মহম্মদ শাহাবুদ্দিন
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টির পথে মানবতার প্রত্যয় নিয়ে হেঁটেছেন৷ জীবনের প্রান্তলগ্নে পৃথিবীর পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপের মধ্যে তিনি মানুষের প্রতি বিশ্বাস রেখেছিলেন৷ মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে তিনি কখনও চরম বলে মেনে নিতে পারেননি৷ কবি দেখেছিলেন ভগ্নপ্রায় গ্রামীণ অর্থব্যবস্থার ওপর গড়ে উঠতে থাকা নগর সভ্যতাকে৷
তাঁর সৃষ্টির কাল থেকে গত শতাব্দীর তিরিশের দশক অবধি দেখেছিলেন দেশ, সমাজ ও বিশ্বের পালাবদল৷ তাঁর সমাজ ইতিহাসের দৃষ্টিভঙ্গী নিবদ্ধ ছিল সুদূর অতীতে৷ রবীন্দ্রনাথ এক-একটা সমাজকে দেখেছিলেন সভ্যতার এক-একটা অংশ রূপে, তার মধ্যে খুঁজেছেন সমাজ-ইতিহাসের নিরবচ্ছিন্ন প্রবহমানতাকে৷ এই প্রবহমান সভ্যতার ধারায় বড় কথা হল মানবধর্ম৷ মানবধর্মকে তিনি স্থাপন করেছেন বিশ্ব ঐক্যবোধ ও সমন্বয়ের সঙ্গে৷ রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন বিশ্ব মানবজাতির গৌরবের উজ্জ্বল সৃষ্টি ধারাকে৷ বিশ্বভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন মানুষের মনভূমিতে৷ তাঁর কাব্য, কথাসাহিত্য, ইতিহাস আলোচনায়, সমাজ বিশ্লেষণে, সৌন্দর্য, রসবোধের ব্যাখ্যায়, লোকসাহিত্যের অনুসন্ধানে এই ভাবনা বার বার আভাসিত হয়েছে৷ এই ভাবনায় যে ঐক্যবোধের প্রকাশ ঘটেছিল, তার মূলে ছিল কবির ভারতীয় সমাজজীবনের অন্তঃস্রোতধারাকে আবিষ্কারের প্রয়াস৷
স্বদেশি জাগরণ ও আমাদের জাতীয়তাবাদ উন্মেষের সময়পর্বে রবীন্দ্রনাথ দেশের সামাজিক রাজনৈতিক প্রবাহের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন৷ তার আগে তিনি দেখেছেন নদীমাতৃক বাংলার মানুষের গ্রামজীবনকে৷ শিলাইদহ পতিসরের মানুষের জীবন, তাদের সরলতা, দুঃখ দারিদ্র্যকে রবীন্দ্রনাথ খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন৷ পদ্মাতীরের মানুষের ভালোবাসা কবিকে যে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর লেখায়— ‘এখানকার প্রজাদের ওপর বাস্তবিক মনের স্নেহ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, এদের সরল ছেলেমানুষের মতো আবদার শুনলে মনটা আর্দ্র হয়ে ওঠে, যখন তুমি বলতে তুই বলে, যখন আমাকে ধমকায় ভারী মিষ্টি লাগে৷’
এইসব মানুষের স্মৃতি ভালোবাসা কবির মনে নিভৃতে চিরটাকাল বেঁচে ছিল৷ একদিন এই গ্রাম সমাজের অর্থনীতিকে কবি ভেঙে যেতে দেখেছেন, পরিবার সম্পর্কের মধ্যে দেখেছেন ভাঙন৷ শান্তিনিকেতনে আশ্রম বিদ্যালয়ের কর্মযজ্ঞে পল্লী উন্নয়নের প্রয়াসের মধ্যে আমরা তাঁর আদর্শ গ্রামজীবনের স্বপ্নকে রূপায়িত হতে দেখি৷ কৃষিকে ভালোবেসে কবি সুরুল শ্রীনিকেতনে শুরু করেছিলেন কৃষি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান৷
