হীরক কর
১৯৮৫, তখন সবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছি। “পুরুলিয়া গেজেট” নামে একটি কাগজে সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। সে বছর ইডেন উদ্যানের ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মাঠে বসে ছিল ‘যুব উৎসব’-এর আসর। সেখানেই আলাপ তাঁর সঙ্গে। ছোট একটা সাক্ষাৎকার নিতে গেলে তিনি মফঃস্বলের ছোট সাংবাদিকটিকে কাছে টেনে নিয়ে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন বিশিষ্ট সিপিএম নেতা রবীন দেব।
তাঁর গানে আমরা কিশোর-যুবকেরা সেই সময় মাতোয়ারা। সেই সব গানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বাংলা গানে পাশ্চাত্য রীতির ব্যবহারে তিনি অসামান্য।
“বিচারপতি”, “রানার”, “অবাক-পৃথিবী” প্রভৃতি গণসঙ্গীতেরও সার্থক স্রষ্টা তিনি।
“উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা”, “আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমের”, “সুরের এই ঝর ঝর ঝরনা” প্রভৃতি গানে কোথাও পাশ্চাত্য ক্রিসক্রস গতি বা প্যাটার্ন, কোথাও ভোকাল হারমনি, কোথাও বা কাউন্টার পয়েন্ট সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন। এতটা পড়ে নিশ্চয়ই বুঝেছেন,বলছি কালজয়ী গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরীর কথা । গত ১৯ নভেম্বর ছিল সলিল চৌধুরীর জন্মশতবর্ষ।
সলিল চৌধুরী একাধারে গীতিকার-সুরকার, এক সার্থক কম্পোজ়ার। আবার শুধু লেখা, সুর দেওয়াই নয়, যন্ত্র-অনুষঙ্গে তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন বরাবর। তাঁর গান, সুর-রচনা অবশ্যই স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে। গণ-আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সলিল চৌধুরীর গান লেখার শুরু গণসঙ্গীত দিয়েই: ‘দেশ ভেসেছে বানের জলে।’ সোনারপুর অঞ্চলে বন্যাপীড়িত দুর্গত মানুষের কথা ভেবে এ গান লিখেছিলেন তিনি। গত শতকের চারের দশকে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সলিল চৌধুরী পরপর বেশকিছু গণসঙ্গীত লেখেন। যেখানে তিনি শুধু বিষয়ের দিকেই নজর দেননি, সুর-ছন্দ-আঙ্গিকের কথাও ভেবেছিলেন। দেশি-বিদেশি সঙ্গীত আত্মীকরণ করে তিনি গানে কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর লেখা গণসঙ্গীতগুলোর মধ্যে কম্পোজ়িশান হিসেবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ‘ও আলোর পথযাত্রী।’
আজ তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে মনে হয় বাংলা গানে সলিল চৌধুরীর অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন এখনো হয়নি। তবে সঙ্গীত পিপাসু মানুষের কাছে আজও তাঁর গানগুলোর অসামান্য জনপ্রিয়তা ও কদর তাঁর অসামান্য প্রতিভাকেই স্মরণ করায়।
