পঙ্কজকুমার চট্টোপাধ্যায়
রবীন্দ্রোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শরদিন্দু সম্বন্ধে একবার বলেছিলেন— ‘শরদিন্দুর মতো ঐতিহাসিক কল্পকাহিনি কে রচনা করবে, কে তার তুল্য বাতাবরণ সৃষ্টি করবে, বুদ্ধি ও কৌতুক রসে সিঞ্চিত ভাষার ব্যবহার করবে? … তাঁর গদ্যের মধ্যে পাওয়া যায় এক ভিন্ন স্বাদ— আমি তাঁকে একান্তভাবেই ভালোবাসি…৷’ মৃতু্যর ৫৩ বছর পরেও শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রিয় সাহিত্যিক৷ হাল সময়ে রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তা তাঁর কাছে কিছু নয়৷ তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশকে নিয়ে কী না হচ্ছে৷ এই চরিত্র শরদিন্দুর জনপ্রিয়তাকে বহুমাত্রিকতা দান করেছে৷ গল্প এবং উপন্যাসের বই তো বিক্রি হচ্ছেই, এর সঙ্গে চলছে ফি বছর কোনও না কোনও চলচ্চিত্রের রূপায়ণ৷ আর চিত্রশিল্পী ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্যের হাত ধরে ব্যোমকেশ চরিত্র নিয়ে কমিক সিরিজ প্রকাশ করেছে আনন্দ পাবলিশার্স৷ এছাড়া ভয়ের সিরিজ ‘অলৌকিক’ নিয়েও ওঙ্কারনাথ কাজ করেছেন৷
বাবার ছিল বদলির চাকরি৷ জৌনপুরে ১৮৯৯ সালের ৩০ মার্চ শরদিন্দুর জন্ম হয়৷ তাঁদের আদি বাড়ি নাকি বরাহনগরে৷ কিন্ত্ত সারাজীবন বাংলার বাইরেই কাটিয়েছেন৷ সত্যাণ্বেষী ব্যোমকেশ এবং ভূতাণ্বেষী বরোদা আবিষ্কারের সময় তিনি মুঙ্গেরে কাটিয়েছেন অনেক দিন৷ তারপরে বোম্বাইয়ে চলে যান হিমাংশু রায়ের আমন্ত্রণে ১৯২৮ সালে৷ ১৯৫২ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রের জন্য কাহিনি লিখেছেন৷ তারপর পুণেতে পাকাপাকি বসবাস করেন৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পরে তিনি আইন পড়তেও গিয়েছিলেন৷ বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াকালীন তাঁর ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন শিশির ভাদুড়ি৷ তাঁর প্রথম কর্মজীবন শুরু হয় হুগলি মহসীন কলেজে ইংরাজির অধ্যাপক হিসেবে৷ বেশিদিন তিনি সেই কাজ করেননি৷ পূর্ণসময়ের জন্য লেখকের ভাগ্যই তাঁর জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন ভাগ্যদেবী৷
১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘যৌবনের বন্ধু’৷ ওই বছরেই প্রকাশিত হয় ব্যোমকেশ চরিত্র নিয়ে প্রথম উপন্যাস ‘সত্যান্বেষী’৷ আর এই জনপ্রিয় চরিত্র নিয়েই তিনি লেখেন ৩২টি উপন্যাস-গল্প৷ পাল্লা দিয়ে ভূতাণ্বেষী বরোদাকে নিয়েও বেশ কয়েকটি গল্প-উপন্যাস লেখেন৷ ‘ব্যোমকেশ ও বরোদা’ উপন্যাসে ব্যোমকেশের সত্যাণ্বেষণের কাছে হার হয় ‘ভূতাণ্বেষী’ বরোদার৷ কিন্ত্ত ‘শৈলশহর’ উপন্যাসে ব্যোমকেশকে নিয়ে অশরীরীর সাহায্য নিতে হয় রহস্য উন্মোচনে৷ ঐতিহাসিক উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘গৌড়মল্লার’, ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’, ‘ঝিন্দের বন্দি’ এবং ‘কালের মন্দিরা’৷ শেষ উপন্যাসটি শরদিন্দু শুরু করেন ১৯৩৮ সালে মুঙ্গেরে৷ আর শেষ করেন ১৯৪৮ সালে বোম্বাইতে৷ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন শরদিন্দু৷ কিন্ত্ত তাঁর নিজের আলাপচারিতায় জানা গেছে যে ‘কালের মন্দিরা’ উপন্যাস শেষ করে তিনি দাবি করেছিলেন এটি তাঁর সর্বোত্তম প্রাপ্তি৷ তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রেক্ষাপট প্রাক-আর্য যুগ থেকে মৌর্য যুগ, গুপ্ত যুগ থেকে মুঘল যুগ— এতটাই ছিল তাঁর ব্যাপ্তি৷ প্রেম, রহস্য, কাহিনির অত্যাশ্চর্য আকস্মিক মোড় তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলিকে এমন মাত্রা দিয়েছে যে তাঁর পরে এমন ব্যাপ্তি এবং গভীরতা কোনও ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিক এখনও দেখাতে পারেননি৷ তিনি বলেছেন যে তাঁর উপন্যাসগুলি কাল্পনিক ইতিহাস নয়, বরং ঐতিহাসিক কল্পনা৷ শিশুদের কাছে তিনি উপহার দিয়েছিলেন আর একটি চরিত্র শিশু নায়ক সদাশিবকে কেন্দ্র করে শিশুসাহিত্য৷
