বিমলকুমার শীট
মেঘনাদ সাহা দেশের একজন বিজ্ঞানী নয়, তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক ও ভারতের পুনর্গঠন ও শিল্পায়ণের একজন পথ প্রদর্শক । ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁর বাঙলার বহু বিপ্লবী ও বামপন্থী নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল । প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তিনি সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে পরিচিত ছিল । ১৯২২ সালে সুভাষচন্দ্র কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে তিনি বঙ্গীয় যুব-সম্মেলনে যে বক্তৃতা দেন তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
গান্ধীর “হিন্দ হিন্দ স্বরাজ” এ প্রচারিত বক্তব্যের বিরুদ্ধে তিনি সুতীব্র সমালোচনা করে বললেনঃ
ভারতের অর্থনৈতিক স্ব-নির্ভরতা উপায় নিহিত আছে আধুনিক বৃহৎ শিল্পের স্থাপন ও বিকাশের মধ্যে। বর্তমান সভ্যতার মূলমন্ত্র হচ্ছে বিজ্ঞান। –বেঁচে থাকতে হলে আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করতে হবে এবং প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে জয়ী হতে হলে আমাদের বিজ্ঞানের সেবা করতে হবে। দেশের দারিদ্র মোচন করতে হলে শুধু ‘ত্যাগ’ এ চলবে না। যে ব্যক্তি সমর্থ, ত্যাগ তাহাদেরই সাজে, অসমর্থ ব্যক্তির পক্ষে ত্যাগ ‘অযোগ্যতার’ই নামান্তর মাত্র। দেশের যুবকদের আর্দশ হবে যে, দেশের দারিদ্র্য মোচন করতে হবে, ‘দেশের শিল্প’ বানিজ্য ও সর্বপ্রকার স্বাধীন বৃত্তি যা এখন বিদেশির হস্তগত তাহাতে ক্রমে ক্রমে ঢুকতে হবে । এই দেশে প্রাকৃতিক শক্তিকে মানুষের কাজে লাগাবার জন্য ভবিষ্যতে যে বিরাট আয়োজন হচ্ছে, তাঁর জন্যও প্রস্তুত হতে হবে । কিন্তু এই সংগ্রামের উপযুক্ত হতে হলে নিয়তির উপর নির্ভরতা কমাতে হবে, জীবনব্যাপী সাধনা ও শিক্ষা করতে হবে।
রাশিয়ায় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে ড. মেঘনাদ সাহা আমাদের দেশের পুনর্গঠন ও শিল্পায়নের জন্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করার জন্য চিন্তা ভাবনা ও লেখালেখি করছিলেন। গান্ধীজির খাদি ও চরকা নীতির সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন ড. সাহা। সুবিধা পেলেই তিনি গান্ধীজির অর্থনীতিক “চরকা ও গোরুর গাড়ির নীতি” বলে বিদ্রুপ করতেন । তাঁর মতে এগুলি অচল, গ্রামে ফিরে ফিরে যাওয়ার ডাক ভাবালুতা ছাড়া আর কিছু নয় । রুশরা যেভাবে শিল্প পরিকল্পনা করেছেন, মার্কিনীরা যেভাবে টেনিস ভ্যালীতে নদী নিয়ন্ত্রন করছে এগুলিই ছিল তাঁর মতে অনুসরণের যোগ্য। সোভিয়েত পদ্ধতিটিই ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে মনোমত। যেভাবে তারা সর্বপ্রথমে বিজ্ঞান আকাদেমীর উপর বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার কাজ ন্যস্ত করেছিল সেটি তাঁর মত গোছানো প্রকৃতির লোকের কাছে খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হয়।
১৯৩১ সালে ড. সাহা যে ইউ পি অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠা করেন, তার প্রথম সভাপতির ভাষণে মানবজাতির সর্বাঙ্গীন উন্নতির জন্য পৃথিবীর সম্পদ বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যবহারের কথা বলেন এবং সেই উদ্দেশ্যে সর্বজাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা রচনার প্রস্তাব দেন। ১৯৩৫ সালে জুন মাস থেকে ড. সাহা সায়েন্স অ্যাণ্ড কালচার নামক পত্রিকাটি প্রকাশ করতে আরম্ভ করেন। পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় আবার তিনি গান্ধীর অর্থনীতির সমালোচনা করে বলেন যে, চরকা ও গোরুর গাড়ির নীতি দেশের হাজার হাজার বেকারের কর্মসংস্থান করতে পারে না তাই তিনি শিল্প ও অর্থনীতিতে উন্নত জীবনের স্বার্থে আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন
প্রয়াস চালিয়ে যাওয়ায় জন্য আহ্বান করলেন।
মহাত্মাগান্ধী তাঁর সিদ্ধান্তে স্থির ছিলেন। তিনি যখন দ্বিতীয় গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দিতে বিলেতে গিয়েছিলেন, তখন চলচ্চিত্র জগতের বিখ্যাত অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। দুজনেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অদ্বিতীয়। চার্লি মহাত্মাকে বলেছিলেন ‘আপনি সমস্ত প্রকার যন্ত্র ব্যবহারের বিরোধী। আপনার দেশবাসী গ্রামে ফিরে গিয়ে সাদাসিধা জীবনযাপন করুক এবং তাদের যে সামান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য তা সাধারণ যন্ত্র ও নিজের কায়িক পরিশ্রম দ্বারা উৎপন্ন করুক, এটাই আপনার অভিপ্রায়’। মহাত্মা কিন্তু আগে কখনও চার্লির নাম শুনেননি। তিনি প্রথমে আশ্চর্য হলেও এ সম্পর্কে তাঁর যুক্তি বলেন। তিনি চার্লিকে বলেন যে, ভারতের বিপুল জনসংখ্যার শতকরা ৯০ জনই অতিশয় দরিদ্র এবং যন্ত্র প্রচলনের ফলে বিশেষত বস্ত্রবয়ন যন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফলে বহু শিল্পী বেকার হয়েছে । যদি যন্ত্র উঠিয়ে দেওয়া যায়, তবে সূতাকাটা, বস্ত্র বয়ন এবং ভারতের অন্যান্য অনেক প্রাচীন শিল্প গ্রামে গ্রামে পুনরুজ্জীবিত করা যাবে। এর ফলে কেবল লক্ষ লক্ষ বেকারের কর্ম সংস্থানই হবে না, তাদের কিছু আয়ও বৃদ্ধি পাবে । চার্লি এরপরও কয়েকটি মন্তব্য করেছিলেন।
ড. সাহার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল মানুষ নিজেই তাঁর ভাগ্য নিয়ন্ত্রন করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এই দুই মাধ্যমের সাহায্যে মানুষ অনেক উন্নত করতে পারে। এর পরের কুড়ি বছর তিনি এই নিয়ে গভীর চিন্তা করেন। জাতীয় কংগ্রেস ততদিনে ভারতের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই সময় কংগ্রেস যে সাহার মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়, তাঁর মূলে ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র হরিপুরা কংগ্রেসে সভাপতি নির্বাচিত হলে সাহা তাঁকে অভিনন্দন জানাতে তাঁর বাড়িতে যান এবং সুভাষচন্দ্রকে নানা প্রশ্ন করেন। যেমন কংগ্রেস কিভাবে দেশের দুঃখ মোচন করবে, দেশের অগণিত মানুষকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান দেবার কোন পরিকল্পনা আছে কি? সুভাষচন্দ্রের কাছে এর কোন সদুত্তর ছিল না।
ড. সাহার প্রস্তাব ছিল একটি জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গঠন । সুভাষচন্দ্র বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে সাহার প্রস্তাবে সম্মত হন । সে বছর অক্টোবর মাসে দিল্লীতে যে মিটিং হবার কথা ছিল সুভাষচন্দ্র ড. সাহাকে তাতে যোগদেবার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন । সাহা একদিন দেরীতে পৌঁছে দেখেন ইতিমধ্যেই জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গঠিত হয়ে গেছে এবং এম বিশ্বেসরাইয়াকে তাঁর চেয়ারম্যান হতে অনুরোধ করা হয়েছে । এই ব্যবস্থা সাহার মনঃপূত হল না । কারণ তাঁর মতে কংগ্রেসের একজন