উনিশ শতক ছিল বাংলা গীতিকার-সুরকারদের যুগ৷ অর্থাৎ, যিনি গান লিখছেন, তিনিই সেই গানে সুর দিচ্ছেন৷ ছবিটা বদলাতে শুরু করে বিংশ শতকের গোড়া থেকে ৷ এই ধারার আংশিক প্রবর্তক কাজি নজরুল ইসলাম, কিন্ত্ত এটাই রেওয়াজ হয়ে ওঠে বাংলা গানের জগতে অজয় ভট্টাচার্য, প্রণব রায়, মীরা দেববর্মনের মতো গীতিকারদের উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ৷ তাঁরা শুধু গানই লিখছেন, কিন্তু সুর দিচ্ছেন না৷ অন্য দিকে হিমাংশু দত্ত, পঙ্কজ মল্লিক বা শচীন দেববর্মনরা সুর দিচ্ছেন, কিন্তু লিখছেন না৷ বিংশ শতকের ‘ডিভিশন অফ লেবার’-এর এই ধারার একমাত্র উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম সলিল চৌধুরী৷ অন্তত নব্বইয়ের দশকে সুমন চট্টোপাধ্যায়, থুড়ি কবীর সুমন পর্ব শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত৷
সলিল চৌধুরীর জন্ম ১৯২৫ সালের ১৯ নভেম্বর আসামের রাজপুর সোনারপুর অঞ্চলের গাজীপুরে। তার বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী ছিলেন আসামের লতাবাড়ি চা বাগানের ডাক্তার। তিনি সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন। তাই বাবার কাছেই সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয় সলিল চৌধুরীর। পরবর্তীতে নিখিল চৌধুরীর কাছেও তিনি সঙ্গীতের তালিম গ্রহণ করেন। যে গান গণমানুষের কথা বলে, যে গানে কণ্ঠ মেলায় দেশ-সমাজের সাধারণ মানুষ, যে গানে উঠে আসে নিগৃহীত, বঞ্চিত মানুষের প্রতিবাদের ভাষা; সেই গানের প্রবর্তন করেছিলেন তিনি। আর তাই তাকে বলা হয় ‘গণসঙ্গীতের প্রণেতা’।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সুভাষ গ্রামে মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেন সলিল চৌধুরী। ছোটবেলা থেকেই তিনি পিতার সংগ্রহে থাকা পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতেন। তার পিতা চা বাগানের কুলি এবং স্বল্প বেতনের কর্মচারীদের সাথে মঞ্চ নাটক করে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। হারিনাভি বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন এবং উচ্চ মাধ্যমিক (আইএসসি) পাশ করেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বঙ্গবাসী কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং এ সময়েই সঙ্গীত জ্ঞানে পরিপক্বতা লাভের পাশাপাশি দ্রুত তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জন্মায়।
সেসময় তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক দল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএ (ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন)-এ যোগ দেন। তখনই গান লিখতে ও সুর করতে শুরু করেন সলিল চৌধুরী। সেসময় আইপিটি-এর সাংস্কৃতিক দলটি বিভিন্ন শহর ও গ্রামগঞ্জে ভ্রমণ করতে থাকে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসে ‘বিচারপতি’, ‘রানার’ এবং ‘অবাক পৃথিবী’র মতো গান। যা তখন সাধারণ জনতার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
