বিদ্যুৎ রাজগুরু
‘রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,/ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম। /
/পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি,/ মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী।” কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই পঙক্তিগুলো আমাদের পরিচিত। রথযাত্রা উপলক্ষে ভক্তবৃন্দ এমনভাবে নিমগ্ন থাকে, জীবনের পরম সত্যটি তারা ভুলে যায়। আড়ম্বর সর্বস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানে লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষই বড়ো হয়ে যায়। সুসজ্জিত পথ, রথ আর মূর্তি এসব তো বাহ্যিক উপকরণ মাত্র। প্রকৃত ঈশ্বর রয়েছে হৃদয় মন্দিরে। তবুও ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগণে’-ভরা বর্ষায় রথের মেলায় ঘটে মহা-সম্মিলন। ধর্মীয় চেতনার বাইরেও মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় সামাজিক ও লৌকিক আচরণগুলি। ধর্মীয় গাম্ভীর্য, পুরাণ, কল্পকাহিনী আর ঐতিহ্যের মিশেলে ঘন ঘোর আষাঢ়ে রথের মেলার সূচনা। যাকে ঘিরে সমাজে আসে প্রাণ চাঞ্চল্য। রথ হল চাকা যুক্ত ঘোড়ায় টানা গাড়ি।
পৌরাণিক কাহিনীতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থেকে শুরু করে বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি যুগেও রথ শব্দটির বহুল ব্যবহার রয়েছে। রাজ আমলের যুদ্ধযান আজ ভোট যুদ্ধেও ব্যবহৃত হচ্ছে আকছার। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই পবিত্র রথযাত্রা উৎসব তাৎপর্য মণ্ডিত। তাঁরা মনে করেন, স্বয়ং ভগবানের যান রথ। রয়েছে বিভিন্ন কাহিনী, মিথ, লোকবিশ্বাস আর সংস্কার। মালবরাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন বিষ্ণুর ভক্ত ছিলেন। তাই ভক্ত রাজার সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে পূজিত হতে সাগরতটে ভাসমান কাঠ থেকে বিষ্ণু বা কৃষ্ণ মূর্তি নির্মাণে রাজাকে আদেশ দেন। কিন্তু ভেসে আসা কাঠ এমন শক্ত যে, তা থেকে মূর্তি গড়া দুরূহ কাজ।
এবার শিল্পীর বেশে স্বয়ং ভগবানের আবির্ভাব ঘটে। ছদ্মবেশী জগন্নাথ কিছু শর্ত আরোপ করে মূর্তি গড়তে রাজি হন। বিগ্রহ গড়বার কর্মকাণ্ড কেউ দর্শন করবে না এমন শর্ত রানী ভঙ্গ করলে জগন্নাথ মূর্তি গড়বার কাজ অসম্পূর্ণ রেখে অদৃশ্য হয়ে যান। পড়ে থাকে জগন্নাথদেবের হস্তপদবিহীন দেহ। মূর্তির না আছে হাত, না আছে পা। অনুশোচনায় বিহ্বল হয়ে পড়লে স্বপ্ন দিয়ে জগন্নাথ জানিয়ে দেন, তিনি এই রূপেই পূজিত হবেন। এই প্রসঙ্গে কঠোপনিষদে বলা হয়েছে, “না আত্মানং রথিনংবিদ্ধি শরীরং রথমেবতু”- অর্থাৎ, এই দেহই রথ, আর আত্মা দেহরূপ রথের রথী। ঈশ্বর অরূপ। তিনি অন্তরে বিরাজমান।
বিষ্ণু ও কৃষ্ণ উপাসকদের পবিত্র তীর্থস্থান পুরীর জগন্নাথ ধাম। এই মন্দির নির্মাণের ইতিহাস সুপ্রাচীন। দেশের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ রথযাত্রা উড়িষ্যায় পুরীর জগন্নাথের রথযাত্রা। এছাড়াও আমাদের রাজ্যের মায়াপুরে ইসকনের রথ, শ্রীরামপুরে মাহেশের রথ সহ বিভিন্ন এলাকায় প্রাচীন রথযাত্রা উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে উদযাপিত হয়।উড়িষ্যার প্রাচীন পুঁথিতে রথযাত্রার প্রচলন সত্য যুগে হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মালব দেশের বিষ্ণুভক্ত সূর্যবংশীয় রাজা ছিলেন ইন্দ্রদ্যুম্ন। ‘ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ’ ও ‘পদ্মপুরাণে রথযাত্রার উল্লেখ রয়েছে। কবিগুরু যথার্থই বলেছেন,‘উপলক্ষ যাই হোক না কেন, বাঙালির সকল উৎসবের মধ্যে একটা সর্বজনীন রূপ আছে। এতে ধর্ম, সম্প্রদায়, জাত-পাত বা ধনী-গরিবের সামাজিক বিভক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বরং সকল শ্রেণির মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়।’
