• facebook
  • twitter
Sunday, 8 September, 2024

অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ, বিজেপি আছে বিজেপিতেই

 শোভনলাল চক্রবর্তী   বুকারজয়ী ভারতীয় লেখক ও মানবাধিকারকর্মী অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে (ইউএপিএ) মামলার অনুমতি দিয়েছেন দিল্লির গভর্নর বি কে সাক্সেনা। গত ১৪ জুন সন্ত্রাস দমন আইনের (ইউএপিএ) ৪৫ ধারায় তাঁর বিচারের অনুমতি দেন। সেই সিদ্ধান্ত ঘিরে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্ক।অরুন্ধতী রায় ও শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে ‘জনসমক্ষে উসকানিমূলক বক্তব্য’ দেওয়ার অভিযোগ তুলে এফআইআর দায়ের

 শোভনলাল চক্রবর্তী  
বুকারজয়ী ভারতীয় লেখক ও মানবাধিকারকর্মী অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে (ইউএপিএ) মামলার অনুমতি দিয়েছেন দিল্লির গভর্নর বি কে সাক্সেনা। গত ১৪ জুন সন্ত্রাস দমন আইনের (ইউএপিএ) ৪৫ ধারায় তাঁর বিচারের অনুমতি দেন। সেই সিদ্ধান্ত ঘিরে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্ক।অরুন্ধতী রায় ও শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে ‘জনসমক্ষে উসকানিমূলক বক্তব্য’ দেওয়ার অভিযোগ তুলে এফআইআর দায়ের করেছিলেন সুশীল পণ্ডিত নামের একজন সমাজকর্মী। বলা হয়, ‘আজাদি: দ্য ওনলি ওয়ে’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় অরুন্ধতী প্ররোচনামূলক কিছু কথাবার্তা বলেছিলেন। অরুন্ধতী নাকি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন কাশ্মীর কখনো ভারতের অংশ ছিল না। ভারতের সেনাবাহিনী জোর করে তা দখল করেছে। সেই বছরের অক্টোবরে অরুন্ধতী ও শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে এফআইআর দাখিল করা হয়েছিল।এক যুগ পুরোনো সেই মামলা খুঁচিয়ে তোলা হয় গত বছরের অক্টোবরে। দিল্লির উপরাজ্যপাল ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় সম্প্রীতি হানি ও জাতীয় সংহতির পরিপন্থী আচরণের অভিযোগে মামলার অনুমতি দেন। এরপর দিল্লির রাজনিবাস (উপরাজ্যপালের বাসভবন) থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়, অরুন্ধতী ও শওকতের বিরুদ্ধে উপরাজ্যপাল এবার ইউএপিএ আইনে মামলা করার অনুমতি দিয়েছেন। অর্থাৎ এবার মামলা হবে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে।
উপরাজ্যপালের এই সিদ্ধান্ত ঘিরে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্ক।প্রায় সকলেই একমত ‘এই সিদ্ধান্ত নিন্দনীয়’। ১৪ বছর আগের এক অভিযোগ খুঁচিয়ে বের করে ইউএপিএর মতো কালা-কানুনে মামলা করার অনুমতি দেওয়ার পেছনের কারণ একটাই। সেটা স্বৈরতন্ত্রেরই পরিচায়ক। সেই অনুমতি এমন সময় দেওয়া হলো, যখন আদালতে ছুটি চলছে। আইনজীবীরাও ছুটিতে।তাই এই সিদ্ধান্ত লজ্জাজনক ও নিন্দনীয়।
উপরাজ্যপালের সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা ও নিন্দা জানিয়েছে বিরোধী ইন্ডিয়া জোট। জোটের পক্ষে বলা হয়েছে যে ‘মানুষের কণ্ঠস্বর চাপা দেওয়ার স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা অব্যাহত। বিশেষ করে সেই স্বর যদি কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও আন্দোলনকর্মীদের হয়। নিজেদের চূড়ান্ত ব্যর্থতা থেকে জনগণের চোখ সরাতে বিজেপি প্রতিদিন মনগড়া সংকট সৃষ্টি করে চলেছে। বাক্স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর এ ধরনের আক্রমণ গ্রহণযোগ্য নয়।’ তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী ও সংসদ সদস্য মহুয়া মৈত্র বলেছেন, ‘বিজেপি যদি ভেবে থাকে, ইউএপিএতে মামলা করার মধ্য দিয়ে তারা সেই আগের মতোই চলবে, তা হলে তারা ভুল করবে। তারা কিছুতেই সেই পুরোনো কায়দায় ফিরতে পারবে না। কেননা, এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধেই দেশের মানুষ এবার ভোট দিয়েছে।’