তার ‘গাঁয়ের বধূ’র মতো গান বাংলা সঙ্গীতে একটি নতুন ধারা তৈরি করেছিল, যা মাত্র ২০ বছর বয়সে সুর করেছিলেন সলিল চৌধুরী। পশ্চিমবঙ্গে তখনকার প্রায় প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী এসব গান গেয়েছেন। এরমধ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
সলিল চৌধুরী ৭৫টির বেশি হিন্দি চলচ্চিত্র, ৪১টি বাংলা চলচ্চিত্র, ২৬টি মালায়ালাম চলচ্চিত্র, বেশ কিছু মারাঠি, তামিল, তেলেগু, কান্নাডা, গুজরাটি, ওড়িয়া এবং অসামীয়া চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। তাঁর ‘গাঁয়ের বধূ’র মতো গান বাংলা সঙ্গীতে একটি নতুন ধারা তৈরি করেছিল, যা মাত্র ২০-২২ বছর বয়সে সুর করেছিলেন সলিল।
চলচ্চিত্রেও তিনি রেখেছিলেন অসামান্য অবদান। তার প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ‘পরিবর্তন’ মুক্তি পায় ১৯৪৯ সালে। ১৯৫৩ সালে বিমল রায় পরিচালিত ‘দো বিঘা জমিন’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সলিল চৌধুরীর হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্পে অভিষেক ঘটে। বাংলা এবং হিন্দি চলচ্চিত্রে ২০ বছর কাজ করার পরে সলিল চৌধুরী ১৯৬৪ সালে ‘চিম্মিন’ দিয়ে মালয়ালাম চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন। চলচ্চিত্র সফলতা পাক বা না পাক সলিলের মালয়ালাম গানগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
আসলে বাংলা গানে এক স্বতঃউৎসারিত ঝর্ণাধারায় স্বতঃস্ফূর্ত গতিময়তার আরেক নাম সলিল চৌধুরী। সুরের বৈচিত্র্যে সহজেই তৈরি করে নিয়েছিলেন এক নিজস্ব ঘরানা। রাগরাগিণীর এবং পাশ্চাত্য গানের প্রয়োগে যে ট্রিটমেন্ট সেখানে সলিল চৌধুরী আনলেন অভিনবত্ব। বহু ক্ষেত্রে রিদমিক প্যাটার্নের মূল কাঠামোয় শব্দ এবং ভাব অনুযায়ী সুর আনলেন।কীর্তনের সুরে তৈরি করলেন প্রতিবাদের গান, মোজার্টের সিম্ফনি, রাশিয়ান বা হাঙ্গেরীয়ান সুরের চলনকে নিজের মতো করে ব্যবহার করলেন। স্কেল বা কর্ড নিয়ে চলতে লাগলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা।নীচু স্বর থেকে হঠাৎ উঁচু স্বরে বা উঁচু থেকে পলকে নিচে নেমে এসে জার্ক দেওয়ার প্রবণতা ঘটালেন নিজের কম্পোজিশনে। এছাড়াও স্কেল চেঞ্জ করে বৈচিত্র্য আনার রীতি অনুসরণ করলেন। গানে হঠাৎ কোমল থেকে শুদ্ধ বা কড়িতে তাঁর সুর ষড়জের মত পাল্টে যেত। এসব তত্ত্বকথা ছাড়াও সলিলসুরের প্রধান উপাদান ছিল উচ্ছলতা এবং সাবলীলতা যা ঝর্ণার মত সঞ্চারমান, গতিময় এবং চঞ্চল ছিল। আসলে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারতেন বলেই সলিল চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন ট্রেন্ডসেটার।
সলিল চৌধুরী গীতিকার, সুরকার, গায়ক, কম্পোজার কিন্তু তাঁর সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। লিখেছেন ‘ড্রেসিংটেবিল’এর মতো গল্প বা ‘অরুণোদয়ের পথে’-র মতো নাটক। কিংবা ‘শপথ’ বা ‘চাবি’ র মতো কবিতা। ছড়াও লিখেছেন যেগুলো কন্যা অন্তরা চৌধুরীকে দিয়ে গান হিসেবে গাইয়েছেন। পরিচালনা করেছেন হিন্দি ছবি ‘পিঁজরে কে পনছি’, ‘ দো বিঘা জমিন’ এর চিত্রনাট্যকার হিসেবে সলিল চৌধুরীর অবদান