বিমলকুমার শীট
দেশের মুক্তির যজ্ঞে অনেক বিপ্লবী দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন, কেউ স্বদেশে ফিরে এসেছেন আবার কেউ বিদেশেই থিতু হয়েছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিপ্লবেরজনক রাসবিহারী বসু (১৮৮৬-১৯৪৬) ও কেশোরাম সবেরওয়াল (১৮৯৪-?) এই দুজন ছিলেন জাপানে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৪ সালে দ্বিতীয়বার জাপানে গেলে ঐ দুজন বিপ্লবীর সঙ্গে আলাপ হয়। সময়টা ছিল দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে। এর আগে কবি ১৯১৬ সালে আমেরিকা যাওয়ার পথে জাপান হয়ে যান। সে সময় তিনি জাপানে তিন মাস ছিলেন। তখন ভূমিকম্পের ফলে ধনে-জনে জাপান বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে কবিগুরুর জাপান যাত্রায় দ্বিতীয় পর্বে এই বিপ্লবীদ্বয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রথম জাপান যাত্রায় জাপানীদের চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য তাঁকে মুগ্ধ করে ছিল, সে সম্পর্কে জাপান-যাত্রীতে তিনি লিখেছেন –“রাস্তায় লোকের ভিড় আছে, কিন্তু গোলমাল একেবারে নেই। — জাপানিরা বাজে চেঁচামেচি ঝগড়া ঝাঁটি করে নিজের বলক্ষয় করে না। শরীর মনের এই শক্তি ও সহিষ্ণুতা ওদের স্বজাতীয় সাধনার একটা অঙ্গ। শোকে দু;খে আঘাতে উত্তেজনায় ওরা নিজেকে সংযত করতে জানে। সেই জন্যেই বিদেশের লোকেরা প্রায় বলে, জাপানিকে বোঝা যায় না, ওরা অত্যন্ত বেশি গূঢ়”। এ হেন জাপানে দেশমাতৃকার মুক্তির উদ্দেশ্যে আরও বৃহত্তর আন্তর্জাতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে রাসবিহারী বসু পি এন টেগর ছদ্মনামে পাড়ি দিলেন। তিনি পাসর্পোট নেওয়ার সময় ঘোষণা করলেন রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়। কবি জাপান যাচ্ছেন তার আগে জাপানে গিয়ে তিনি কবির অভ্যর্থনার আয়োজন করবেন। ১৯১৬ সালে ৩ মে কবি রবীন্দ্রনাথ কলকাতা হতে জাপানি জাহাজ ‘তোসামারু’ যোগে জাপানের পথে আমেরিকা যাত্রা করলেন। এই পর্বে রাসবিহারীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা সাক্ষাৎ হয় ছিল কিনা তা জানা যায় নি।
রসবিহারী বসুর জাপানের মাটিতে নতুন করে আরম্ভ হল সংগঠনের কাজ। এখানে তিনি মিৎসুর তোয়োমার ও চিনের ডাঃ সান ইয়াৎ সেনের সংস্পর্শে এলেন। যোগাযোগ হল গদরের ড. ভগবান সিংয়ের সঙ্গে। সাংহাইতে জার্মান কনস্যুলের সঙ্গে দেখা করে অস্ত্র জোগাড় করার ব্যবস্থা করলেন। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ভারতের উদ্দেশে রওনা হওয়া অস্ত্র বোঝাই দুটি জাহাজ মাঝ পথে ব্রিটিশের হাতে ধরা পড়ে গেল। রাসবিহারী বসুর উপস্থিত আঁচ করতে পেরে ইংরেজ সতর্ক হল আর জাপানে রাসবিহারী বসুর নামে গ্রেপ্তারির পরোয়ানা জারি হল। সেই সংকটে মিৎসুরু তোয়োমা তাঁর সাহায় হলেন। তিনি রাসবিহারীকে নাকামারায়াতে সোমা দম্পতির কাছে নিয়ে গেলেন। আইজো সোমা তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা তোশিকোর সঙ্গে