রথযাত্রার মতো লোক উৎসব তেমনই এক উৎসব। বাংলার আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়ায় রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু নীলাচল থেকে রথযাত্রার ধারাটি বাংলায় প্রচলন করেন। যাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু ঐতিহ্যশালী রথযাত্রা এই পবিত্র দিনে অনুষ্ঠিত হয়। ভারতবর্ষে রথযাত্রা উৎসব অতি প্রাচীন।আনুষ্ঠানিকতার ধরণ পরিবর্তন হলেও সামাজিক উৎসবের কৃষ্টি, সংস্কৃতি বদলে যায়নি। রথযাত্রা উৎসবকে ঘিরে যেমন বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে, তেমনি তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থার চিত্র উঠে আসে প্রচলিত প্রবাদ প্রবচনে, ‘তোদের হলুদ মাখা গা, তোরা রথ দেখতে যা। আমরা পয়সা কোথায় পাব? আমরা উল্টো রথে যাব।’
উল্লেখ্য, রথযাত্রার শুভারম্ভের সাতদিন পর বলভদ্র, জগন্নাথ ও সুভদ্রার রথরীতি সংস্কার মেনে ফিরে আসে মূল মন্দিরে। সেদিনও ‘উল্টো রথ’-এর মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
বর্ষাস্নাত মেঘমেদুর আকাশ আর সজল ধরিত্রী পল্লবিত হয় ঘন সবুজে আর আনন্দ অনুষ্ঠানের আবেশে। কামিনী, চাঁপার মিষ্টি সুবাসে রথের মেলার জিলেপি আর পাঁপড় ভাজার গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। শিশু-কিশোর এই দিনটির জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকে। বড়দের রথের অনুকরণে পাড়ায় পাড়ায়, অলিতে গলিতে শিশু-কিশোরদের রথ টানা পরিচিত দৃশ্য আজও দেখা যায়। একদা রথের মেলা থেকে কেনা বিভিন্ন খেলনাতে ঘটত সমাজের সব কিছুর প্রতিফলন। শিশু-কিশোর বেলা বেড়ে উঠত রথের মেলা দেখতে দেখতে। খেলনাপাতি, রকমারি কাঠের পুতুল অর্থাৎ বড়দের সংসারের অনুকরণে বাসনকোশন সহ আরও কত কী! কিন্তু বর্তমানে মহার্ঘ খেলনার জঞ্জালের পাহাড়ে হারিয়ে যাচ্ছে না তো মাটির গন্ধমাখা স্বপ্নময় প্রতিফলনের খেলনা সম্ভার? কিংবা মা ঠাকুমার অনুকরণে পুতুলদের মাতৃস্নেহে মাতৃদুগ্ধ দিয়ে ঘুমপাড়ানির আধো আধো সঙ্গীত। মনোজগতের মহার্ঘবোধগুলি অঙ্কুরিত হয় নির্ভেজাল নিষ্কলুষ মাটির গন্ধমাখা মেলা থেকেই।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের ‘রাধারাণী’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ছিল মাহেশের রথযাত্রা। রথযাত্রার প্রাণবন্ত রূপ যেমন দেখতে পাই, তেমনি মর্মস্পর্শী অথচ নির্ভেজাল রোমান্টিক সাহিত্যের জন্ম দেয় রথের মেলা। ‘রাধারাণী কাঁদিতে কাঁদিতে কতকগুলি বনফুল তুলিয়া তাহার মালা গাঁথিল। মনে করিল যে, এই মালা রথের হাটে বিক্রয় করিয়া দুই, একটি পয়সা পাইব। তাহাতেই মার পথ্য হইবে’- জানি না আধুনিকতায় সাহিত্য সম্রাটের রাধারানীরা আর বৃষ্টিভেজা রথের মেলায় বনফুলের মালা গেঁথে হাজির হয় কিনা? তবুও রথের মেলা হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী। কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ। সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ’।