আজও আমাদের কাছে বিস্ময়কর। এমনকি যখন কোনও ছবিতে একটিও গান ব্যবহার না করে শুধু আবহসঙ্গীতের ব্যবহার করেছেন সেখানেও রেখেছেন স্বকীয়তার স্বাক্ষর। বাংলা বা হিন্দি গান ছাড়াও ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের নানা ভাষাতেও সুর করেছেন তিনি। সারা ভারতবর্ষের বিশিষ্ট সব শিল্পীরা গেয়েছেন সেসব গান। এভাবেই সঙ্গীতের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন স্রষ্টা সলিল চৌধুরী।
সলিল চৌধুরী যে সময় বাংলা গানের জগতে এলেন তখন এক বাংলা গানের ক্ষেত্রে এক যুগগসন্ধিক্ষণ। ইতিহাস তখন বদলাতে শুরু করেছে।রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হয়েছেন। কবি নজরুলের সৃষ্টি গেছে থেমে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় সারা পৃথিবী স্তম্ভিত। হিটলারের আগ্রাসনে পৃথিবীর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা এক বিরাট প্রশ্নচিহ্নর মুখোমুখি।ভারতবর্ষে চলছে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এমনই এক সময় সলিল চৌধুরী তাঁর সৃষ্টি সম্ভার নিয়ে এলেন। বলা বাহুল্য এলেন, দেখলেন, জয় করলেন।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির ঠিক পরের বছরের গল্প।১৯৪৮ সাল।সেসময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থাকতেন ইন্দ্র রায় রোডে।গণনাট্য সংঘের তরুণ তুর্কী সলিল চৌধুরী এসেছেন তাঁর কাছে। প্রাথমিক আলাপের পর হেমন্তকে বেশ কয়েকটা গণনাট্য সংঘের গান শোনালেন সলিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পছন্দও হলো কিন্তু সেই গান রেকর্ড করতে পারা যাবে না বলে তিনি জানালেন। ভবিষ্যতে আবার নতুন গান তৈরি করে সলিল চৌধুরী আসবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তা অবধি চলে এসেছেন সলিল চৌধুরী।সঙ্গে হেমন্তও আছেন। একটি অর্ধ সমাপ্ত গানের কথা সলিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে বললেন। আবার দুজনে ঘরে বসলেন। প্রথম অংশের শুরুটা ছিলো এরকম,-‘কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো’। গানটি শুনে চমকে উঠলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এমনভাবে গানের কথা লেখা যায়! সলিল চৌধুরীকে গানের শেষভাগটুকু লিখে আনতে বললেন হেমন্ত। সেদিন রাত্রেই সলিল চৌধুরী লিখলেন, ‘ডাকিনী যোগিনী এল শত নাগিনী এল পিশাচেরা এল রে’….
দিন দুয়েকের মধ্যেই হেমন্তর হাতে পুরো গানটি এসে গেলো ‘ গাঁয়ের বধূ’। ১৯৪৯ সালে রেকর্ড করলেন হেমন্ত সেই গান।এরপর যেন বাংলা গানের সংজ্ঞাই বদলে গেলো। এরপর সলিল- হেমন্ত জুটি সঙ্গীতরসিক শ্রোতাদের উপহার দিলেন ‘রানার’,’ পাল্কির গান’,’ অবাক পৃত্থিবী’,’ ঠিকানা’। ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইসময় সলিল চৌধুরী আর একটি মনে রাখার মতো কাজ করলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘ কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি। কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক’- গানটিকে দুর্ভিক্ষের পটভূমিকায় রূপান্তরিত করলেন ‘ সেই মেয়ে ‘গানে।’ হয়তো তাকে দেখো নি কেউ কিংবা দেখেছিলে’ গানটি ১৯৫০ সালে রেকর্ড করলেন সুচিত্রা মিত্র। রাতারাতি সাড়া পড়ে গেলো শ্রোতাদের মধ্যে।এইসময় সলিল চৌধুরী কিছু কিছু গান এমন সৃষ্টি করলেন যেখানে শুধু ব্যক্তি নয়,পরিবেশ,সমাজ,দেশ- এসব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো। ১৯৫২ সালে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় গাইলেন’ শ্যামলবরণী ওগো কন্যা’। এই গানে প্রকৃতি যেন প্রেমিকা যে গানের বর্ণনায় দেশে পর্যবসিত হলো। গায়ক গাইলেন’ ওগো তুমি বুঝি মোর বাংলা’। ১৯৫৩ সালে কবি বিমলচন্দ্র ঘোষের কথায় সলিল চৌধুরীর সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গাইলেন ‘ উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা’৷ সেই গানে যেন চৈত্রদিনের এক ছবি ফুটে উঠলো। ঐ একই বছর সলিল চৌধুরী নিজের কথায় ও সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গাওয়ালেন ‘ আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেবো মেপে’। বৃষ্টি নিয়ে প্রচলিত রোম্যান্টিকতা উধাও।পরিবর্তে বাস্তব জীবন,দারিদ্র্যের হাহাকার এবং বিপুল প্রত্যাশার পরশ এই গানের শব্দে শব্দে ১৯৫৪ সালের দুটি গান আবার বাংলা গানের মোড় ফেরালো।নিজের কথায় ও সুরে সলিল চৌধুরী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গাওয়ালেন এবং অন্নদাশংকর রায়ের কথায় নিজের সুরে বাণী ঘোষালকে দিয়ে রেকর্ড করালেন ‘ তেলের শিশি ভাঙলো বলে’। ১৯৫৭ সালে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় মাইকেল মধুসূদন দত্তর লেখা দুটি কবিতা রেকর্ড করলেন। ‘রেখো মা দাসেরে মনে’ এবং’ আশার ছলনে ভুলি’। সলিল চৌধুরী বাংলা গানকে কয়েক ধাপ যেন এগিয়ে দিলেন।
১৯৫৬সালের ১৪ আগস্ট মুক্তি পেলো রাজকাপুর প্রযোজিত ও অভিনীত ‘ একদিন রাত্রে’।সুরকার সলিল চৌধুরী। আর কে ফিল্মসের ব্যানারে এই প্রথম সলিল চৌধুরীর কাজ।একটি গান তিনি লিখলেন, ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয় সব সত্যি, ঘুরি এই দুনিয়ার লাট্টু ভগবান হারিয়েছো লেত্তি’।
ছবি বিশ্বাস এক মাতালের ভূমিকায়। মান্না দে গাইলেন সেই গান। এই গান রেকর্ডিংয়ে মান্না দে বেশ অভিনয় করে এই গান গেয়েছিলেন। ছবি বিশ্বাস গান শুনে গেলেন রেগে। মান্না দের কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন ছবি বিশ্বাসের বন্ধু । তিনি মান্না দেকে বেশ বকুনি দিলেন। কিন্তু গান হলো সুপার হিট। বিশেষ করে সলিল চৌধুরী গানে এমন সব কথা বসালেন যা সেইসময় ভাবাই যেতো না।’ মানিব্যাগ’,’ ফলং ফলং ফলা’ ইত্যাদি শব্দগুলির প্রয়োগ ঘটালেন অনায়াসেই। বাংলা ছবির গান বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলো এই গানটির মাধ্যমে।
