তিন বছর আগের পেগাসাস বিতর্ক ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আড়ি পাতার দায়ে মার্কিন আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরই ভারতেও ফের চর্চা শুরু হয়েছে পেগাসাস নিয়ে। গত সপ্তাহে আমেরিকার নর্থ ক্যালিফোর্নিয়ার ডিস্ট্রিক্ট আদালতে পেগাসাসের নির্মাতা সংস্থা এনএসও-কে দুনিয়াজুড়ে ১৪০০ হোয়াটস্অ্যাপ ব্যবহারকারীর মোবাইলে আড়ি পাতার জন্য নিশানা করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এই রায় সামনে আসার পরই দাবি উঠেছে, মোদী সরকার এই পেগাসাস ব্যবহার করে যে ৩০০ জনের ফোনে আড়ি পেতেছিল, তাদের নাম প্রকাশ করা হোক। আড়ি পাতার তালিকায় রাহুল গান্ধী, সীতারাম ইয়েচুরির মতো বিরোধী নেতারা ছাড়াও ফোনে আড়ি পাতার অভিযোগ উঠেছিল সিদ্ধার্থ বরদারাজন, পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা, শিশির গুপ্তা, প্রশান্ত ঝা-র মতো সাংবাদিক ছাড়াও বেশ কিছু সমাজকর্মী, আইনজীবীর ফোনে। পেগাসাস স্পাইওয়ারের মাধ্যমে এদেশের ৩০০ জনের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। আমেরিকার আদালতের রায় প্রকাশ্যে আসতেই ফের পেগাসাস-বিতর্ক নিয়ে কংগ্রেস সহ বিরোধীরা সরব হয়ে ওঠে। কাদের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছিল, সেটা কর্তৃপক্ষকে সেই তালিকা প্রকাশ করার দাবি জানিয়েছেন কংগ্রেস নেতা রণদীপ সুরজেওয়ালা।
ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও গ্রুপের তৈরি পেগাসাস স্পাইওয়ার দিয়ে ১৪০০ হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীর ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে বলে অভিযোগ এনে মেটার নিয়ন্ত্রণাধীন হোয়াটসঅ্যাপ এই মামলাটি করেছিল। ২০১৯ সালের মে মাসে দু’সপ্তাহ দরে ওই ব্যবহারকারীদের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছিল বলে দাবি হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষের। তা নিয়ে আমেরিকার আদালতে পেগাসাসের বিরুদ্ধে মামলা করে হোয়াটসঅ্যাপ। মামলায় বিচারপতি ফিলিস হ্যামিল্টন সাফ জানিয়েছেন, ১৪০০ হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীর যন্ত্রকে নিশানা করার জন্য দায়ী ইজরায়েলের ওই স্পাইওয়ার নির্মাণকারী সংস্থা। তারা মার্কিন দেশের কম্পিউটার ফ্রড অ্যান্ড অ্যাবিউজ অ্যাক্ট এবং ক্যালিফোর্নিয়া কম্পিউটার ডেটা অ্যাকসে অ্যান্ড ফ্রড অ্যাক্টের একাধিক ধারা লঙ্ঘন করেছে। এর জন্য কতটা কী ক্ষতি হয়েছে, সে বিষয়ে আগামী বচরের মার্চে আলাদা করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছে আমেরিকার আদালত।
২০১১ সালে পেগাসাস-বিতর্ক খতিয়ে দেখার জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালত ওই কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনবে কিনা, বা বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখার কথা ভাবছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কংগ্রেস। পাশাপাশি, ওই ৩০০ ভারতীয়ের নাম মেটা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হবে কিনা, সেই বিষয়টিও তুলে ধরেছেন কংগ্রেস নেতা সুরজেওয়ালা। তাঁর বক্তব্য, মেটা কর্তৃপক্ষেরই উচিত পেগাসাসের ‘শিকার’ হওয়া ৩০০ ভারতীয়ের নাম প্রকাশ করা।
পেগাসাস স্পাইওয়ার ব্যবহার করে শুধু বিরোধী নেতাদের ফোনেই নয়, শাসক শিবিরের নেতা, সাংবাদিক এবং ব্যবসায়দের উপরে নজরদারি চালানো হয়েছিল বলে অভিযোগ। আমরিকার আদালতের রায় প্রকাশ্যে আসতেই ফের তা নিয়ে সরব হয়েছে কংগ্রেস। নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে বিঁধে সুরজেওয়ালার প্রশ্ন, কেন ৩০০ ভারতীয়ের ফোনকে নিশানা করা হয়েছিল? এঁদের মধ্যে বিরোধী নেতা বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা থাকলে তাঁদের নাম, বিজেপি শাসিত সরকার এবং তদন্তকারী সংস্থাগুলি কোন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করেছিল? সেই তথ্য কোন কাজে ব্যবহার কিংবা অপব্যবহার করা হয়েছিল?
২০২১ সালে পেগাসাস-বিতর্কে তোলপাড় হয়েছে ভারতের রাজনৈতিক আঙিনা। শুধু ভারত বা আমেরিকা নয়, এই বিতর্ক ছড়িয়েছে অন্যান্য দেশেও। পোল্যান্ডে পেগাসাসের বিরুদ্ধে চলতি বছরে পৃথক একটি তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযোগ, ২০১৭-২০২২ সালের মধ্যে সে দেশের প্রায় ৬০০ মানুষের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছিল। পোল্যান্ডে সরকার বদলের পরই এ বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়। কাঠগড়ায় উঠেছে সেদেশের তৎকালীন সরকারের ভূমিকা।
ভারতে পেগাসাস-বিতর্কের স্মৃতি এখনও টাটকা। একাধিক সরকারি আধিকারিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, মানবাধিকার কর্মীদের ফোনে পেগাসাস হানার খবরের পর ভারতের পাশাপাশি সারা বিশ্বে আলোড়ন ওঠে। ২০২১ সালে সুপ্রিম কোর্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছিল। কেন্দ্রীয় সরকার যে গোটা তদন্ত প্রক্রিয়ায় কোনও রকম সহযোগিতা করেনি, তা জানিয়েছিল ওই কমিটি।
আমেরিকার আদালত নজরদারি চালানো হয়েছে বলে রায় দেবার পর ভারতের সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান এবং কোর্ট নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তেমনই বিশেষজ্ঞ কমিটিকে মোদী সরকার কেন সহযোগিতা করেনি, সেই প্রশ্নও নতুন করে উঠতে বাধ্য। এই অবস্থায় বিষয়টি নতুন করে ফের তদন্ত করা জরুরি। এই ইস্যুতে অনেক প্রশ্নের জবাব দেয়নি মোদী সরকার। শুধু অস্বীকার করে দায় সেরেছে। সুপ্রিম কোর্টেও ফের বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ ওঠা দরকার।
বিরোধীদের দমন করতে, তাঁদের গতিবিধি, কার্যকলাপ ও ভাবনা-চিন্তার ওপর কড়া নজরদারি চালাতে মোদী সরকার যে সচেষ্ট, তদন্ত হলেই তা প্রমাণ হয়ে যাবে। পেগাসাসকে দোষী সাব্যস্ত করে মার্কিন আদালতের রায় কার্যত ভারতে মোদী সরকারকেই কাঠগড়ায় তুলেছে। তবুও ‘নির্লজ্জ’ এই কেন্দ্রীয় সরকার।