সুকান্ত পাল
আপামর ভারতীয় জনগণের কাছে ড: ভীম রাও আম্বেদকর ভারতীয় সংবিধানের প্রধান স্থপয়তি হিসাবেই পরিচিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো তিনি কি শুধুই সংবিধানের প্রধান স্থপয়তি? নাকি ভারতীয় সমাজ, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও রাজনীতির একজন অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব ? যেই ব্যক্তিত্বের তীব্র উজ্জ্বলতায় ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতির এবং তথাকথিত সনাতনী ধর্মের অন্ধকারময় দিক গুলো ঝলসে গিয়েছিল!
আম্বেদকর ১৮৯১ সালের ১৪ই এপ্রিল মধ্যপ্রদেশের মৌ শহরের সেনা নিবাসে রামজী শকপাল ও ভীমা বাঈয়ের চতুর্দশ ও শেষ সন্তান রূপে এক মাহার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। যে পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ভারতীয় মেকি জাতিভেদ লাঞ্ছিত সমাজ ব্যবস্থায় সেই পরিবারটি ছিল অস্পৃশ্য একটি পরিবার। ফলে ছোট বেলা থেকেই তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার কুৎসিত রূপের সঙ্গে ভীষণভাবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। নিজের পরিবার ও নিজের জীবনের লাঞ্ছনা প্রত্যক্ষ করে তিনি ভারতের অসংখ্য অস্পৃশ্য মানবের মানসিক বেদনা ও অপমানকে অনুভব করতে পেরেছিলেন তাঁর হৃদয় দিয়ে। কারণ তিনি নিজেও ছিলেন সেই সমাজের একজন সদস্য। যে সমাজকে অযৌক্তিক ভাবে বলা হতো নিচু শ্রেণীর মানুষের সমাজ। তাদের পরিবার ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী মাহার সম্প্রদায় ভুক্ত।
ভারতের কোটি কোটি লাঞ্ছিত মানুষের মুক্তির সংকল্পে তিনি তাঁর জীবনকে পরিচালিত করেছিলেন। এর জন্য হাজার বাধা বিপত্তি, ব্যঙ্গ – বিদ্রুপকে উপেক্ষা করে উচ্চ শিক্ষিত হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁর লক্ষ্য পূরণের দিকে।
যে কোনো মানুষের জীবন জগৎ সম্পর্কে একটা নিজস্ব দর্শন কাজ করে। সেই দর্শন – ভাবনার জগতের একটা শিকড় থাকে। আম্বেদকরের সেই ভাবনার শিকড়টি প্রোথিত ছিল ধর্মে। তাঁর নিজের ভাষায়, ” My philosophy has roots in religion… I have derived them from the teaching of my master, the Buddha”. তাঁর সামগ্রিক কর্মকাণ্ড তাঁর শিক্ষকের প্রদর্শিত পথেই এগিয়েছে। সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর একমাত্র ধ্যান জ্ঞান। এই সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন অনেক পরিমানেই। প্লেটোর ‘Laws’ এবং ‘ The Republic ‘ পাঠ করে তাঁর সামাজিক দীক্ষা গড়ে ওঠে। এই কারণে অনেকেই তাঁকে “Neo- Platonist ‘ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে একটি আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা গণতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে এবং প্রতিটি মানুষই তাদের নিজস্ব মৌলিক অধিকার নিয়ে বাঁচবে। সামাজিক চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রে সন্ত কবীরের দর্শনও তাঁকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। কবীর মানুষের মানবিকতা, মানুষের মর্যাদা এবং ভ্রাতৃত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন ভীষণভাবে। আম্বেদকরের দর্শনে তারই প্রতিফলন পাওয়া যায়। তাঁর সামাজিক চিন্তার জগতে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন ডিইউ এরও প্রভাব ছিল যথেষ্ট। উপরের প্রত্যেকের দার্শনিক চিন্তার ও তত্ত্বের নির্যাসে আম্বেদকরের নিজস্ব সামাজিক দর্শন এক শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়েছিল এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
আম্বেদকর তাঁর নিজস্ব দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গিকে, বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য শিক্ষা ও রাজনীতিকে হাতিয়ার করেছিলেন। আম্বেদকর তাঁর গভীর পান্ডিত্য ও অধীত বিদ্যায় বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রাচীনকাল থেকেই শাসক শ্রেণি সবসময় উচ্চ ও মধ্য শ্রেণিকেই শিক্ষার সুযোগ দিয়ে এসেছে। আর অগণিত মানুষ রয়ে গেছে শিক্ষা নামক পিলসুজের নিচের গভীর অন্ধকারে। এই কারণেই রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি চিরকাল এইসব সুবিধাভোগীদের হাতেই রয়ে গেছে । অন্যদিকে পিছিয়ে পড়া শ্রেণি ও প্রান্তিক মানুষরা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার একেবারে নিচের সারিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের সমাজের উচ্চ শ্রেণির দয়া দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করে থাকতে হয়। সমাজের নিচু তলার এই প্রান্তিক মানুষের অবস্থা আম্বেদকরের মনে সৃষ্টি করেছিল গভীর যন্ত্রণা। তাই তাঁর জীবনের ব্রতই হয়ে দাঁড়িয়েছিল সমাজের এই বৈষম্য দূর করা।
এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে যেটা প্রয়োজন তা হল শিক্ষা। শিক্ষার আলো ছাড়া পিছিয়ে পড়া মানুষদের এগিয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এমন একজন মহান ব্যক্তির শিক্ষা সম্পর্কিত চিন্তা ভাবনা আমাদের শিক্ষার আলোচনার ক্ষেত্রে তেমন কোনো গুরুত্বই পায় নি। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তাই তিনি বলেন, ” I came from the lowest strata of the Hindu Society; Therefore, I fully realise the importance of education. It is a misconception that the emancipation of the downtrodden does not mean that they should be given enough food, clothes and shelter and be left to serve the higher castes. The real issue is to make them aware of the importance of their existence for the progress of the nation; to make them aware about the reasons of their backwardness which has made them subservient to the higher castes; to make aware about the reasons of their inferiority complex. These problems can not be solved without proper higher education. In my opinion higher education is the only remedy for all our social ills. ” তাঁর এই বক্তব্য থেকে পরিষ্কার দুটো বিষয় বেরিয়ে আসে। প্রথমতঃ সামাজিক বৈষম্য দূর করতে হলে অবশ্যই শিক্ষা গ্রহন করতেই হবে এবং দ্বিতীয়তঃ আম্বেদকর কখনোই প্রান্তিক, তথাকথিত অস্পৃশ্য মানবের উন্নতির ও জাতির উন্নতির মধ্যে কোনো বিভাজন রাখেন নি। এই কারণেই তো তিনি মহান। রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং পদমর্যাদা পাবার জন্য প্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হিসাবে শিক্ষাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পন্ন না হলে নিজেদের অধিকার আদায় সম্পন্ন হবে না — এটাও তিনি তাঁর হৃদয় ও বাস্তবতার আয়নায় বুঝেছিলেন।
তিনি ছিলেন গণতন্ত্রের পূজারী। গণতন্ত্রই ছিল তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের মূল কাঠামো। এর সঙ্গে সঙ্গে তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে সামাজিক বন্ধন ও সম্পর্কই ছিল গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রের সঙ্গে তাঁর ছিল বিরোধ। কারণ এই গনতন্ত্র সাধারণ মানুষের ( masses) স্বাধীনতার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, এবং তাদের সর্ববিধ আনন্দ যাপনের অধিকারকে নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। সামাজিক গনতন্ত্র বা সোস্যাল ডেমোক্রেসির উপর ছিল তাঁর গভীর আস্থা। কারণ এই সামাজিক গণতন্ত্রের মধ্যেই অনুভূত হয় সাম্য ও মৈত্রী। এখানে নৈতিকতা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি সেটাই চেয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ছিল তাঁর লক্ষ্য। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রেই থাকে নৈতিকতা এবং এখানে কোনো বৈষম্য থাকে না। এ কারণেই তিনি আমেরিকার আব্রাহাম লিংকন এর পথ অনুসরণ করে যে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন তার নাম দিয়েছিলেন ‘ রিপাবলিকান পার্টি ‘ । আমেরিকার এই রিপাবলিকান পার্টিই যুক্তরাষ্ট্রের দাস ব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়েছিল। তিনিও তাঁর তৈরি পার্টির মাধ্যমে ভারতবর্ষের মাটি থেকে চিরকালের জন্য দূর করতে চেয়েছিলেন অস্পৃশ্যতার মতো ঘৃন্য এবং মানবতাবিরোধী সমাজ ব্যবস্থা।
আমেরিকার মানুষ যা পেরেছে আমরা তা পারি নি। হতভাগ্য আমরা, না বুঝেছি আম্বেদকরকে না বুঝেছি তাঁর রাজনৈতিক দলের মূল বক্তব্যটি। কারণ এখনও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মনের মধ্যে গেঁথে রয়েছে পুরুষসূক্তের চতুর্বর্ণের অচপল অবৈজ্ঞানিক ধারণাটি। যে ধারণা একটি প্রক্ষিপ্ত বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। আম্বেদকর এটা জানতেন বলেই সমাজের প্রন্তবর্তীদের অন্তরের জ্বালা, অবমাননার যন্ত্রণাকে উপশম শুধু নয়, তাকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি আধুনিক ভারতবর্ষের সামাজিক সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান ঋত্বিক।