এবার প্রথাগত জীবনকথার বাইরে চলে আসব৷ ১৭ বছর বয়সে প্রেসিডেন্সি কলেজে সত্যজিৎ রায়ের সহপাঠী শরদিন্দুর সমস্ত সাহিত্যকর্মের একমাত্র স্বত্বাধিকারী প্রদীপ চক্রবর্তীর পিতা বোম্বাইয়ের মালাডে যান৷ তিনি জানতেন না সেখানে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থাকেন৷ তিনি তাঁর বাড়িতে একদিন সকাল সাড়ে ছটার সময় গিয়ে পেঁৗছন৷ শরদিন্দুর স্ত্রী তাঁকে জানান যে দশটার আকে শরদিন্দু ঘুম থেকে ওঠেন না৷ বাইরে ঠায় বসে থাকেন তিনি৷ শরদিন্দু ঘুম থেকে উঠে তাঁকে ভিতরে ডেকে নেন৷ সেই প্রথম সাক্ষাৎকরের পর থেকেই ধীরে ধীরে প্রদীপের পিতা হয়ে উঠলেন শরদিন্দু পরিবারের এক বিশ্বস্ত মানুষ৷ ১৯৭০ সালে মৃতু্যর পরে শরদিন্দুর পুত্র-কন্যারা তাঁর হাতেই ছেড়ে দেন বিশাল সাহিত্যসম্ভারের কপিরাইট পাওয়ার অফ অ্যাটর্নির মাধ্যমে৷ তাঁর মৃতু্যর পরে তাঁর পুত্র প্রদীপ চক্রবর্তী এখন শরদিন্দুর লেখার স্বত্বাধিকারী৷ ২০১৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন যে সেই বছর তিনি ১৭ লাখ টাকা রয়্যালটি পেয়েছেন৷ এছাড়া বিভিন্ন সময়ে চলচ্চিত্র এবং নাটক করার জন্য স্বত্ব বিক্রয় করেও তিনি প্রচুর অর্থ পান৷ কিন্ত্ত তিনি এক পয়সাও নিজের কাছে রাখেন না৷ সব শরদিন্দুর উত্তরাধিকারীদের কাছে পাঠিয়ে দেন৷
প্রদীপ চক্রবর্তীর বাবা ‘ঝিন্দের বন্দি’র স্বত্ব ১১ বার বিক্রয় করেছিলেন৷ এমনকী বিকাশ রায়ও কিনেছিলেন স্বত্ব৷ কিন্ত্ত কেউই চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারেননি৷ শেষ বারো বারের বার তপন সিনহা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে সক্ষম হলে শরদিন্দু প্রদীপের বাবাকে লেখেন, ‘তুই আমার এতবড় সর্বনাশটা করলি, শুনছি নাকি তপনটা করেই ফেললো, আর তো বেচতে পারবি না৷’ আসলে বিক্রয় করা যায়, স্বত্বের মেয়াদের পরে, সাধারণত তিন থেকে সাত বছর যা প্রদত্ত অর্থের উপর নির্ভর করে৷ অঞ্জন দত্ত, উইকিপিডিয়া অনুযায়ী পাঁচটি চলচ্চিত্র করেছেন ব্যোমকেশকে নিয়ে৷ এছাডা.ও আরও উপন্যাসের কপিরাইট আছে তাঁর কাছে৷ ব্যোমকেশকে নিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন সত্যজিৎ রায়— ‘চিড়িয়াখানা’৷ পরে যিশু সেনগুপ্ত এই গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন৷ ব্যোমকেশের হিন্দি চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বত্ব প্রদীপ দিবাকর ব্যানার্জিকে বিক্রি করেছিলেন ৪৮ লক্ষ টাকায়৷ সব অর্থই তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন উত্তরাধিকারীদের কাছে৷ কল্পনা করা যায় শরদিন্দুর জনপ্রিয়তার কথা?
ঋতুপর্ণ সেনগুপ্ত একবার প্রদীপবাবুর কাছে ব্যোমকেশকে নিয়ে চলচ্চিত্র করার কথা বলেছিলেন৷ কাকে তিনি ব্যোমকেশের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ভেবেছেন প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন, ‘কেন বুম্বা (প্রসেনজিৎ)৷’ কিন্ত্ত আবির চ্যাটার্জির অভিনয় দেখে তিনি সেই চিন্তা পরিত্যাগ করেন৷ তবে প্রদীপবাবুর কাছে আবিরের পাশাপাশি ব্যোমকেশের চরিত্রে হিন্দি অভিনেতা রজত কাপুর এবং সুশান্ত সিং রাজপুতের অভিনয়ও ভালো লেগেছে৷ ঋতুপর্ণ একবার ঝিন্দের বন্দি করার পরিকল্পনা করেছিলেন৷ কিন্ত্ত প্রযোজকের অভাবে করতে পারেননি৷
মৃতু্যর ৫৪ বছর পরেও যে সাহিত্যিকের এত জনপ্রিয়তা, তাঁর বেছে বেছে কিছু গ্রন্থের বা কিছু চরিত্রের বিশ্লেষণের পথে আলোচনা করা আমার কাছে বাতুলতা মনে হয়েছে৷ তিনি বাংলার বাইরে বসবাস করে বাংলা কেন, অন্যান্য ভাষার মানুষের কাছে সমান আদৃত৷ তাই ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আমি তাঁর বহুমাত্রিক জনপ্রিয়তার দিকগুলি তুলে ধরলাম৷ ২০৩০ সালের পরে শরদিন্দুর সাহিত্যসম্ভারের স্বত্ব আমজনতার অধিকারে চলে আসবে৷ প্রদীপ চক্রবর্তীর দায়িত্ব শেষ হবে৷ তখন হয়ত নতুন নতুন প্রকাশক এবং চলচ্চিত্র পরিচালকের হাত ধরে শরদিন্দু আরও নবপ্রজন্মের কাছে পেঁৗছতে থাকবেন৷