প্রখ্যাত সাংবাদিক-সম্পাদক সন্তোষকুমার ঘোষের কাহিনীনির্ভর কিনুগোয়ালার গলি ছবি মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালে। সেই ছবির গান রেকর্ডিং হচ্ছে। সবিতা চৌধুরী গাইবেন,’ দখিনা বাতাসে মন কেন কাঁদে’।গোরখকল্যাণ রাগে বাঁধা এই গান হারমোনিয়ামে বাজাচ্ছেন সলিল চৌধুরী। পাশে তবলায় আছেন রাধাকান্ত নন্দী। সারা স্টুডিও স্তব্ধ। সলিলের হারমোনিয়ামবাদনে প্রত্যেকে মুগ্ধ। অবশেষে সবিতা গাইলেন।সে গান আজ ইতিহাস।
কিশোরকুমার সলিল চৌধুরী জুটি এক অনবদ্য জুটি। সংখ্যার বিচারে মান্না দে বা মুকেশ তাঁর সুরে হিন্দিতে অনেক গান হয়তো গেয়েছেন। কিন্তু কিশোরকুমার যে কটি গান গেয়েছেন সবকটিই হিট করেছে।
মুসাফির, নৌকরি, হাফ টিকেট, অন্নদাতা,মেরে আপনে— এরকম অসংখ্য ছবির কথা বলাই যায়। তখন সলিল চৌধুরী বম্বেতে পেডার রোডের ফ্ল্যাটে থাকেন। অন্নদাতা ছবির গান রেকর্ডিং হবে। একটি গান গাইবেন কিশোরকুমার তাই তাকে সলিল চৌধুরী ডেকে পাঠিয়েছেন। কিশোরকুমার তাঁর সলিলদার গান করতেন খুব সিরিয়াস মুডে। সেদিনও তাই এসেছেন। সোফায় সলিল বসে কিশোরকুমারকে গান শেখাচ্ছেন —’গুজর যায়ে দিন দিন দিন কি হর পল গিন গিন গিন কিসিকি হায় ইয়াদোঁ মে’।
শেষ তিনটি শব্দ শুনেই কিশোরকুমার সোফা থেকে নেমে মাটিতে বসে পড়লেন। মুখ নীচু। সলিল চৌধুরী অত্যন্ত অবাক হয়ে গেলেন।কি এমন হলো যে কিশোরকুমার মাটিতে বসে পড়লেন! তখনও কিশোরকুমার মাটিতে বসে রয়েছেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন,- আমাকে মাফ করুন সলিলদা। আপনার সমান উচ্চতায় বসে আমি এ গান শিখতে পারবো না। কি সুর করেছেন। এই বলে বাকি সময়টা মাটিতে বসেই কিশোরকুমার গানটা তুললেন। সেই গান হিট হলো খুব।
হৃষীকেশ মুখার্জি যখন আনন্দ ছবি পরিচালনা করবেন বলে ঠিক করলেন তখন ডাকলেন সলিল চৌধুরীকে।এই ছবিটি প্রথমে বাংলায় হওয়ার কথা ছিলো। অভিনয় করবার কথা রাজ কাপুর ও উত্তমকুমারের। কিন্তু সেই কাজটি বাস্তবায়িত হয় নি। হিন্দিতে যখন ছবিটি হওয়ার কথা হলো ছবির নায়ক আনন্দ এর মুখে সলিল চৌধুরী দুখানি গান রাখলেন ‘ ম্যায়নে তেরে লিয়ে’ এবং’ কাঁহী দূর যব দিন ঢল যায়ে’ প্রথমটি গুলজারের লেখা দ্বিতীয়টির গীতিকার যোগেশ। একটি গান সলিল যোগেশকে দিয়ে লেখালেন সেই গানটি হলো ‘ জিন্দেগী ক্যায়সি ইয়ে পহেলি হায়’ এই গান গাইলেন মান্না দে। এই গানটিকে ব্যাকগ্রাউন্ড গান হিসেবে রাখা হলো। কিন্তু নায়ক রাজেশ খান্না গানটি শুনে আবদার করলেন যে এই গানটি তাঁর চাই। এমন একটি গান ব্যাকগ্রাউন্ডে হতেই পারে না। তিনি লিপ দেবেন এই গানে। সুরটা এত টাচি যা রাজেশ খান্নাকে আকৃষ্ট করে। এই গানের সূচনাতে সলিল চৌধুরী ব্যবহার করলেন ট্রাম্পেট। বাজালেন মনোহারী সিং। এর আগে হিন্দি ছবিতে কোনও গানে কোনও সুরকার এইভাবে লো টোনে ট্রাম্পেটের ব্যবহার করেননি।
