নিবন্ধের শিরোনাম দেখে অনেকেই হয়তো ভাববেন যে, কোনও কাব্য বিষয়ক আলোচনার সূত্রপাত করতে চলেছি। কিন্তু না, এ কোনও কাব্য-গাঁথা নয়, এ যেন রূঢ় বাস্তব হয়ে উঠবে আগামীতে, যদি না আমরা এখনই সতর্ক হই। বিজ্ঞানের উন্নতি বিস্ময়কর। এই উন্নতি যেমন নতুন নতুন ক্ষেত্রে আবিষ্কার করে চলেছে, সেই সঙ্গে সৃষ্টি করছে বহু সংকট, যার জন্য বিজ্ঞানকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হয়। যেমন বর্তমানে এই বিজ্ঞানের কল্যাণেই মানুষের জীবনকে করে তুলেছে দীর্ঘতর, যা অনেক সময়ই ‘মৃতবৎ’ বেঁচে থাকা হয়ে যায়, যা একান্তই ক্লান্তিকর এবং কষ্টকর।
স্কুলজীবনে একটা রচনা (সে ইংরেজি বা বাংলা উভয় ভাষাতেই) প্রায় প্রতিটি পরীক্ষাতেই আসত— ‘বিজ্ঞান অভিশাপ, না আশীর্বাদ’। প্রায় প্রতিটি ছাত্রই বিজ্ঞানকে আশীর্বাদ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করত তাদের রচনায়। কিন্তু আজ এই পরিণত বয়সে এসে মনে হয় বিজ্ঞানকে কি শুধু আশীর্বাদ হিসেবেই গণ্য করা যায়? সত্যিই কি বিজ্ঞান মানবসভ্যতার পক্ষে আশীর্বাদ?
অভিশাপ যদি নাও বলি, তবে একথা বলতে দ্বিধা নেই আজ বিজ্ঞানের জন্যই মানব সভ্যতার পক্ষে প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে অনেক বিষয়ই। তার মধ্যে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে নিয়ে এই নিবন্ধে আলোচনা করব। বিজ্ঞানের প্রভাবে আজ চিকিৎসাবিজ্ঞান উন্নতির শিখরে উঠছে। অবস্থাটা এমনই যে ‘জিনের’ পরিবর্তন ঘটিয়ে জীবজগতের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে চলেছে। যেন সেই পরমশক্তি যার হাতে সৃষ্ট এই জীবজগৎ তাকেই চ্যালেঞ্জ করছে। প্রাসঙ্গিক একটা উপন্যাসের কথা মনে আসছে— তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘আরোগ্য নিকেতন’-এ জীবন মশায় রোগপ্রাপ্ত, বয়স্ক রোগীকে ‘নিদান’ দিতেন, পৃথিবীর মায়া কাটাবার নিদান। কিন্তু সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ডাক্তারের হাতে মৃত্যুপথযাত্রী রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু দীর্ঘজীবন লাভের বহু কষ্ট বেঁচে থাকার আনন্দকে পরাভূত করে। বর্তমানে একজন মানুষ ‘কোমায়’ চলে গিয়েও ‘লাইফ সাপোর্ট’-এর মাধ্যমে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকছে। যেমন ছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী। কিন্তু এভাবে বেঁচে থাকা কি কাম্য? বা এর সত্যিই কি কোনও প্রয়োজন আছে?
এটা ঘটনা যে, প্রতিটি প্রার্থী যে পৃথিবীতে বেঁচে থাকে, তার একটা ভার আমাদের এই গ্রহটিকে বহন করতে হয়। যেমন খাদ্য-জলের ব্যবস্থা করতে হয়, তেমনই জোগাতে হয় অক্সিজেন। সেই সঙ্গে প্রতিটি প্রাণীর সৃষ্ট বর্জ্যও বহন করতে হয়। সুতরাং শারীরিকভাবে একেবারে অক্ষম বা যে কোমায় চলে গেছে, তাকে ‘মৃত্যুর অধিকার’ দিয়ে সেই মানুষটিকে যেমন মুক্তি দেওয়া যেতে পারে, সেই সঙ্গে প্রকৃতিকেও অনেকটাই ভারমুক্ত করা যেতে পারে। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের প্রায় শেষ বেলায় আমরা ‘ইচ্ছামৃত্যুর’ অধিকার স্বীকার করতে পারছি না, বা এ দাবি প্রবলভাবে উঠে আসছে না, অথচ আমাদের দেশে এ ভাবনা চালু ছিল, যা উঠে আসে পিতামহ ভীস্মের ‘ইচ্ছামৃত্যুর’ ধারণা থেকে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিয়ে কিছু ভাবনা বিনিময় করতে চাই, সেটা হল ‘জল’। হ্যাঁ, জল, যার সৃষ্টি প্রকৃতির দ্বারা, যার কোনও বিকল্প আজও বিজ্ঞান তৈরি করতে পারেনি।