গ্রাম সমাজের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ এক সমবায় সমাজ৷ তাঁর মতে— ‘সাধারণ মানুষের কাছে সম্পত্তি আপন ব্যক্তিরূপের ভাষা— সে হারালে সে যেন বোবা হয়ে যায়৷ অথচ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবাধ অধিকার ও তার নির্বিচার প্রয়োগ শোষণ, নিষ্ঠুরতা ও হানাহানির কারণ৷ এর একটি মাঝামাঝি সমাধান ছাড়া উপায় আছে বলে মনে করিনে— অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে, অথচ তার ভোগের একান্ত স্বাতন্ত্র্যকে সীমাবদ্ধ করে নিতে হবে৷ সেই সীমার বাইরেকার উদ্বৃত্ত অংশ সর্বসাধারণের জন্য ছাপিয়ে যাওয়া চাই৷ তা হলেই সম্পত্তির মমত্বলুব্ধতায় প্রতারণা বা নিষ্ঠুরতায় গিয়ে পেঁৗছবে না৷’ অর্থ সম্পত্তিকে নিয়ে জীবনবোধের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন সমবায়ের আদর্শ৷ যেখানে সম্পদের উদ্বৃত্ত অংশ সাধারণ মানুষের কাছে পেঁৗছতে পারবে৷ রবীন্দ্রনাথ পল্লী মানুষের ভাবনায় আত্মশক্তি ও সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন৷ চেয়েছিলেন প্রকৃতি পরিবেশকে বাঁচিয়ে পরনির্ভরতা থেকে মুক্তি৷ মনে করতেন শুধু আর্থিকভাবে নয়, মানুষের মধ্যে যে সংস্কার বিভেদের প্রাচীর গড়ে উঠেছে, সমবায় মানসিকতা তাকে ভেঙে বৃহত্তর বৃত্তের সঙ্গে যুক্ত করতে পারবে৷ রবীন্দ্রনাথ সামাজিক নৃতত্ত্বকে জনজাতির এক বৃহত্তর পরিধির মধ্যে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন৷ তাঁর সমাজদৃষ্টি প্রসারিত হয়েছিল অবহেলিত পিছিয়ে পড়া জাতির মধ্যে, সেখানে এসে মিশেছে খেটেখাওয়া শ্রমিকের দল৷ তাঁর কথায়— ‘আমরা নৃতত্ত্ব অর্থাৎ Ethonology-র বই যে পড়ি না তাহা নহে, কিন্ত্ত যখন দেখিতে পাই সেই বই পড়ার দরুণ আমাদের ঘরের পাশে যে হাড়ি, ডোম, কৈবর্ত, বাগদি রহিয়াছে, তাহাদের সম্পূর্ণ পরিচয় পাইবার জন্য আমাদের লেশমাত্র ঔৎসুক্য জন্মে না৷’ রবীন্দ্রনাথ দেখাতে চেয়েছেন, দেশের মানুষকে নিয়ে আমরা কত বড় কুসংস্কার মনে গেঁথে রেখেছি৷ তিনি বলছেন— ‘সমাজ জীবনের শরিক খেটেখাওয়া মানুষ৷ আমাদের ছাত্রগণ যদি তাহাদের এই সকল প্রতিবেশীদের সমস্ত খোঁজে একবার ভাল করিয়া নিযুক্ত হন তবে কাজের মধ্যেই কাজের পুরস্কার পাইবেন সন্দেহ নাই৷’
