কালোতে কৃষ্ণকলি, আঁধারে আলো কালী

স্বপনকুমার মণ্ডল

ঈশ্বরের চেতনা কতভাবেই না ব্যাপ্ত, তার ইয়ত্তা নেই। কল্পনার রঙে রাঙা হয়ে তার মূর্তি থেকে প্রতিমায় প্রকাশ মনের আকাশেই বিচিত্র রূপ লাভ করে। সর্বত্র ঐশ্বরিক মহিমার বিস্তার। ছকবন্দি দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে ভক্তি আর মুক্তির আড়ম্বর বিস্তার লাভ করে। সেখানে প্রয়োজনের চেয়ে আয়োজনের অভ্যাসে পূজা উৎসবে মিলিয়ে যায়, সাধনের চেয়ে প্রসাধন বড় হয়ে ওঠে। ত্রাতা থেকে বিধাতার ঐশ্বরিক চেতনায় দেবদেবীর বহুরূপী আবির্ভাবও বিস্ময়কর। কত তার রূপ,কত ভাবেই তার প্রকাশ! ধর্মপ্রাণ বাঙালিমানসেও মাতৃতান্ত্রিক চেতনায় তার পূজার্চনাও প্রতীয়মান। সেখানে মা কালীর ব্যতিক্রমী বিস্তারেই দেবীর আভিজাত্য ও সর্বজনীন আবেদনকে মূর্ত করে তোলে। অন্য সব দেবীর মধ্যে যে মাতৃরূপা প্রকৃতি বর্তমান, মা কালী তার সঙ্গে বেমানান। তাঁর মধ্যে ভয়াল ভয়ঙ্কর সংহারমূর্তি যেভাবে বিচিত্র রূপে মনে বীভৎস আকার ধারণ করে, তার প্রতি ভয়ে ভক্তি জেগে উঠলেও আরাধনা করার আবেগ অন্তর্হিত হয়, দৃষ্টি ফেরানোতেই মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। অথচ মা কালীর পূজার অভাব নেই, ভক্তির পরাকাষ্ঠায় ‘জয় মা কালী’। গৃহস্থের বাড়ি থেকে শ্মশানে সর্বত্র তাঁর নিরবচ্ছিন্ন পূজার্চনা চলে। যত্রতত্র তাঁর মন্দির গড়ে ওঠে।
দুর্ঘটনায় মুক্তি কামনা থেকে মঙ্গলাকাঙ্ক্ষীর মনস্কামনা সব ক্ষেত্রেই মা কালীর ভয়ঙ্করী মূর্তিই নৈবেদ্যে আরাধ্য দেবী রূপে পূজিত হয়। তাঁর কত বিকট, উৎকট নাম। সেই নামের বহুরূপী ও বহুমুখী বিস্তারেই দেবীর সর্বজনীন আবেদন প্রকট মনে হয়। অথচ তাঁর দেবী দুর্গার মত দুর্গতিনাশিনী সর্বজয়া ভগবতীর অভয়া রূপ নেই, পারিবারিক সম্পর্কও মূর্ত হয়ে ওঠে না। সেখানে নৃমুণ্ডমালিনী মা কালীর নিরাবরণ শ্রীহীন রূপের দন্তবিদ্ধ নির্গত জিহ্বায় সলজ্জ বিকট মূর্তিই সর্বজনীন হয়ে উঠেছে, ভাবা যায়। গৃহস্থ পূজা করে, চোর-ডাকাতও করে। আবার থানার পুলিশও মায়ের আরাধনায় ব্রতী হয়। এরকম একই সঙ্গে সবার কাছে মা কালীর আশ্রয়, প্রশ্রয় এবং ত্রাতা থেকে বিধাতা হয়ে ওঠাই শুধু নয়, বিশ্বাসের বরাভয় হয়ে ওঠার মধ্যেই দেবীর শক্তিদায়িনী প্রতিমা মনের জোর বাড়িয়ে চলে। সারদামণির কথায় তিনি সতেরও মা, অসতেরও মা। সেখানে সমাজের সর্বস্তরে মা কালীর আরাধনার মধ্যেই দেবীর প্রতি বিশ্বাস ও ভালবাসার অমোঘ প্রকাশ অন্যত্র লক্ষ করা যায় না।
শক্তিসাধনা বা তান্ত্রিকতা সমাজমানসে বিস্তার লাভ না করলেও মা কালীর রক্ষাকর্ত্রী মাতৃরূপা প্রকৃতি বিশ্বাসের পরাকাষ্ঠায় অন্ধকার থেকে আলোকদিশারি হয়ে উঠেছে। সেখানে যেকোনো প্রকার অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য মায়ের সংহার মূর্তি ভক্তমানসে জেগে ওঠে। দীনহীন অসহায় মানুষের মুখে ‘জয় মা কালী’, ‘জয় মা তারা’র আলো ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও ‘মা কালীর দিব্যি’ কেটে কথা বলার মধ্যে ছোট বেলাতেও দেবীর প্রতি অচলা ভক্তি অনুভব করা যায়। সেক্ষেত্রে দুর্যোগতাড়িত জীবনে দেবীর বীভৎস ভয়ঙ্করী রূপের মধ্যেই অসহায় মানুষের মুক্তির স্বপ্ন জেগে ওঠে, মাঙ্গলিক চেতনায় আলোর পরশ ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে সবার অবারিত দ্বার, বিনা অনুমতিতে অনুপ্রবেশ। সমাজের চোখে অপরাধীদের কাছেও দেবী বন্দিত। সমাজের অন্ত্যজ মানুষের একান্ত আপন মা কালী। চুরি করা থেকে জুয়া খেলায় সর্বত্র দেবীর কল্যাণকামী চেতনার বিস্তার। শুধু তাই নয়, মা কালীর মধ্যে আকাঁড়া মানুষের বর্ণহীন জীবনের সঙ্গে মা কালীর হতশ্রী বিরূপ প্রকৃতি যেন একাত্ম হয়ে ওঠে। সেখানে সংগ্রামমুখর সংহারমূর্তি দীনহীন মানুষের মনে জীবনযুদ্ধে মানসিক শক্তির আধার মনে হয়, উত্তরণের হাতছানিতে প্রত্যাশা জাগায়। দুর্যোগের ঘনঘটায় জীবনে যখন অমাবস্যা নেমে আসে,তখন মা কালীর মধ্যেই পূর্ণিমার চাঁদ জেগে ওঠে। কালোর আলো আসলে চেতনার আলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত আলোর কথা বলেছেন। তিনিও কালোতে কৃষ্ণকলিকে খুঁজে পেয়েছেন। বর্ণহীন কালোতে শুধু কৃষ্ণকলি নয়,মা কালীও বর্ণরঙিন। সেই কালী কালজয়ী আলো, চেতনার রঙে রঙিন। তার মধ্যে থাকে আলোর পরশ, বরাভয় হাতছানি। রামকৃষ্ণ পরমহংসের ‘তোর চৈতন্য হোক’ আশীর্বাণীতে সেই আলোর পরশ। সেই আলোতেই তমসাচ্ছন্ন মনে অমাবস্যা কেটে যায়, চৈতন্যলোকে ঝাড়বাতির রোশনাই ছড়িয়ে পড়ে।