রাজনৈতিক মহলের ধারণা, মহুয়া যে কথা বলেছেন অর্থাৎ বিজেপি কিছুতেই পুরোনো কায়দায় ফিরতে পারবে না, সেটা মিথ্যা প্রমাণ করার জন্যই হয়ত এতকাল নরেন্দ্র মোদির সরকার যে ভাবে চলছিল, যেভাবে বিরুদ্ধ স্বর দমিয়ে আসছিল, নির্বিচার রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা রুজু করছিল, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েও তারা হয়তো সেই পথ থেকে সরবে না। এ সিদ্ধান্ত সম্ভবত সেটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে।গণতন্ত্রের প্রতি ভারতের বর্তমান শাসকদের শ্রদ্ধাবোধ প্রখর, এমন কথা গত দশ বছরে খুব কেউ বলেননি। প্রশ্ন হল, শাসক যদি গণতন্ত্রের মৌলিক শর্তগুলিকে অবজ্ঞা করতে চায়, বাক্‌স্বাধীনতার মতো সংবিধানসিদ্ধ অধিকারকে খর্ব করতে উদ্যত হয়, তাকে সংহত করার দায়িত্বটি কার? শাসনবিভাগ ও পুলিশ সেই দায়িত্ব পালনে বারংবার ব্যর্থ হয়েছে, হয়েই চলেছে।
আশার কথা, অন্তত কিছু ক্ষেত্রে বিচারবিভাগ রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই অবস্থায় গণতন্ত্রের আব্রুরক্ষার দায়িত্ব যেমন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির উপরে বর্তায়, তেমনই সে দায়িত্ব নাগরিক সমাজেরও। নির্বাচন চুকলেও সে দায়িত্ব ফুরিয়ে যায়নি, বরং তীব্রতর হয়েছে। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে শাসকদের উপর নিরন্তর চাপ সৃষ্টি করে যেতে হবে। গণতন্ত্রহীনতার যে অসম্মান ভারত বিশ্বমঞ্চে অর্জন করছে, সেই লজ্জা ঘোচানোর দায়িত্ব নিতেই হবে। মজার কথা হল,অরুন্ধতীর ওই মন্তব্যের ফলে কাশ্মীরে অস্থিরতার নিদর্শন মিলেছে, বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের কোনও সংযোগ মিলেছে তাঁর বক্তব্যের, এমন কোনও প্রমাণ আদালতে কখনও পেশ করা হয়নি, জনসমক্ষেও আসেনি। বরং এ বছরের সাধারণ নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ ভাবেই ভোট হয়েছে কাশ্মীরে।
এর মধ্যে এমন কী নতুন সাক্ষ্যপ্রমাণ খুঁজে পেল পুলিশ, যার ভিত্তিতে চোদ্দো বছর আগে একটি বক্তৃতার জন্য ইউএপিএ-র মতো কঠোর ধারা আরোপ করার দরকার হল? সে বিষয়ে কিছুই প্রকাশ করেনি পুলিশ। অতএব যে প্রশ্নটি সামনে আসে তা হল, এই ধারার প্রয়োগ কি ন্যায়বিচারের প্রয়োজনে, না কি রাজনৈতিক? নরেন্দ্র মোদী সরকার যে ভাবে সন্ত্রাসবিরোধী আইন এবং রাষ্ট্রদ্রোহবিরোধী আইনকে সমালোচকদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার করে তুলেছে, তাতে এ আশঙ্কা অস্বাভাবিক নয়। রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় সরকারের পেশ করা তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬-২০২০ সময়কালে চব্বিশ হাজারেরও বেশি ব্যক্তির উপরে ইউএপিএ আরোপ হয়েছিল, তাঁদের সাতানব্বই শতাংশই জেলবন্দি হয়ে আছেন, অপরাধী প্রমাণ হয়েছেন ২১২ জন। কারণ, এই মামলায় জামিন পাওয়া
প্রায় অসম্ভব।নানা সময়ে প্রাপ্ত তথ্য দেখাচ্ছে, ইউএপিএ-র অধিকাংশ মামলায় চার্জশিট ফাইল করার প্রতীক্ষা চলছে। আশঙ্কা, অপরাধীর বিচার নয়, নিরপরাধ সমালোচককে শাস্তি দেওয়াই উদ্দেশ্য। এ ভাবে বিরোধিতাকে ‘অপরাধ’ করে তোলার প্রবণতা সারা বিশ্বে সমালোচিত হয়েছিল।
এ বারের নির্বাচনে বিজেপির আসন কমার পরে অনেকে মনে করেছিলেন, মোদী সরকার কঠোর আইনের নির্বিচার প্রয়োগের বিষয়ে সতর্ক হবে। সুপ্রিম কোর্ট ২০২২ সালেই রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের প্রয়োগে রাশ টেনেছে। চুরাশি বছরের ফাদার স্ট্যান স্বামীর জেলেই মৃত্যু (২০২১), কিংবা সম্প্রতি নিউজ়ক্লিকের কর্ণধার প্রবীর পুরকায়স্থ আদালতে নিঃশর্তে মুক্তি পাওয়ার পরে ইউএপিএ-র উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবহার নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। এর পরেও যে দিল্লির উপরাজ্যপাল সাক্সেনা অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে ইউএপিএ প্রয়োগের অনুমোদন দিলেন, তা একটি সঙ্কেত— বাক্‌স্বাধীনতাকে কঠোর ভাবে দমন করার অবস্থানে মোদী সরকার অনড়।