মানুষের আত্ম উপলব্ধি জাগাতে রবীন্দ্রনাথ চেয়েছেন সামাজিক স্বাধীনতা৷ রাশিয়া ভ্রমণে তিনি মানবসভ্যতার গৌরবের জয়কে অনুভব করেছেন৷ তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠেছে সভ্যতার এক নতুন ইতিহাস৷ তাঁর মতে— ‘বহুদূর ব্যাপী একটা ক্ষেত্র নিয়ে এরা একটা নূতন জগৎ গড়ে তুলতে কোমর বেঁধে লেগে আছে৷’ তিনি লিখছেন— ‘যাঁদের হাতে ধন, যাদের হাতে ক্ষমতা, তাদের হাত থেকে নির্ধন ও অক্ষমেরা এই রাশিয়াতেই অসহ্য যন্ত্রণা বহন করেছে৷ দুই পক্ষের মধ্যে একান্ত অসাম্য অবশেষে প্রলয়ের মধ্য দিয়ে এই রাশিয়াতেই প্রতিকার সাধনের চেষ্টায় প্রবৃত্ত৷’
রুশ বিপ্লবের সাফল্যের চাইতেও কবির কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল ব্যক্তিগত স্বার্থের ভাগাভাগিকে অস্বীকার করে ঐক্যের ভিত্তিতে নূতন সমাজ গড়ে তোলা৷ রুশ বিপ্লবের শ্রমজীবী মানুষের বিজয়কে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, এ শুধু মানুষের বিজয় নয়, মানবসভ্যতার এ এক নতুন দিগন্তের আভাস৷ মানুষের মুক্তির পথ খুঁজতে তিনি কোনও দিন থেমে থাকেননি৷ ১৮৯৭ সালে ব্রিটিশের জনবিরোধী নীতির প্রতিবাদে তিনি লিখেছিলেন ‘কণ্ঠরোধ’৷ নিবন্ধটিতে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা শুনিয়েছেন৷ ‘স্বদেশি সমাজ’ পত্রিকায় তিনি লিখলেন, ‘ভারতবর্ষের মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা নিহিত আছে তার স্বাধিকার বোধের মধ্যে৷’ কবির মতে, মানুষের আত্মক্ষমতার নামান্তর হল সামাজিক ক্ষমতা৷ সামাজিক ক্ষমতার ভিত্তি তিনি দেখেছিলেন গ্রামীণ সমষ্টিবদ্ধ জীবনধারার মধ্যে৷ তাঁর বিশ্বাস ছিল মানুষ যৌথ জীবনধারার মধ্যে তার ব্যক্তি ও সমষ্টির বিকাশকে অব্যাহত রাখবে৷
রবীন্দ্রনাথের ধারণা ছিল, মানুষের ব্যক্তিত্ব শুধু নিজের স্বার্থে এবং সংকীর্ণতার মধ্যে অবরুদ্ধ থাকতে পারে না৷ ১৯১৭ সালে লেখা ‘দ্বিতীয় জন্ম’ প্রবন্ধে কবি দেখিয়েছেন, মানুষ প্রকৃতি জগতে জন্মলাভ করে প্রকৃতি জগতের বাইরে নিজের একটি জগত তৈরি করে৷ মানুষ যতক্ষণ প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণে ততক্ষণ সে প্রকৃতির সুরে বাঁধা৷ এই বাঁধন কাটিয়ে মানুষ যখন সচেতন কর্মজীবন শুরু করে, তখনকার জগত তার নিজস্ব৷ সে জগত চেতনার সুরে বাঁধা নিয়ন্ত্রিত কর্মের জগত৷ রবীন্দ্রনাথ মনে করেন তখন মানুষের দ্বিতীয় জন্মলাভ হয়৷ পুরনো অভ্যাস ও প্রবৃত্তির সঙ্গে মানুষের দ্বিতীয় জীবন সত্তার দ্বন্দ্ব তখন অবধারিত হয়ে ওঠে৷ এই বিরোধ মেটাতে মানুষের মধ্যে চলে সংগ্রাম৷ কবির কথায়, ‘নিজের মধ্যে এই সংগ্রামের আবশ্যকতা মানুষের ব্যক্তিত্বে একটি নতুন উপাদান তৈরি করে, তা হল চরিত্র৷’ তাঁর মতে, আকাঙ্ক্ষার জীবন পেরিয়ে মানুষ তখন চলে জীবনের উদ্দেশের পথে৷ চলার এই জীবন নৈতিক জগতের সঙ্গে মিশে যায়৷ ব্যক্তির বিকাশ, সমাজবন্ধন, তাঁর মানবিক সম্পর্ক, বিশ্বজনীনতার ধারণা ধীরে ধরে তাকে