রাসবিহারীর বিয়ে দিলেন। এই তোশিকোই আজীবন এই ভারতীয় বিপ্লবীর ঢাল হয়ে রইলেন। রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার জাপানের গেলেন ১৯২৪ সালে। তাঁর আগের বছর রাসবিহারী জাপানের নাগরিকত্ব লাভ করেন। এর আগে ১৯১৫-১৯২৩, ১৭ বার ঠিকানা পরিবর্তন করেন পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে। দেশের স্বার্থে আর কোনও দিন দেশেও ফেরা হয় নি রাসবিহারী বসুর।
রাসবিহারী বসুর মতো জাপানে আর একজন বিপ্লবীর কথা জানা যায় তিনি হলেন কেশরাম সবেরওয়াল। পেশোয়ার জাত এই বিপ্লবী অল্প বয়সে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে একবার গ্রেপ্তার হন, কিন্তু তাঁর নামে গুরুতর কোনো অভিযোগ না থাকায় অচিরে মুক্তি পান। তবুও কেন তিনি দেশ ত্যাগ করে ছিলেন জানা যায় না, হয়তো পুলিশের হয়রানির ভয়ে তিনি জাপানে চলে যান। যদিও ব্রিটিশ গোয়েন্দারা পরে তাঁর নামে সানফ্রান্সিস্কো ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছিল, কিন্তু কোনো সরকারি কাগজপত্রে তাঁর নাম নেই। হয়তো রাসবিহারীর সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল।
১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ জাপানে একমাস ছিলেন। ৭ জুন সকাল নটায় ট্রেনে কোবে ত্যাগ করে রবীন্দ্রনাথ সকালে রাত নটায় টোকিয়ো পৌঁছান। ওয়াডা বলেছেন ‘ওসাকা থেকে ট্রেনে টোকিও যাবার পথে একটি প্রাচীন ধর্মীয় শহর পড়ে, নাম ওকায়ামা। পথে সেই ওকায়ামা স্টেশনে কয়েকজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী গুরুদেবকে দেখতে ও ওঁদের শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে আসেন। গুরুদেব খুবই বিহ্বল ও মুগ্ধ হয়েছিলেন ঐ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের দেখে। ওঁর মনে হয়েছিল এতদিনে জাপানের ঐতিহ্যময় অন্তরটিকে গুরুদেব যেন এঁদের মধ্যে দিয়ে অনুভব করলেন’। য়োকোহামা স্টেশনে ট্রেনে উঠে অনেকে রবীন্দ্রনাথের সহযাত্রী হন। কালিদাস নাগ লিখেছেন, তাদের মধ্যে বিখ্যাত জাপানি কবি Yone Noguchi (১৮৭৫-১৯৪৭) ছিলেন।
নন্দলাল বসু বলেন, জাপান প্রবাসী বাঙলি বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর (১৮৮৫-১৯৪৫) সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ট্রেনেতেই ‘গভীরভাবে’ আলোচনা করেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন- রবীন্দ্রনাথ জানিতেন যে রাসবিহারীর উপর ব্রিটিশ গুপ্তচরদের শ্যেনদৃষ্টি আছে তাই তিনি একাই রাসবিহারীর সঙ্গে দেখাশোনা করেন – অপর কাহাকেও লন নাই। তারপর টোকিও স্টেশনে এক বিরাট জনতা রবীন্দ্রনাথকে স্বাগত জানান। টোকিওতে নামার পরে প্রেস রিপোর্টাররা গুরুদেবকে আগ্রহ ভরে দেখতে দেখতে আর জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে ঠেলে ঠেলে অনেকদূর পর্যন্ত নিয়ে গেল। এলমহার্স্ট (১৮৯৩-১৯৭৪) তাড়াতাড়ি কবিকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেন। জাপানি মার্চেন্ট মিৎসুভূষণের গ্রামের বাড়ি টোকিওর কাছাকাছি। তিনিই উদ্যোক্তা হয়ে নিয়ে গেলেন এদের।
