সন্দেহে সিবিআই

ফাইল চিত্র

কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি (সিএফএসএল)-র রিপোর্ট আরজি করের ঘটনার তদন্তে সিবিআইয়ের ভূমিকা বা তদন্তের উদ্দেশ্য নিয়েই গুরুতর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। সামনে এসেছে সিবিআইয়ের পরিকল্পিত অপদার্থতা এবং জেগে ঘুমানোর প্রমাণ। সিএফএসএল-এর রিপোর্টে যেমন কলকাতা পুলিশের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, তেমনই সিবিআইয়ের তদন্ত প্রক্রিয়া এবং তদন্তের অভিমুখ নিয়েও গুরুতর সন্দেহ সামনে এনে দিয়েছে।

সিএফএসএল-এর বারো পাতার রিপোর্টের শেষে বলা হয়েছে, আরজি করের চারতলার সেমিনার রুমে ধর্ষণের আগে ধস্তাধস্তির কোনও চিহ্ন মেলেনি, যেভাবে ম্যাট্রেসের নির্দিষ্ট দু’টি জায়গায় দাগ মিলেছে তাতে অন্যত্র ধর্ষণ-খুনের পর মৃতদেহ সেমিনার রুমে নিয়ে এসে পোডিয়ামের উপর ম্যাট্রেসে শোয়ানো হয়েছিল। চারতলা আদৌ ঘটনাস্থল কিনা, সেই সব থেকে জরুরি প্রশ্নই উস্কে দিয়েছে এই রিপোর্ট। অথচ সিএপএসএল-এর রিপোর্টের কোনও প্রতিফলন দেখা যায়নি সিবিআই চার্জশিটে। বরং চার্জশিটে চারতলার সেমিনার রুমকে ঘটনাস্থল ধরে নিয়ে ঘটনার বিবরণ রয়েছে এবং একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের নাম রয়েছে। কেন্দ্রীয় এক সংস্থার এমন রিপোর্টের কোনও উল্লেখই নেই আর এক কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআইয়ের চার্জশিটে।

গত ১৪ আগস্ট আরজি করে এসে সরেজমিনে তদন্ত ও পর্যবেক্ষণ করে সিএফএসএল-এর একটি টিম। সেই রিপোর্ট সিবিআইয়ের কাছ যায় ১২ সেপ্টেম্বর। সিএফএসএল-এর রিপোর্টেও সেই তারিখের উল্লেখ আছে। আর সিবিআই আরজি করের ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় শিয়ালদহ আদালতে প্রথম দফার চার্জশিট দাখিল করেছিল ৭ অক্টোবর। মাঝে ব্যবধান তিন সপ্তাহের বেশি।


সিএফএসএল-এর রিপোর্ট মাত্র ১২ পাতার। এই রিপোর্ট কি তিন সপ্তাহের মধ্যেও কি পড়ে উঠতে পারেননি সিবিআই আধিকারিকরা! তিন সপ্তাহ আগে এই রিপোর্ট সিবিআইয়ের হাতে আসার পরও তার প্রতিফলন নেই চার্জশিটে। এই রিপোর্ট যুক্ত করা হয়নি চার্জশিটে।

অথচ গত ৭ অক্টোবর সিবিআই যে চার্জশিট আদালতে জমা দিয়েছিল তার ১৬.২২ অনুচ্ছেদে গত ১৪ আগস্ট কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির তদন্তকারী দলের আরজি করে আসা, চার তলার সেমিনার রুম পর্যবেক্ষণ করা, ছবি তোলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ তারপর যে রিপোর্ট দিল সিএফএসএল, তার উল্লেখ নেই চার্জসিটে। এর উল্লেখ থাকলে প্রথম দফার চার্জশিটের বয়ান বদলে যেত। কেন্দ্রীয় সংস্থার রিপোর্ট বলছে, চারতলার সেমিনার রুমে ভৌগোলিক অবস্থান যা তাতে সকলের অগোচরে একজন ব্যক্তি ঢুকে ধর্ষণ-খুন করে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, সামনেই নার্সিং স্টেশন রয়েছে, যেখানে দিনের ২৪ ঘণ্টায় নার্স কিংবা হাসপাতালের স্টাফরা থাকেন। সেই নার্সিং স্টেশন পেরিয়েই সেমিনার রুমে ঢুকে এত বড় অপরাধ সংগঠিত করা সকলের অগোচরে তার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

সিএফএসএল-এর রিপোর্ট আরসিবিআইয়ের চার্জশিটের বয়ানের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। তাই সিএফএসএল রিপোর্টটি উহ্য বা গোপন রেখেই এমন চার্জশিট দায়ের করতে হল সিবিআইকে। এখানেই সন্দেহ আর প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। প্রথম দফার চার্জশিটে সিবিআই যেভাবে চারতলার সেমিনার রুমে একাই ঢুকে গোটা ঘটনা সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায় ঘটিয়েছে বলে কলকাতা পুলিশের বিবরণ দিয়েছিল, তার সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না সিএফএসএল-এর রিপোর্ট। তাহলে কি পরিকল্পিতভাবেই কেন্দ্রীয় ফরেন্সিকের রিপোর্টকে গোপনে রেখেই এমন চার্জশিট? সিবিআইয়ের ভূমিকায় এখানেই গুরুতর সন্দেহ দানা বাঁধছে।

সিএফএসএল-এর আধিকারিকরা যখন ১৪ আগস্ট আরজি করের চারতলায় চেস্ট মেডিসিনের সেমিনার রুমে যায় তদন্ত করতে তখনই সেই ক্রাইম সিন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। রিপোর্টের প্রথম পাতাতেই তার উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘ক্রাইম সিন নিজেই সন্দেহজনক’। আশ্চর্যজনকভাবে সিএফএসএল রিপোর্টের কোনও প্রতিফলন দেখা গেল না সিবিআইয়ের চার্জশিটে। এই রিপোর্ট সামনে আসার পর সিবিআইয়ের চার্জশিটের বয়ান নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়। ঘটনা পরম্পরা বলছে এখন আরজি করের তদন্তে সিবিআইয়ের ভূমিকাই সব থেকে বেশি ‘সন্দেহজনক’।