• facebook
  • twitter
Sunday, 22 December, 2024

ভারতের প্রথম মহিলা বিস্ময়কর গণিতপ্রতিভা শকুন্তলা দেবী

শকুন্তলা দেবী কিন্তু রাজনীতিকে এড়িয়ে চলেননি। মুম্বাই দক্ষিণ এবং অধুনা তেলেঙ্গানার মেদক থেকে তিনি নির্দল প্রার্থী হিসাবে সপ্তম লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মেদক কেন্দ্রে তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

বিস্ময়কর গণিতপ্রতিভা শকুন্তলা দেবী। ফাইল চিত্র

বিমলকুমার শীট

ভারতে গণিতবিদ্যার চর্চা সেই খ্রিস্টপূর্বকাল থেকে চলে আসছে। ভারতের বাইরে মিশর, ব্যবিলন, মেসোপটেমিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে প্রাচীনকাল থেকে গণিতের অনুশীল ছিল বলে জানতে পারা যায়। ভারতে আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত, দ্বিতীয় ভাস্কর, বরাহমিহির প্রভৃতি পণ্ডিতদের গণিতবিদ্যা চর্চায় যথেষ্ট অবদান ছিল। মধ্যযুগে ইসলামী শাসনে পূর্বের মতো গণিত চর্চা হয়নি। ইংরেজ শাসনে গণিত চর্চা বন্ধ হয়নি। ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছিল মূলত নেটিভ প্রশাসক তৈরি করা, ভারতীয় প্রতিভার বিকাশ ঘটানো তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল না। এই পরিস্থিতিতেও অসামান্য প্রতিভাবান স্বশিক্ষিত বিস্ময়কর গণিতপ্রতিভা শ্রীনিবাস রামানুজনের (১৮৮৭-১৯২০) উত্থান ঘটে ছিল। তেমনি শকুন্তলা দেবী (১৯২৯-২০১৩) ছিলেন এই সময়কালে অন্যতম বিস্ময়কর মহিলা গণিতপ্রতিভা। ভারত এবং বিশ্বে তিনি “মানব কম্পিউটার” নামে খ্যাত। কিন্তু শকুন্তলা দেবীর এই উপাধি পছন্দ হয় নি । তিনি বলেছিলেন যে মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা কম্পিউটারের চেয়ে অনেক বেশি এবং উভয়ের তুলনা করা উচিত নয়। তিনি ক্যালকুলেটর, কলম বা কাগজের উপর নির্ভর না করে জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধান করে দিতেন।
শকুন্তলা দেবী ১৯২৯ সালে ৪ নভেম্বর কর্নাটক রাজ্যে ব্যাঙ্গালোরে এক কন্নড় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সুন্দররাজা রাও। তিনি একটি সার্কাসে ট্র্যাপিজ শিল্পী এবং জাদুকর হিসাবে কাজ করতেন। শকুন্তলার বয়স যখন তিন বছর তখন তাঁর পিতা তাঁকে কার্ডের কৌশল শেখানোর সময় তাঁর মধ্যে সংখ্যা মুখস্ত করার ক্ষমতা আবিষ্কার করে ছিলেন । তাই সুন্দররাজা রাও সার্কাস বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে মেয়েকে রোড শো-তে নিয়ে যান । এখানেই শকুন্তলা দেবী তার গণনার ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার গাণিতিক দক্ষতা প্রদর্শন করেন।
১৯৪৪ সালে শকুন্তলা দেবী লন্ডনে চলে যান। তিনি তার গাণিতিক প্রতিভা প্রদর্শন করে আরও কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেন। ১৯৫০ সাল জুড়ে তিনি ইউরোপ সফর করেন। পরে তিনি নিউ ইয়র্ক সিটিতে যান। ১৯৮৮ সালে শকুন্তলা দেবী যখন যুক্তরাষ্ট্রের সফর করেন তখন ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক আর্থার জেনসেন তার দক্ষতা বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেন এবং তিনি বড় সংখ্যা গণনা সহ বেশ কয়েকটি কাজে তার কর্মদক্ষতা পরীক্ষা করেন। শকুন্তলা দেবীর কাছে উপস্থাপিত সমস্যার উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে ৬১,৬২৯,৮৭৫এর ঘনমূল এবং ১৭০,৮৫৯,৩৭৫এর সপ্তমমূল গণনা করা । এ প্রসঙ্গে জেনসেন রিপোর্ট করেছেন যে তিনি তাঁর নোটবুকে সেগুলি কপি করার আগে শকুন্তলা দেবী উপরে উল্লিখিত সমস্যার সমাধান দিয়েছিলেন যথাক্রমে ৩৯৫ এবং ১৫। ১৯৯০ সালে জেনসেন একাডেমিক জার্নাল ইন্টেলিজেন্সে তাঁর ফলাফল প্রকাশ করেন।
শকুন্তলা দেবীর প্রতিভার বিস্ময় আরও রয়েছে। ১৯৭৭ সালে সাউদার্ন মেথডিস্ট ইউনিভার্সিটিতে, তিনি একটি ২০১ অঙ্ক বিশিষ্ট সংখ্যার ২৩তম বর্গমূল ৫০ সেকেন্ডে গণনা করেছিলেন। তার উত্তর ছিল ৫৪৬,৩৭২,৮৯১। এই উত্তরের জন্য ইউএস ব্যুরো অফ স্ট্যাণ্ডার্ড UNIVAC ১১০১ কম্পিউটার ব্যবহার করে ছিল । এতে বড় গণনা সম্পাদন করার জন্য একটি বিশেষ প্রোগ্রাম লিখতে হয়েছিল । আর সঠিক উত্তর তৈরি করতে UNIVAC কম্পিউটারের ৬২ সেকেন্ড সময় লেগেছে । ১৮ই জুন, ১৯৮০ সালে ইম্পেরিয়াল কলেজ লণ্ডনে তিনি দুটি জটিল ১৩ সংখ্যার যেমন ৭,৬৮৬,৩৬৯,৭৭৪,৮৭০ x ২,৪৬৫,০৯৯,৭৪৫,৭৭৯ এর গুণন প্রদর্শন করেন। এই সংখ্যাগুলি এলোমেলো ভাবে দেওয়া হয়েছিল, এবং শকুন্তলা দেবী মাত্র ২৮ সেকেন্ডে ১৮,৯৪৭,৬৬৮,১৭৭,৯৯৫,৪২৬,৪৬২,৭৭৩,৭৩০ হিসাবে সঠিক উত্তর দিয়েছিলেন। এটি তার পার্থিব খ্যাতি এনে দিয়েছে। সংখ্যা গননার জন্য তিনি কখনো কোনো কাগজ ব্যবহার করেননি। এই ঘটনাটি ১৯৮২ সালের গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে রেকর্ড করা হয়েছিল। লেখক স্টিভেন স্মিথ মন্তব্য করেছেন, “ফলাফলটি পূর্বে রিপোর্ট করা যে কোনো কিছুর থেকে এত বেশি উচ্চতর যে এটি শুধুমাত্র অবিশ্বাস্য হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে”।
শকুন্তলা দেবী তাঁর The Figuring: The Joy of Numbers বইটি ১৯৭৭ সালে প্রকাশ করেন। এতে মানবিক গণনা করার জন্য অনেক পদ্ধতি ব্যবহৃত করা হয়েছে । ওই বৎসর তিনি The World of Homosexuals নামক গ্রন্থটিও লিখেছিলেন। এটি ভারতে সমকামিতার প্রথম প্রকাশিত একাডেমিক গবেষণা। এরজন্য তিনি সমালোচিত হন। শকুন্তলা দেবী আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছিলেন যে বিষয়টিতে তার আগ্রহের কারণ ছিল একজন সমকামী পুরুষের সাথে তার বিবাহ এবং এটি বোঝার জন্য তার সমকামিতাকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে দেখার ইচ্ছা। ১৯৬০ দশকে শকুন্তলা দেবী ভারতে ফিরে আসেন এবং কলকাতায় একজন আই এ এস অফিসার পরিতোষ ব্যানার্জিকে বিয়ে করেন। তার একমাত্র মেয়ে অনুপমা। পরে শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে তার স্বামীর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।