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ওখানে পৌঁছাবার আগেই সেখানে রাসবিহারী পৌঁছে গেলেন। তিনি ওখানে গুরুদেবকে অভ্যর্থনা করলেন মালাচন্দন দিয়ে। কিন্তু সমীর রায়চৌধুরী অনূদিত Japan Advertiser (8 June) পত্রিকার বর্ননাটি ভিন্নতরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গতকাল রাতে টোকিও এসে পৌঁছেছেন। কোবে থেকে ট্রেনে যখন টোকিওতে পৌঁছায় তখন স্টেশনে ছিল দর্শনেচ্ছু মানুষের ভীড়। — ট্রেনের দরজার সামনে ধাক্কাধাক্কি করছেন হিন্দুস্থানী এসোসিয়েশনের সভ্য, কিছু বিদেশি এবং কিছু জাপানিরা। — হিন্দুস্থানী এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মিঃ আর বি বোস ট্রেনের দরজা খুলে জনতার দিকে হাত নাড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ উঠল বানজাই, বানজাই, মিঃ বোস ট্রেন থেকে নামলেন, তাঁর ঠিক পিছনেই ছিলেন বৃদ্ধ দার্শনিক ড. টেগরের দীর্ঘ দেহ দেখা দিল দরজা জুড়ে —। আর বি বোস এবং কে আর সবেরওয়াল, হিন্দুস্থানী এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি কোজু স্টেশনে গিয়ে টেগোরের সঙ্গে ঐ ট্রেনেই এসেছিলেন। অভ্যর্থনা সমিতির মধ্যে যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন যথাক্রমে সর্বশ্রী এম এম উইরামরত্ন, জে এ লরেন্স, বি ববি এবং ডব্লিউ পি সমরশেখর।
বিপ্লবী সবেরওয়াল জাপানে থাকার সময় জাপানি ভাষা ছাড়াও ফরাসি ভাষা শিক্ষা করে ছিলেন। টাইপ শর্টহ্যাণ্ড প্রভৃতি সেক্রেটারিয়াল বিদ্যাও তাঁর আয়ও ছিল। দেশে ফিরে আসার আকাঙ্খায় তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি কর্মলাভের আবেদন জানান। এলমহার্স্টও তাঁর যোগ্যতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়ে তাঁর আবেদন মঞ্জুর করার সুপারিশ করেন। এর ফলে রবীন্দ্রনাথ জাপান ত্যাগের আগে সবেরওয়ালকে একটি নিয়োগ পত্রে লেখেন- ১৫ জুনের কথাবার্তার সাপেক্ষে আমি চাইছি যত শীঘ্র সম্ভব আপনি এসে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পদে যোগদান করুণ। যেহেতু আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফরাসি ভাষায় কথা বলতে পারা জগৎ এবং জাপানের সাথে একটা যোগসূত্র গড়ে উঠেছে – তাই আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা আমার ব্যক্তিগত সহকারী বিশ্বভারতীর প্রশাসনিক বিভাগ – এই দুই পদের সঙ্গে যথোপযুক্ত।
কিন্তু ১৯২৪ সালের পরবর্তী সময় তিরিশের দশক পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে রাসবিহারী বসু ও সবেরওয়ালের কোন যোগাযোগ ছিল না। তবে রাসবিহারী বসুর শ্যালিকা মাকিকো হাসিমতো বিশ্বভারতীর কলাভবনে ফুল-সাজানো শিল্পে শিক্ষা দিতেন (১৯২৯-১৯৩২)। অন্যদিকে জাপানে রসবিহারীর দীর্ঘদিনের পরিশ্রম ও চেষ্টার ফলে জাপানীরা ভারত সম্বন্ধে সচেতন ও আগ্রহী হয়ে উঠল। আর জাপানের নব প্রজন্ম ব্রিটিশের থেকে এশিয়ার স্বাধীনতার দাবিতে মুখর হয়ে উঠল।