শোভনলাল চক্রবর্তী
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মাঝে যেখানে সুস্থায়ী কৃষিকাজের পদক্ষেপ আরও জরুরি হয়ে উঠছে, সেখানে কৃষিক্ষেত্রে ইতিবাচক বদল আনতে সাহায্য করতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা জিয়োস্পেশিয়াল প্রযুক্তি। আগামী দিনে কৃষি গবেষণা এবং সেই সংক্রান্ত প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করতে কৃষিক্ষেত্রকে আরও ভাল ভাবে প্রস্তুত করা যাবে। জলবায়ু সহনশীল কৃষি উৎপাদন বাড়লে তা সুস্থায়ী খাদ্য সরবরাহ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করবে। প্রসঙ্গত, ২০২১-এ জিয়োস্পেশিয়াল তথ্য নীতিতে নির্দিষ্ট অঞ্চল এবং ডেটা ম্যাপিং সংক্রান্ত নিয়মকানুনে পরিবর্তন আসার পর কৃষিক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং বিভিন্ন অঞ্চল সংক্রান্ত তথ্য ব্যবহারের পথ প্রশস্ত হয়েছে।
তবে, কৃষিক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, উপগ্রহ চিত্র বা ‘রিমোট সেন্সিং’-এর মতো প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমস্যাও রয়েছে বিবিধ। যেমন, এই ধরনের প্রক্রিয়াগুলি অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। রয়েছে প্রায়োগিক জটিলতাও। যে-হেতু দেশের অধিকাংশ মানুষের জমির আকার খুব বড় নয়, তাই এ ক্ষেত্রে অতি উচ্চ মানের উপগ্রহ চিত্রের প্রয়োজন পড়ে। তেমন নিখুঁত প্রযুক্তি এ দেশে সহজলভ্য নয়। কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির জন্য তাই সরকার ‘ইন্ডিয়া ডিজিটাল ইকোসিস্টেম অব এগ্রিকালচার’ নামক কাঠামো গড়ে তুলেছে যার মাধ্যমে রোবোটিক্স, ড্রোন ও ডেটা অ্যানালিটিক্স-এর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এই ক্ষেত্রে আরও বেশি করে ব্যবহৃত হতে পারে। দেশে কৃষি গবেষণার উপরে যে আরও জোর দিতে হবে, তাতে সংশয়মাত্র নেই। অথচ, এ বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে কৃষি এবং কৃষক উন্নয়ন মন্ত্রকের অন্তর্গত স্বশাসিত গবেষণাকেন্দ্রগুলির বরাদ্দ দুই শতাংশ হ্রাস করা হয়েছে। ফলে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটির উন্নতিসাধন করতে হলে সরকারকে শুধু নীতি প্রণয়ন নয়, গবেষণার পাশাপাশি উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকাঠামো গড়ে তোলার উপরেও জোর দিতে হবে।
কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় সম্প্রতি প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য দু’টি পদক্ষেপ করল কেন্দ্রীয় সরকার। প্রথমটি ‘কৃষি-ডিসিশন সাপোর্ট সিস্টেম’ পোর্টাল (কে-ডিএসএস), যা এ বারের বাজেটে ঘোষিত কৃষিকেন্দ্রিক ডিজিটাল পরিষেবা ‘ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ প্রকল্পের অংশ। এই প্ল্যাটফর্মটি নির্দিষ্ট অঞ্চল সংক্রান্ত (জিয়োস্পেশিয়াল) তথ্য এবং উপগ্রহ চিত্রের দ্বারা ফসলের অবস্থা, আবহাওয়ার ধরন, মাটির নীচে জলের পরিস্থিতি, আঞ্চলিক জলাধারের জলস্তর এবং মাটির স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সাম্প্রতিকতম তথ্য কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে। চরম আবহাওয়া পরিস্থিতি অথবা পতঙ্গের আক্রমণের মতো বিপদের আগাম সতর্কতা জারির পাশাপাশি সরকারকে আঞ্চলিক কৃষিক্ষেত্রের চাহিদার বিষয়েও অবগত করতে পারবে ‘কে-ডিএসএস’। দ্বিতীয় পদক্ষেপ ‘ন্যাশনাল পেস্ট সার্ভেল্যান্স সিস্টেম’ (এনপিএসএস) হল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক একটি পদ্ধতি, যা দেশ জুড়ে ক্ষতিকারক কৃষি-পতঙ্গ দমন সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার কাজে লাগবে। এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মটির দ্বারা দেশের প্রায় চোদ্দো কোটি কৃষক উপকৃত হবেন। তা ছাড়া ফসলে অত্যধিক কীটনাশক ব্যবহারের সমস্যার সমাধানে এটি কাজে লাগতে পারে।কিন্তু কাগজ-কলমে যা ভাল নীতি, রাজনীতির জমিতে তা প্রায়ই অচল হয়ে দেখা দেয়।
