এলাহাবাদে বুলডোজার অভিযানকে অবৈধ ঘোষণা করে প্রতিটি পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ২০২১ সালে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ৫টি বাড়ি বেআইনিভাবে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসন। সেই পদক্ষেপকে অবৈধ ঘোষণা করে মোট ৬০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি অভয় এস ওকা এবং বিচারপতি উজ্জ্বল ভুঁইয়ার বেঞ্চ। ছয় সপ্তাহের মধ্যে এই অর্থ দিয়ে দিতে হবে বলেও জানিয়ে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। উল্লেখ্য, গত ২৪ মার্চ এই মামলার শুনানির সময় বিচারপতিরা বলেছিলেন, দেশের মানুষের আবাসিক ঘরকে এইভাবে ভেঙে ফেলা যায় না। এই ঘটনায় আদালতের অন্তরাত্মা কেঁপে গিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট উত্তরপ্রদেশের সরকারকে তীব্র ভর্ৎসনা করে বলেছে, আশ্রয়ের অধিকার বলে একটি বিষয় আছে। সঠিক পদ্ধতি বলেও একটি বস্তু আছে। এই ধরনের পদক্ষেপ কোনওভাবেই ঠিক নয়। বিচারপতিরা বলেছেন, আমরা এই বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি। এই ঘটনায় আমাদের অন্তরাত্মা কেঁপে গিয়েছে। আবেদনকারীদের আবাসিক এলাকা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারী কায়দায় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সমাজবাদী পার্টি নেতা অখিলেশ যাদব সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ঘর কেবল পয়সায় তৈরি হয় না। ঘর ভাঙার ক্ষতও শুধু পয়সায় পূর্ণ হয় না। ঘর ভাঙায় যে আবেগের মৃত্যু হয়, তার কোনও ক্ষতিপূরণ হয় না। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ১৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট ঐতিহাসিক রায়ে ‘বুলডোজার ন্যায়’ রুখতে নির্দেশিকা জারি করেছিল।
উল্লেখ্য, উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার ‘বুলডোজার ন্যায়’ ব্যবস্থা চালু করেছে। আইন-আদালত, বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নয়, কাউকে অপরাধী মনে হলেই সরকার তাঁর বাড়ি ও সম্পত্তি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। মূলত মুসলিমদের বিরুদ্ধে বুলডোজারকে হাতিয়ার করা হচ্ছে। এইভাবেই ২০২১ সালে এলাহাবাদে দুষ্কৃতী আতিক আহমেদের সম্পত্তি মনে করে ৫টি বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয় এলাহাবাদ প্রশাসন। আইনজীবী অভিমন্যু ভাণ্ডারী সুপ্রিম কোর্টে সওয়ালের সময় জানান, আতিক আহমেদ নামের একজন দুষ্কৃতী ছিল, যাকে ২০২৩ সালে হত্যা করা হয়। তার আগেই ২০২১ সালে ২৪ ঘণ্টার নোটিশে এই পাঁচটি বাড়িকে আতিকের সম্পত্তি মনে করে ভেঙে দেওয়া হয়। প্রশাসনের উচিত ভুল স্বীকার করে নেওয়া।
উত্তরপ্রদেশে সরকারের দাবি, তারা নিয়ম মেনেই বুলডোজার চালিয়েছে। আইনজীবী ওকা সেই দাবি মানতে চাননি। তিনি বলেছেন, এইভাবে একটা নোটিশ সাঁটিয়ে দিয়ে বাড়ি ভেঙে ফেলা অত্যাচার ছাড়া কিছু নয়। উত্তরপ্রদেশ সরকারের পক্ষে সওয়াল করে অ্যাটর্নি জেনারেল আর ভেঙ্কটরামন দাবি করেছেন, ‘এই ঘটনায় যে পাঁচজনের বাড়ি ভাঙা হয়েছে তাদের মধ্যে কেউই ঘরছাড়া হননি।’ এমন যুক্তি শুনে বিচারপতি ওকা অ্যাটর্নি জেনারেলকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘একজন ব্যক্তির থাকার জায়গার অভাব নেই বলে রাষ্ট্র তাঁর বাড়ি থেকে তাঁকে যখন তখন বেদখল করে দিতে পারে না। তার জন্য বেদখল করার যুক্তি আইনত প্রমাণ করতে হবে। তারও আগে তাঁকে যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে নোটিশ দিতে হবে এবং সেই নোটিশের বিরুদ্ধে পাল্টা সওয়াল করার সুযোগ দিতে হবে।’
যাঁদের বাড়ি ভেঙে দেওয়া হয় তাঁদের মধ্যে আইনজীবী জুলফিকার হায়দর, অধ্যাপক আলি আহমদ ছাড়াও দুই বিধবা মহিলার বাড়িও ছিল। এঁরা প্রথমে এলাহাবাদ হাইকোর্টে আবেদন জানিয়েছিলেন। আবেদন খারিজ করে দেয় এলাহাবাদ হাইকোর্ট। রাজ্য সরকার আদালতে জানায়, ওই জমি সরকারি, বেআইনিভাবে দখল করা হয়েছে। এরপর আবেদনকারীরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। তাঁরা আদালতে জানান, ২০২১ সালের ৬ মার্চ রাতে নোটিশ ধরানো হয়। ৭ মার্চ সকালে বুলডোজার দিয়ে পাঁচজনের ঘর ভেঙে দেওয়া হয়। যদিও নোটিশে ১ মার্চের তারিখ দেওয়া ছিল। আবেদনকারীদের বক্তব্য, যে জমির উপরে তাঁদের ঘর ছিল, তাঁরা লিজ হোল্ডার ছিলেন।
ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশের সময়ে বিচারপতি উজ্জ্বল ভুঁইয়া ‘বুলডোজার ন্যায়’ নিয়ে কঠোর মতামত দিয়েছেন। তিনি সাম্প্রতিককালে উত্তরপ্রদেশেরই আম্বেদকর নগরে জবরদখল হটানোর নামে গরিব মানুষের ঝুপড়ি ভেঙে দেওয়ার একটি ভিডিওর উল্লেখ করেন, যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, বুলডোজারের মুখে একটি ছোট্ট মেয়ে ঝুপড়ি ঘরের ভেতর থেকে নিজের বই-খাতা বুকে আগলে বের করে নিয়ে আসছে। মর্মান্তিক সেই ভিডিওর উল্লেখ করে বিচারপতি ভুঁইয়া বলেছিলেন, ওই ছবি সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আশ্রয়ের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না।