পদত্যাগ ও দেশত্যাগ

ছাত্র আন্দোলনের জেরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৯ সালে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তারপর থেকে টানা চারবার ক্ষমতায়। কিন্তু চতুর্থবার ক্ষমতায় ফেরার বছর ঘোরার আগেই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে হল শেখ হাসিনাকে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের মাটিও ছাড়তে বাধ্য হলেন মুজিব-কন্যা। সেনাশাসন সরিয়ে ক্ষমতায় গিয়েছিলেন তিনি। হাসিনার পদত্যাগের পর ফের সেনার অধীনে গেল বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকেই রাজনীতির ময়দানে পদার্পণ শেখ হাসিনার। বাবা শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান সরকার গ্রেফতার করার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সেতু হিসেবে কাজ করতেন শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনার হাতে শেখ মুজিবুর, তাঁর স্ত্রী ও তিন সন্তান খুন হন। বিদেশে থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে যান হাসিনা ও তাঁর বোন রেহানা। সেই সময় ৬ বছর ভারতে আশ্রয় নেন হাসিনা। ভারতে থাকাকালীনই আওয়ামি লিগের প্রধান নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ফিরতে সক্ষম হন হাসিনা। দেশে ফিরেই সেনা শাসনের বিরুদ্ধে সরব হন তিনি। এর জন্য একাধিকবার তাঁকে গৃহবন্দিও করা হয়। ১৯৯১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হয় আওয়ামি লিগ। বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি।

তবে পাঁচ বছর পরই পালাবদল ঘটে। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন হাসিনা। তারপর ফের ২০০১ সালে ক্ষমতা হারান তিনি। ২০০৪ সালে হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালানা হয়। তবে প্রাণে বেঁচে যান। এরপর বিপুল ভোটে জিতে ২০০৯ সালে ফের প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। ক্ষমতায় এসে মুক্তি যুদ্ধের সময় পাকিস্তানপন্থীদের বিচারের জন্য ট্রাইবুনাল গঠন করেন। ২০১৩ সালে জামাত-ই-ইসলামিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। মায়ানমার থেকে আসা লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে সারা বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। পাশাপাশি, হাসিনার আমলে বাংলাদেশের জিডিপি তিনগুণ বৃদ্ধি পায়। খাদ্য উৎপাদন ও জীবনযাত্রার মানও উন্নত হয়। পদ্মা নদীর ওপর সেতু তৈরির সাফল্যও রয়েছে হাসিনার মুকুটে। যদিও হাসিনা-বিরোধীদের অভিযোগ, একের পর এক নির্বাচনে রিগিং করে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামি লিগ। ২০২৪ সালের নির্বাচন বয়কট করেছিল বিএনপি ও তার সহযোগী দলগুলি। হাসিনাকে ‘স্বৈরাচারী’ ও ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ বলেও আখ্যা দিয়েছে বিরোধীরা।


সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে মাত্র ৩৭ দিন আগে ছাত্রদের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকেই পালাতে হল শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে। স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের পর দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য সরকারি চাকরিতে যে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, একসময়ে হাসিনাই প্রধানমন্ত্রীর পদে বসে সেই সংরক্ষণ তুলে দিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে এক মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের মামলার রায়ে ঢাকা হাইকোর্ট সেই সংরক্ষণ ফিরিয়ে দিলে তা বাতিলের দাবিকে সামনে রেখে শুরু হয়েছিল ছাত্র আন্দোলন। প্রথম দিকে তা শান্তিপূর্ণ থাকলেও ক্রমশ সেই বিক্ষোভ দাবানলের মতো সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হয় এবং তার জেরে দেশজুড়ে সংঘাত আর তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যুর মধ্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে হল। এর মধ্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হাসিনা সরকারের আপিলেই সাড়া দিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দিলেও বাংলাদেশ শান্ত হয়নি। অনেকেই ভেবেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর বাংলাদেশ শান্ত হয়ে আসবে এবং হাসিনা সরকার পরিস্থিতি সামলে উঠতে পারবেন, কিন্তু তা হলো না।

অনেক বেশি অনিশ্চয়তার মুখে এখন দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। হাসিনার ইস্তফা এবং দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে উন্মত্ত জনতা গণভবন, সংসদ ভবন, বঙ্গবন্ধু ভবন ইত্যাদি দখল করে অগ্নি সংযোগ ও লুঠপাট করতে শুরু করল, তা দেশে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, আন্দোলনের রাশ এখন আর ছাত্রদের হাতে নেই। চলে গেছে হাসিনা-বিরোধী, ভারত-বিরোধী শক্তির হাতে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু নাগরিকদের উদ্বেগ বাড়তে শুরু করল। এই আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিরোধী শক্তির উপস্থিতির ইঙ্গিত স্পষ্ট। সেই শক্তি আবার বাংলাদেশে জমি ফিরে পাবার চেষ্টা করছে। সেনাবাহিনীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে অনিশ্চয়তা, না স্থিতি, ভবিষ্যতের এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে বলে আশা করা যায়।