২০২০-২১ সালের কৃষক আন্দোলনের পরে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কৃষকদের দূরত্ব বেড়েছে, আস্থা কমেছে। কৃষক সংগঠনগুলি সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কে সন্দিহান, ফলে যে কোনও সংস্কারের প্রস্তাবকেই তাঁরা সহজে গ্রহণ করতে পারেন না। উপরন্তু, কৃষক আন্দোলন ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল ক্রয়কে সরকারি নীতি থেকে আইনে পরিণত করার দাবি তুলেছে। এ বিষয়টি পঞ্জাব, হরিয়ানা-সহ উত্তর ভারতের বেশ কয়েকটি চাষির কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। তাঁরা দেখিয়েছেন যে, উৎপাদনের উপকরণের খরচ ও মজুরি মিটিয়ে বাজার দরে চাল-গম বিক্রি করে লাভবান হওয়া অসম্ভব। তাই সরকারি ক্রয়ের উপরেই চাষি নির্ভর করতে বাধ্য। বরং অন্যান্য ফসলকেও সরকারি ক্রয়ের অধীনে নিয়ে আসার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন তাঁরা। নির্বাচনী বাধ্যবাধকতায় প্রায় সব দলই চাষিদের এই সংগঠিত দাবির কাছে নতিস্বীকার করছে।কিন্তু এর ফলে সমস্যা রয়ে যাচ্ছে সেই তিমিরেই— করদাতার টাকাতে চাষিদের ভর্তুকি দিয়ে এমন চাষ হচ্ছে, যা মহাসঙ্কটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে দেশকে।
ভূগর্ভের জলভান্ডার শূন্য হয়ে উর্বর ভূমি মরুভূমি হচ্ছে, অত্যধিক ইউরিয়া সার প্রয়োগে মাটি অনুর্বর হচ্ছে, ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহারে দূষিত হচ্ছে খাদ্য। কোনও দিক থেকেই সুস্থায়ী উন্নয়নের পথ দেখা যাচ্ছে না। গবেষকরা মনে করছেন, সরকারি ভর্তুকির কোনও বিকল্প ব্যবস্থা চাষিদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা দরকার। এ বিষয়ে দ্বিমত নেই, কিন্তু বিকল্প নীতির জন্য চাই বিকল্প রাজনীতিও।সরকারি নীতির ফলে হিতে বিপরীত ঘটেছে ভারতের কৃষিক্ষেত্রে, এমন আশঙ্কাকে আরও গাঢ় করল একটি গবেষণাপত্র। চাষিদের সুরক্ষায় বাজার দরের চাইতে বেশি টাকায় চাল, গম কেনে সরকার। বেশি দাম পাওয়ার আশায় চাষিও আরও বেশি উৎপাদনের দিকে ঝোঁকেন— গবেষকদের হিসাব, প্রয়োজনের চাইতে ত্রিশ শতাংশ বেশি চাল ও গম উৎপাদন করে ভারত। ধান ও গম, দু’টি শস্যের উৎপাদনেই প্রচুর জল লাগে, তাই ভূগর্ভের জলের উত্তোলন হচ্ছে বেশি। পরিস্থিতি এমনই যে, উত্তর ভারতের যে সব এলাকায় ষাটের দশকে ‘সবুজ বিপ্লব’ ঘটেছিল, এবং এখনও যেগুলি ভারতের শস্যের প্রধান উৎপাদক, সেই এলাকাগুলি মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে চলেছে।
১৯৮১ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে পঞ্জাবের ভূগর্ভের জলের স্তর গড়ে আট ফুট নেমেছে, কোনও কোনও জায়গায় তা ত্রিশ ফুট নীচেও নেমেছে। মধ্যপ্রদেশে বেড়েছে শুকনো কুয়োর সংখ্যা। দু’টি রাজ্যেই সরকারি ভর্তুকিতে ক্রয়ের ফলে শস্যের উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। অতএব ভর্তুকির ফল কী হচ্ছে, তা নিয়ে চিন্তার দরকার রয়েছে। চাষিদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখতে কী ভাবে ভর্তুকি দেওয়া যথাযথ হবে, তা নিয়ে চিন্তার প্রয়োজন, মনে করছেন গবেষকরা, যাঁরা আমেরিকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ ও অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেন। এই উদ্বেগ নতুন নয়। রেশনব্যবস্থার জন্য ন্যূনতম সরকারি মূল্যে সরকারি ক্রয় যে চাষের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করছে এবং পরিবেশের ক্ষতি করছে, এই উদ্বেগ বার বার দেখা গিয়েছে। অনেকেই প্রস্তাব দিয়েছেন যে, চাল-গমের ক্রয় কমিয়ে, কম জলে উৎপন্ন শস্য বেশি করে ক্রয় করুক সরকার। তাতে পরিবেশবান্ধব চাষে উৎসাহ দেওয়া হবে।