স্বৈরাচারী শাসনের লক্ষণ

লোকসভা নির্বাচনে কার্যত ভরাডুবির পর কিছুদিনের মধ্যেই লোকসভা ও বিধানসভায় উপনির্বাচনে ধাক্কা খায় মোদির দল বিজেপি। এখন চলছে কাশ্মীর ও হরিয়ানায় বিধানসভা নির্বাচন। এই দুই রাজ্যেই মোদীর দলের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত। এরপরই হবে মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডে নির্বাচন। সেখানেও দলের জেতার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বছর ঘোরার পরই হবে আরও কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচন। সেখোনেও ভাল ফল নিশ্চিত নয়। অর্থাৎ গত লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই মোদী-শাহের নেতৃত্বে আরএসএস-বিেজপির দুঃসময় শুরু হয়েছে। এর থেকে বের হওয়ার জন্যই আনাবশ্যক ও অবাস্তব বিষয়ে বিতর্ক তৈরি করে নজর ঘোরানোর চেষ্টা করছে মোদী সরকার।

নির্বাচন কাছাকাছি এলেই কোনও একটা চমক বা হুজুগের কথা মনে পড়ে যায় মোদী-শাহদের। নির্বাচনে মূল ইস্যু থেকে নজর যথাসম্ভব ঘুরিয়ে দিতে পারলে মানুষ বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, কৃষকের সমস্যা, রুজি রোজগোরের সমস্যা নিয়ে বেশি ভাবনা-চিন্তা করার সুযোগ পাবে না। তাতে আখেরে লাভ বিজেপির। তাই অনেক হিসেব নিকেষ করেই ‘এক দেশ এক ভোট’ নামে এক অবাস্তব কল্পনাকে নতুন মোড়কে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে পরিস্থিতি মাপার জন্য।

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সবচেয়ে খারাপ সময় যাচ্ছে মোদী-শাহ জুটির। গত লোকসভা নির্বাচনে ৪০০-র বেশি আসনে জিতে অনন্য নজির গড়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রঙিন স্বপ্নে বিভোর করেছিলেন দেশবাসীকে। কিন্তু দেশের জনগণ সেই স্বপ্নে ছাই দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকেও বহু দূরে সরিয়ে ২৪০ আসনে াটকে দিয়েছেন। মোদী তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলেও শরিকদের কাঁধে ভর দিয়ে তাঁকে দাঁড়াতে হচ্ছে। ফলে তাঁর সেই দম্ভ, হাতে মাথা কাটার সেই ঔদ্ধত্য হওয়ায় উঠে গিয়েছে। এখন তাঁকে কথা বলতে হয় ও সিদ্ধান্ত নিতে হয় শরিক দলের নেতাদের মুখের দিকে তাকিয়ে। মোদীর সেই আমিত্ব, সেই ম্যাজিক ভাবমূর্তি, সেই জনপ্রিয়তা এখন আর নেই। এই অবস্থায় পরবর্তী নির্বাচনগুলিতে এবং পাঁচ বছর পর লোকসভা নির্বাচনে মোদীকে সামনে রেখে ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীন। অতএব নতুন নতুন চমক হাজির করে মূল ইস্যু থেকে আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে কৌশলে কাজ হাসিল করা ছাড়া বিকল্প নেই। ‘এক দেশ এক ভোট’ তেমনই এক নজর ঘোড়ানোর চমক।


ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাংবিধানিক কাঠামো ভেঙে তছনছ করে দিয়ে আরএসএস ও বিজেপির অভীষ্ট একদলীয় একনায়কতন্ত্রী ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে একদশক আগে থেকেই ‘এক দেশ এক ভোট’ নামক স্লোগানটি বাজারে ছাড়া হয়েছিল। আরএসএস প্রচারিত এক দেশ, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি, এক দল, এক নেতা, এক সরকার—এরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হল ‘এক দেশ এক ভোট’। লক্ষণীয়, এতদিন একচ্ছত্র ক্ষমতা ও দাপট থাকলেও এই তত্ত্বের রূপায়ণে কোনও উৎসাহ দেখা যায়নি। গত লোকসভা ভোটের আগে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে উচ্চ ক্ষমতার এক কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এই প্রশ্নে বিস্তারিত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য। সরকারের প্রত্যাশা মতই কোবিন্দ কমিটি ভোটের আগেই রিপোর্ট দেয় সরকারি উদ্যোগে পূর্ণ সায় দিয়ে।

উগ্র জাতীয়তাবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে ‘এক দেশ এক ভোট’ এই শব্দ বন্ধের মধ্যে। বহু জাতি, বর্ণ, ধর্ম, সম্প্রদায়, সংস্কৃতি, ভাষার দেশ ভারতে যান্ত্রিকভাবে, কোনও ঐক্য বা সংহতি গড়ে উঠতে পারে না। এখানে বহুত্বের মধ্যে সমন্বয়ই ঐক্য বা সংহতির মূল ভিত্তি। ভারতের সাংবিধানিক কাঠামো সেই ভিতের উপরই নির্মিত। সেই কাঠামোর দুই বাহু যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের অধিকার ও কাজ সংবিধান আলাদা করে দিয়েছে। পুরোপুরি ভিন্ন বিষয় নিয়ে লোকসভা ও বিধানসভার ভোট হয়। প্রতিটি রাজ্যের চরিত্র ভিন্ন। স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেই সেখানে গণতন্ত্রের উৎসব উদযাপন হয়। তাই সব কিছুকে এক ছাঁচে ফেলা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে বিকশিত করতে এবং গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে একসঙ্গে ভোট পুরোপুরি অবাস্তব। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বুটের তলায় দেশকে বন্দি করতেই এই ‘এক দেশ এক ভোট’ প্রস্তাবের অবতারণা। একদলীয় স্বৈরাচারের এই লক্ষ্য কখনই পূরণ হবে না।