বম্বেতে শুরুটা হয়েছিলো দারুণভাবে। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিক। তখন কলকাতা থেকে এক ঝাঁক শিল্পী বম্বেতে গিয়েছেন। বিমল রায়,শচীন দেব বর্মন,হৃষীকেশ মুখার্জি,মান্না দে,হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।হৃষীকেশ মুখার্জি ছিলেন সলিল চৌধুরীর বন্ধু তাঁর মাধ্যমে বিমল রায়ের সঙ্গে আলাপ সলিলের।সলিলের লেখা রিক্সাওয়ালা গল্পটি তাঁর বেশ পছন্দ হয়েছে তিনি এই গল্পনির্ভর একখানি হিন্দী ছবি করতে চান। ছবির নাম হলো ‘ দো বিঘা জমিন’ এই ছবির চিত্রনাট্য লিখবেন সলিল এমনটাই ঠিক হলো। হৃষীকেশ মুখার্জি বিমল রায়ের কাছে প্রস্তাব রাখলেন যাতে সলিল এই ছবির সুর করেন। বিমল রায় সবসময় নতুনদের সুযোগ দিতেন। এককথায় তিনি রাজী হয়ে গেলেন। সলিল চৌধুরী প্রথম হিন্দি ছবিতে সুযোগ পেয়ে ঢেলে দিলেন নিজেকে। গান লিখলেন শৈলেন্দ্র।
সালটা ছিল ১৯৬২।রেকর্ড প্রকাশিত হবে নবাগত গায়ক জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের। সুরকার। রেকর্ডের দুদিকে দুখানি গান। দুটি গানেরই অর্ধেক অংশ সলিল চৌধুরী জটিলেশ্বরকে শিখিয়ে তিনদিন পরে রেকর্ডিং স্টুডিওতে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তখনও শিল্পী পুরো গান শেখেন নি।প্রচন্ড চিন্তা নিয়ে জটিলেশ্বর হাজির হলেন স্টুডিওতে। একটি গানের প্রথম অন্তরা কয়েকবার রিহার্সাল দেওয়ার পর জটিলেশ্বর সলিল চৌধুরীকে খুঁজতে গিয়ে দেখেন যে স্টুডিওর পিছনের লম্বা সিঁড়ির ওপর ধুলো মলিন পরিবেশে তিনি বসে আছেন। হাতে রয়েছে কাগজ ও কলম। জটিলেশ্বরকে দেখতে পেয়েই বললেন যে গান তৈরী হয়ে গিয়েছে। কাগজ দেখে বেশ কবার অভ্যাসও করলেন জটিলেশ্বর। দুটি গানই হলো সুপারহিট। যতদিন জটিলেশ্বর জীবিত ছিলেন এই দুটি গান তাঁকে অনুষ্ঠানে গাইতেই হতো গানদুটি হলো ‘ পাগল হাওয়া কি আমার মতন তুমিও হারিয়ে গেলে’ এবং অন্যটি ‘ আমার এ জীবনে শুধু’।
নিজের সৃষ্টি করা সুর বারে বারে প্রয়োগ করেছেন নতুন নতুন কথায়। তাতে সেই গানটির গ্রহণযোগ্যতা কোনও ভাবেই কিন্তু ম্লান হয়ে যায়নি। গানের সুর হয়তো এক হয়েছে কিন্তু কথাগুলো পরিবর্তিত হয়েছে সলিল চৌধুরীর স্বকীয় ভাবনায়।আকাশবাণী কলকাতার রম্যগীতির জন্য সলিল চৌধুরী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে একখানা গান করিয়েছিলেন।গানটি হলো ‘ গুরু গুরু গুরু মেঘ গরজে ‘। এর পরে এইগানের সুর একই রেখে কথা দিলেন বদলে। ১৯৭৭ সালে এবার সবিতা চৌধুরী রেকর্ড করলেন ‘ তুমি কি কখনও সেই গান শোনো’। আরও পরে আবার কথা বদলালেন সুর রইলো একই। ১৯৮৮ সালে লতা মাঙ্গেশকর গাইলেন’ সবার আড়ালে সাঁঝ সকালে’। এরকম উদাহরণ আরও আছে। আসলে সব সময় নতুন কিছু সৃষ্টির তাগিদ যেন সলিল চৌধুরীকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো। আর সমৃদ্ধ হতো বাংলা বা হিন্দি গানের জগৎ।
সারা জীবন বিশ্বাস করেছেন যে পৃথিবীর সঙ্গীতজগৎকে ভারতীয় সঙ্গীতের অনেক কিছু দেওয়ার আছে। ভারতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে শান্তি ও সহিষ্ণুতার বাণী অনুরণিত হবে বিশ্বসঙ্গীতের দুনিয়ায়। ভারতীয় সঙ্গীতের এক উজ্জ্বল আলোর পথযাত্রী ছিলেন সলিল চৌধুরী।জন্ম শতবর্ষে এই প্রণাম্য স্রষ্টাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য।