পরিণতি দান করে৷ মানুষের এই নৈতিকতা ও শুভবোধের উৎস হল সমাজ৷ মানুষের অহংবোধকে অতিক্রম করতে পারে একমাত্র সামাজিক ভাবনা৷ রবীন্দ্রনাথ বলছেন— ‘সমাজ নিজেই একটি উদ্দেশ্য৷ সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশ হল সমাজ৷ সমাজ মানবিক সম্পর্কের সেই স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ, যার সাহায্যে ব্যক্তিরা পারস্পরিক সহযোগিতার পথে তাদের জীবনাদর্শের বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়৷’
মানুষ ও সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে তিনি দুটি দিককে নির্দেশ করেছেন৷ একটি তার নিজস্বতার বৃত্তে টিকে থাকার দিক, অন্যটি পারস্পরিক সম্পর্ক সহায়তার মধ্যে দিয়ে বিকাশের দিক৷ পারস্পরিক সহায়তার মধ্যে কাজ করে সামাজিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক, যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে মানুষের জীবন জীবিকা৷ রবীন্দ্রনাথ তাই বলছেন, ‘মানুষ প্রয়োজন ও আয়োজনের সমারোহে পরিকীর্ণ বিশ্বের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করে চিত্ত চরিত্র বুদ্ধির মধ্যে দিয়ে৷’ এইখানেই রবীন্দ্রনাথ মানুষের সম্পর্কের স্বরূপ খুঁজে পেয়েছেন, তাঁর মতে এই স্বরূপের বিস্তার শুধু মানুষের দেশ জাতির মধ্যে নয়, তার অর্থনৈতিক জীবনের মধ্যে নয়, মানুষের সমাজবোধ বিশ্বময় মানব সম্পর্কের বৃত্ত রচনা করে চলেছে৷
রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সমাজে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের চেয়ে সামাজিক ঐক্যকে বড় করে দেখেছেন৷ কবির কাছে মহামানবের সাগরতীর এই ভারতবর্ষের মানুষ বৈচিত্র্যের মধ্যে বিরোধের অবসান ঘটিয়ে সমন্বয়ের পথে অগ্রসর হতে পেরেছে৷ শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে এই সমন্বয়কে৷ ভারতীয় সমাজের আদর্শ যেমন একদিকে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য বিকাশের পথ উন্মুক্ত রেখেছে, তেমনই বিশ্বমানবের মিলনের সম্ভাবনাও অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছে৷ রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ছিল, ব্যক্তিবিকাশ থেকে উত্তরিত হয়ে সামাজিক বিকাশ একদিন বিশ্ব মানবিকতায় পেঁৗছবে৷ ব্যক্তিমানবতার সীমা অতিক্রম করে কীভাবে বিশ্বমানবতায় পেঁৗছনো যায় সে ব্যাপারে তাঁর মনন গভীরভাবে কাজ করেছিল৷ রবীন্দ্রনাথ বলতেন— ‘মানুষের ধর্ম হল মনুষ্যত্ব৷ সকল মানুষের মধ্যে তা বিদ্যামান৷’ তিনি পূর্ণ মানবস্বরূপের মধ্যেই মানবতাকে খুঁজেছেন৷ তাঁর এই খোঁজায় ব্যক্তি মানবততা উপনীত হয়েছে বিশ্বমানবতায়৷