শকুন্তলা দেবী কিন্তু রাজনীতিকে এড়িয়ে চলেননি। মুম্বাই দক্ষিণ এবং অধুনা তেলেঙ্গানার মেদক থেকে তিনি নির্দল প্রার্থী হিসাবে সপ্তম লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মেদক কেন্দ্রে তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বলেছিলেন যে তিনি “মিসেস গান্ধীর দ্বারা বোকা বানানো থেকে মেদকের জনগণকে রক্ষা করতে” চেয়েছিলেন। এই নির্বাচনে তিনি ১.৪৭% ভোট পেয়েছিলেন। ১৯৮০এর দশকের প্রথম দিকে শকুন্তলা দেবী ব্যাঙ্গালোরে ফিরে আসেন।

কেবলমাত্র মানব ক্যালকুলেটর হিসাবে নয় শকুন্তলা দেবীর প্রতিভার অন্য দিকও ছিল। তিনি ছিলেন এক উল্লেখযোগ্য লেখক ও জ্যোতিষী। রান্নার বই, উপন্যাস সহ বেশ কয়কটি গ্রন্থ তিনি লিখেছিলেন। শকুন্তলা দেবী প্রথমে লিখতে শুরু করেছিলেন ছোটগল্প এবং খুনের রহস্য দিয়ে । সঙ্গীতের প্রতি তার গভীর আগ্রহ ছিল। ২১ এপ্রিল ২০১৩ সালে ৮৩ বছর বয়সে গণিতবিদ শকুন্তলা দেবী প্রয়াত হন। ৪ নভেম্বর ২০১৩এ, শকুন্তলা দেবীকে তার ৮৪তম জন্মদিনে Goole ডুডল দিয়ে সম্মানিত করে ছিল। ২০১৯ সালের মে মাসে শকুন্তলা দেবীর জীবনের উপর একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয় । চলচ্চিত্রটির নাম শকুন্তলা দেবী, প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন বিখ্যাত অভিনেত্রী বিদ্যা বালান।

গণিতে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব থাকা স্বত্ত্বেও শকুন্তলা দেবীর সহজাত সংখ্যাগত প্রতিভা ঐতিহ্যগত একাডেমিক কাঠামো থেকে স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করেছিল। গণিতে জটিল সংখ্যা গণনা করার জন্য শকুন্তলা দেবীর সবচেয়ে বড় অবদান তাঁকে বিশ্ব জুড়ে অনেক অনন্য জায়গায় নিয়ে গেছে। তিনি ছাত্রদের সামনে তাঁর গানিতিক ক্ষমতা প্রদর্শন করেছিলেন এবং তরুণ মনকে গণিতের সৌন্দর্য এবং সরলতা আবিষ্কার করতে অনুপ্রানিত করেন। প্রধানত পুরুষশাসিত সমাজের ক্ষেত্রে লিঙ্গের বাঁধাধরা নিয়মগুলি ভেঙ্গে, শকুন্তলা দেবী গণিতে মহিলাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পথ তৈরি করেছিলেন। শকুন্তলা দেবীর উত্তরাধিকার মানুষের মনের সীমাহীণ ক্ষমতার প্রতীক এবং গণিতের জগতে এক পথ প্রদর্শক হয়ে থাকবে।