বড়দরের সদস্যকে চেয়ারম্যান না করলে পরিকল্পনা কমিটির প্রস্তাবগুলিকে যথোচিত গুরুত্ব দেওয়া হবে না। তাই বিশ্বেসরাইয়া সরে দাঁড়ালেন এবং অনেক অনুরোধ উপরোধের পর জওহরলাল এই পদ গ্রহণ করতে সম্মত হলেন । বোম্বাইয়ের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক কে টি শাহ হলেন এর সাধারণ সম্পাদক। কালবিলম্ব না করে কমিটির কাজ শুরু হল । জ্বালানী ও শক্তি সাব কমিটির চেয়ারম্যান হলেন মেঘনাদ সাহা । তখনকার কংগ্রেস সভাপতি ড. পট্টভী সীতারামাইয়ার (১৯৪৮-৪৯) কাছে ২৬ খন্ডের ইনটারিম রিপোর্ট পেশ করা হয় । এই প্ল্যান কার্যকর করার দায়িত্ব জাতীয় সরকারের হাতে ছেড়ে দিয়ে কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হয় ।
এর ঠিক পরেই জওহরলাল নেহরু ও অন্য প্রথম সারির কংগ্রেস নেতারা গ্রেপ্তার হলেন। জাতীয় পরিকল্পনার প্রথম পর্যায় এভাবে শেষ হল। ডিসকভারি অফ ইণ্ডিয়া গ্রন্থে তিনি পরিকল্পনা কমিটির কাজকে তাঁর হৃদয়ের সাথে সংযুক্ত বলে বর্ণনা করেছেন, সুভাষচন্দ্র বসু শুধু প্রথম অধিবেশন উদ্বোধন করলেন আনুষ্ঠানিক ভাবে। প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করলেন জওহরলাল নেহরু। জওহরলাল নেহরুর জীবনীকার সর্বপল্লী গোপাল জাতীয় প্ল্যানিং কমিটি গঠন সম্পর্কে বলেছেন – কমিটি গঠন যতটা না ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের কাছে বিপদ সঙ্কেত সৃষ্টি করেছিল, তাঁর চেয়ে বেশি বিচলিত করেছিল কংগ্রেসের ভিতরকার দক্ষিণপন্থীদের। এই কমিটির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক না রাখার জন্য স্বয়ং গান্ধী যে তাঁর অনুগামীদের আদেশ দিয়েছিলেন, ড. গোপাল সেটাও উল্লেখ করেছেন। গান্ধী জওহরলালকেও বলেছিলেন যে তিনি কখনোই এই প্ল্যানিং কমিটির পরিকল্পনা বুঝতে অথবা উপলব্ধি করতে পারেননি। শেষে গান্ধীজি জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির সাব-কমিটিগুলির সমস্ত রিপোর্ট প্রকাশ করার প্রস্তাব বাতিল করে দেন।
স্বাধীন ভারতের প্ল্যানিং কমিশন গৃহিত হল কিন্তু মেঘনাদ সাহার কোন স্থান হল না। কংগ্রেসের এক শ্রেণীর লোকের প্রবল বিরোধীতার কারণে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর পক্ষে ১৯৫০ সালের আগে কোন কার্যকর পন্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি । তিন বছর পরে ১৯৫৩ সালে প্ল্যানিং কমিশন তাঁদের শিল্পনীতির খসড়া পেশ করে। এই খসড়াটি ছিল প্রথম খসড়ার চেয়ে অনেক দিক দিয়ে আলাদা। এই পরিকল্পনায় সুযোগভোগী সম্প্রদায়ের স্বার্থ সবদিক দিয়ে রক্ষা করা হয়েছিল। ততদিনে মেঘনাদ সাহা লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছেন। অনেক সংসদ তাঁকে ফিজিক্স ল্যাবরেটরিতে ফিরে যেতেও বলেছিলেন। কিন্তু মেঘনাদ সাহা নিজের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য বিরোধীর ভূমিকা বেছে নেন। প্রত্যাখ্যান করেন কংগ্রেসের তরফ থেকে নির্বাচনে দাঁড়াবার প্রস্তাব।
সমাজ সচেতনতা মেঘনাদ সাহাকে ক্যালেণ্ডার সংশোধন ও নদী নিয়ন্ত্রন প্রকল্প বিষয়ে গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন শিল্পায়ন ছাড়া দেশের উন্নতি অসম্ভব। বৃহৎশিল্প একমাত্র পথ। আর সমগ্র ভারতের খনিজদ্রব্য, কৃষির উপযোগী ভূমি ইত্যাদি শিল্পের নব প্রণালী প্রবর্তনের সকল সামগ্রী আছে। এই কাজ নাকরা পর্যন্ত ভারতের দারিদ্র ও বেকার সমস্যা দূর হবে না এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আসাও কম।