এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার, যে হিংসা এতদিন গ্রামীণ বাংলায় সীমাবদ্ধ ছিল তা এখন এক কঠিন মুহুর্তে সরকারি বণ্টন ব্যবস্থা অর্থাৎ রেশন ব্যবস্থার ওপর আছড়ে পড়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির প্রেক্ষিতে রেশন ব্যবস্থার গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে, কিন্তু ক্ষুধার কান্নার সঙ্গে (তা শুধু আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়) এই ব্যবস্থার ওপর হিংসাও ছড়িয়ে পড়েছে।
কেন্দ্র থেকে অপ্রতুল সরবরাহ, বিশেষ করে ডালের অপ্রাপ্তি নিয়েই বর্তমানে রেশন ব্যবস্থা আক্রমণের মুখে পড়েছে। এছাড়াও কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভিন্ন কারণ অবশ্য আছে। এই হিংসা ২০০৭-এর অক্টোবর ও তারও আগে ১৯৬৬-এর খাদ্য দাঙ্গার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে, যখন রেশন দোকানের জন্য নির্দিষ্ট খাদ্যদ্রব্য চোরা পথে খোলা বাজারে পাচার হয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছিল।
বর্তমান রাজ্য সরকার তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করতে না পারলেও কত সংখ্যক মানুষ এই খাদ্যের সরবরাহ ব্যবস্থার সুযোগ পাবে তাদের সংখ্যা নিরুপণ করে তার জন্য কতটা খাদ্যদ্রব্যের প্রয়োজন হবে, তা এখনও স্থির করে উঠতে পারেনি।
এক কথায় প্রশাসন বিরোধীদের, বিশেষ করে বিজেপি ও কিছুটা হলেও সিপিএমের হাতে খেলতে বাধ্য হয়েছে। এই দুটি দল ক্ষুধার্ত মানুষকে খেপিয়ে তুলেছে বলে সরকারের ধারণা, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ ও পূর্ব বর্ধমান জেলায়।
কারা বিনা ব্যয়ে অতিরিক্ত খাদ্যশস্য পাবে, সে ব্যাপারে কোনও স্বচ্ছতা নেই। এই নিয়েই ২০০৮-০৯ সালে কেন্দ্র ও যোজনা কমিশনের মধ্যে বিরোধ বেঁধেছিল। পুরোধা খাদ্য নিরাপত্তা আইন অনুসারে দারিদ্রসীমার নীচে অবস্থানকারীদের জন্য খাদ্যশস্যের পরিমাণ কী হবে, সেটাই ছিল বিরোধের বিষয়। দুঃখের বিষয় হল, কেন্দ্রে সরকার বদল হলেও আজকের দিনে জীবনের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই গেছে।
২৬ মার্চ থেকে প্রথম দফার লকডাউন চালু হওয়ার পরই কেন্দ্র দরিদ্রদের জন্য প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা চালু করে দেয়। এটা তিন মাসের কর্মসুচি। এতে বলা হয় বাংলায় যারা জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনের আওতায় পড়েন তারা জুন মাস পর্যন্ত বিনা ব্যয়ে মাথা প্রতি ৫ কেজি চাল ও এক কেজি ডাল পাবেন। রেশনে তাদের স্বাভাবিক বরাদ্দের ঊর্ধ্বে তারা এই কেন্দ্রীয় বরাদ্দ পাবেন।
কিন্তু চাহিদা ও জোগানের মধ্যে একটা বড় পার্থক্যকে কেন্দ্র করেই রেশন ব্যবস্থায় চুড়ান্ত বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এর ফলে রাজ্যে খাদ্য সংকট করোনা সংকটকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। এই ভয়ঙ্কর মহামারির সঙ্গে খাদ্য সংকট মোকাবিলাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই ব্যবস্থা চালু রাখার জন্য রাজ্যের যেখানে মাসে ১৪ হাজার টন ডাল প্রয়োজন, সেখানে রাজ্য কেন মাত্র ৪ হাজার টন ডাল পেল, তা কেন্দ্রকে খতিয়ে দেখতে হবে। তাই রাজ্য প্রশাসন ডাল বন্টন বন্ধ রেখেছে। তারা বলেছে, কেন্দ্র থেকে রাজ্যের পুরো ডালের কোটা পাওয়ার আগে তা বণ্টন করতে গেলে গণ্ডগোল হতে পারে।
দরিদ্র ও ক্ষুধার্তরা চাহিদা ও জোগানের তত্ত্ব বুঝবে এটা আশা করা যায় না। এ ব্যাপারে সমন্বয়ের একটা বড় অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি একটা কুৎসিত সত্যের দুর্বল জবাব মাত্র।