আধুনিক বিশ্বে বিজ্ঞানী মহল তাঁদের অসাধারণ চিন্তাভাবনা এবং কৃৎকৌশলে অবিরত সচেষ্ট রয়েছেন জলের অস্তিত্ব সন্ধানে অন্য গ্রহে। অথচ সুজলা-সুফলা এই বসুন্ধরাকে প্রতিনিয়তই আমরা করে চলেছি জলশূন্য— কী হাস্যকর ভাবনা, তাই না? অপরিকল্পিত নদীবাঁধ, নদী, পুকুর, খাল-বিল, ডোবা বুজিয়ে চলেছে নির্মাণ, প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে কংক্রিকেটের জঙ্গল, গ্রামের উন্নতি না করে শহরকে আলোকিত করার ফলে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে শহরের উপরে আর এই চাপ কমাতে তৈরি হচ্ছে বহুতল নির্মাণ, যা ভূগর্ভস্থ জলকে আরও করে তুলেছে অপ্রতুল। কৃষিক্ষেত্র থেকে শুরু করে মানুষের প্রয়োজনে যে জলের প্রয়োজন হয়, তার থেকে অনেক বেশি জল অপচয় করা হয় প্রতিদিন, যে রাস্তার কলের মুখ বন্ধের অভাবের কারণে বা মাটি থেকে পাম্পের সাহায্যে জল উত্তোলন করে ট্যাঙ্ক উপচে নষ্ট করেই হোক। সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, প্রকৃতি দ্রুত জলশূন্য হয়ে উঠছে। আমরা কেউ ভাবছি না— ‘গাছের শেষ পাতাটা পড়ে গেলে, / নদীর জলের শেষ বিন্দুটা শুকিয়ে গেলে / বুঝবে ডলার খেয়ে বাঁচা যায় না’—
ঠিক এই অবস্থায় আমরা ব্যক্তি নাগরিক কিন্তু উদাসীন থাকতে পারি না, পারা উচিত নয়। আর যদি থাকি তবে আমাদের জবাব দিতে হবে উত্তরসূরিদের সামনে। জল অপচয় বন্ধের প্রাথমিক দায়িত্ব প্রশাসনের শুধুমাত্র জনমোহিনী সিদ্ধান্তে জল ব্যবহারে ‘মিটার’ ব্যবস্থা চালু না করা কোনও প্রশংসনীয় কাজ নয়। বিদ্যুতের যেমন বিলের ব্যবস্থা হয়েছে, জলের ক্ষেত্রেও প্রয়োজন ট্যক্স নেওয়া। এবং এ বিষয়ে কোনও দ্বিধা নয়। জল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। সেই সঙ্গে আমরা নাগরিকরাও সতর্ক যত্ন নেব জল ব্যবহারে। সে অঙ্গীকার আমাদের করতেই হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
আমরা যদি প্রাত্যহিক জীবনে জলের সুব্যবহার করতে সক্ষম হই, তবে পারব জলের অপচয় অনেকটাই বন্ধ করতে। যেমন— স্নানের জন্য সায়োর নয়, ব্যবহার করুন বালতি। বড় এক বালতি জল দিয়েই স্নান সারুন। হাঁটুর বা কোমড়ের সমস্যা না থাকলে কমোড পরিহার করুন। রান্নাঘরে প্রতিদিন যে জল ব্যবহার হয় সেই জলকে একাধিকবার ব্যবহার করুন। যেমন— চাল ধোওয়া, সবজি ধোওয়া, থালা-বাসন ধোওয়ার জল একটি পাত্রে সংরক্ষণ করে সেই জল বাড়িতে লাগানো গাছে দিন, ড্রেনে ঢালুন, সিঁড়ি বা উঠোন ধোওার কাজে লাগান। জামাকাপড় ধোওয়া-কাচা জল প্রয়োজনে বাথরুমে ব্যবহার রুন। মেশিনে কাপড় কাচলে, কাচা শেষে ধোওয়ার কাজটা যন্ত্রের সাহায্যে নয়, নিজেরা করে নিন, দেখবেন অনেক জল সাশ্রয় হবে। পরিষ্কার জল দিয়ে গাড়ি ধোওয়া, ড্রেন ধোওয়া, বাথরুম এসব ধোওয়া বন্ধ করুন। দেখবেন প্রতিদিন অনেক জল অপচয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
প্রতিটি পঞ্চায়েতকে সচেষ্ট হতে হবে চাষের জমির পাশে বা গ্রামের আনাচে-কানাচে ডোবা, খালগুলিকে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করে বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করা। বৃষ্টির সময় ছাদের জল নষ্ট হতে না দিয়ে সেগুলিকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। এ বিষয়ে নাগরিক সমাজকে যেমন কাজে লাগানো যেতে পারে, সেই সঙ্গে স্থানীয় ক্লাবগুলিকেও কাজে লাগানো যেতে পারে।
এই সবকিছুই নির্ভর করছে প্রথম পর্যায়ে প্রশাসনের সচেতনতা ও আন্তরিক প্রয়াসের উপর। প্রয়াস যদি আন্তরিক হয়, তবে যে কোনও উদ্যোগই সফল হতে পারে। যেমন ‘পোলিও মুক্ত দেশ’ সম্ভব হয়েছে। শুধুমাত্র জল সংরক্ষণের বিজ্ঞাপনে কাজ হবে না, কাজ করতে হবে রাস্তায় নেমে এবং সহনাগরিকদের সঙ্গে নিয়েই। নতুবা অদূর ভবিষ্যতে এক ফোঁটা জলের জন্য চাতকের মতো চিৎকার করতে হবে— বৃষ্টি হোক, বৃষ্টি হোক…।