঘট স্থাপন ও দেবীর বোধন। ষষ্ঠীতে ষষ্ঠীর ঘট স্থাপন। যেহেতু পুরাণ অনুযায়ী, ষষ্ঠীর দিন মা দুর্গা বেলতলায় বিশ্রাম নেন, তাই ছোট্ট বেলতলা তৈরি করা হয়। মা দুর্গাকে বরণ করে আসনে তোলার পর তাকে সুসজ্জিত করা হয় গয়না এবং অস্ত্রে।

রায় বাড়ির দুর্গাপুজোর বিশেষ আকর্ষণগুলি হলো, প্রতিমা বরণ, ঢাক-ঢোল-কাশি-ঘন্টা-শঙ্খ-উলুধ্বনি সহযোগে নবপত্রিকা স্নান, মহা অষ্টমীর পূজোয় ১০৮টি প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, নবমীর যজ্ঞ ও ভরা তোলা, দশমীর বিসর্জন মন্ত্র উচ্চারণ এবং অপরাজিতা পূজো। লাল-হলুদ অথবা লাল-সাদা শাড়ি, শাখা-সিঁদুর-আলতা পায়ে গৃহিণীরা মা দুর্গাকে বরণ করে যেমন আসনে তোলে তেমনি নবপত্রিকা স্নান করাতে মহাস্নানের কলস কোমরে নিয়ে মহানন্দা নদীতে হেঁটে যায় খালি পায়ে। এক্ষেত্রে গৃহিণীদের সংখ্যা বেজোড় হতে হয়। দশমীতে ৫, ৭ অথবা ৯টি পুঁটি মাছ কিংবা ইলিশ মাছ মায়ের সম্মুখে সাজিয়ে দেওয়া হয়। যাত্রাকালে মৎস্য দর্শন শুভ হিসেবে মানা হয়। এরপর হয় অপরাজিতা পুজোর আয়োজন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, বাড়িতে কারো মৃত্যু হলেও পুজো বন্ধ থাকে না। নির্দিষ্ট পরিবারটি ছেড়ে (যার ঘরে মৃত্যু হয়েছে) বাদবাকি সদস্যরা এই পুজোয় সমানভাবে অংশগ্রহণ করে।
মহিলাদের সিঁদুর খেলা, নাচ-গানের মাধ্যমে প্রতিমা নিরঞ্জন হয় মহানন্দা ঘাটে। ঘরে ফিরে মিষ্টি মুখ।

একদিন চাষ-আবাদের মধ্য দিয়ে লোকায়ত প্রভাবে যে ধর্মবিশ্বাসে শক্তির আধার হিসেবে যোনি ও লিঙ্গ পুজো শুরু হয়েছিল তা সময়ের বিবর্তনে মূর্তি পূজোর আকার নিয়েছে। পুজোর অপব্যবহার বা ভুল প্রচার পরিবারের মানুষ ও প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে সেই ধারণা থেকে তৈরি হয়েছিল নিয়ম-নিষ্ঠা, আচার-উপাচার। আমাদের পূর্বপুরুষরাও একই দৃষ্টিভঙ্গিতে ভক্তিভরে পরিবারের কল্যাণ ও বংশবৃদ্ধির কামনায় মাতৃ পুজোর পাশাপাশি বিভিন্ন লৌকিক দেব-দেবীর পুজো করে আসছে।
‘রায় বাড়ি’ও তার ব্যতিক্রম নয়।