মুহাম্মদ শাহাবুদ্দিন
মানুষের সামাজিক সচেতনতা, তার রাজনৈতিক ধারণা যে স্তরেই থাকুক না কেন, রাজনৈতিক বক্তৃতাই রাজনীতির সঙ্গে তার প্রথম যোগসূত্র ঘটায়৷ রাজনৈতিক ভাষণের মধ্যে দিয়েই মানুষ প্রথম গণতন্ত্রকে জেনেছিল৷ তাঁকে ব্যক্তিমুক্তির ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল৷ পৃথিবীতে নবজাগরণ আসার আগে গণতন্ত্রের হাওয়া উঠেছিল৷ আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রিসে তখন ছিল নজর রাজ্য৷ সোলেন, ক্লিসথোনিস, সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল থেকে ১৭ শতকে জন লক— এঁদের মতাদর্শে উঠে আসে গণতন্ত্রের পরিচয়৷ তাঁদের অভিভাষণে মানুষ খুঁজেছিল জীবনে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার পথ৷ জানা যায়, জেনোফেন, অ্যারিস্টটল মানুষকে নতুন নুতন জ্ঞানের কথা শোনাতেন পথের কিনারে বসে৷ একথা শুনতে জড়ো হয়ে যেতেন শহরের শ্রমিক মানুষেরা৷ তাঁদের সামনে জ্ঞানের কোনও আলো ছিল না৷ তাঁরা বুঝতেনই না যে তাঁরা কিছু জানেন না৷ কথার মধ্যে দিয়ে তাঁরা মনীষীদের শ্রোতা হয়েছিলেন৷ জ্ঞানী মানুষেরা বহু বিষয়কে সহজ করে বোঝাতেন৷ তাঁদের সঙ্গে দলে দলে ঘুরতেন এইসব শ্রোতার দল৷
১৮৬৩-তে আব্রাহাম লিঙ্কন শুনিয়েছিলেন ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা৷ এই ভাষণ তাঁর বিখ্যাত ‘গেটিসবার্গ স্পিচ’৷ ভাষণে লিঙ্কন ঘোষণা করেছিলেন— ‘গণতন্ত্র হল জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্য সরকার৷’ গণতন্ত্রের এই মহৎ বার্তা পেঁৗছে গিয়েছিল পৃথিবীর মানুষের কাছে৷ ইতিহাসের পাতায় দেখা কিছু ভাষণের ছবি আমাদের আজও নাড়া দেয়৷ বলশেভিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে লেনিন রূপ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট রাশিয়ার৷ বিপ্লব-পূর্ব রাশিয়ার শ্রমিক মানুষকে নিয়ে বিশাল জনসভার ছবিতে আমরা দেখেছিল লেনিনের উদাত্ত আহ্বানের ভঙ্গি৷ সমবেত ভাষণের মধ্যে এই সভা বিপ্লবের স্বপ্ন জাগিয়ে দিত৷ স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে কবি মনীষীদের অভিভাষণ রাজনীতির বৃত্ত ছাড়িয়ে নতুন জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করেছে৷ স্বদেশি জাগরণে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ শুনিয়েছিলেন ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’৷ ভাষণের মধ্যে এই গান বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল৷ বিদ্রোহী নজরুলের বিদ্রোহ ছিল মানবমুক্তির স্বপক্ষে৷ তাঁর কাব্য কবিতা অভিভাষণ হয়ে উঠেছিল মানবমুক্তির অকপট ঘোষণা৷
১৯২৯-এ কলকাতার অ্যালবার্ট হলের সংবর্ধনার প্রতিভাষণে নজরুল দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন— ‘বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি৷ এই পথযাত্রার পাঁকে পাঁকে, বাঁকে বাঁকে কুটিল-ফণা ভুজঙ্গ, প্রখর-দর্শন শার্দুল, পশুরাজের ভ্রুকুটি এবং তাদের নখর দংশনের ক্ষত আজও আমার অঙ্গে অঙ্গে৷ তবু ওই আমার পথ, ওই আমার গতি, ওই আমার ধ্রুব৷’ অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগের এই ভাষণ আমাদের চেতনায় এনেছিল বিপ্লবের উদ্দীপনা৷ মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে রবীন্দ্রনাথ মেনে নিতে পারেননি৷ জীবন সায়াহ্নে ‘সভ্যতার সংকটে’ সভ্যতার পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ থেকে বেঁচে ওঠার পথ দেখিয়েছিলেন৷ শুনিয়েছিলেন সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে ইতিহাসের নির্মল আত্মপ্রকাশের কথা৷
এদেশে বামপন্থী রাজনীতির জন্ম বিশের দশক থেকে৷ শহরে বন্দরে তখন মানুষের দাবি সোচ্চার হচ্ছিল আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে৷ রাজপথ তখন উত্তাল হয়ে উঠত গণবিক্ষোভে৷ স্লোগানে, বক্তৃতায় ছিল এক সংগঠিত চেহারা৷ সভায় ভিড় করতেন একনিষ্ঠ শ্রোতারা৷ চল্লিশের দশকের তেভাগা আন্দোলন, নৌবিদ্রোহ, ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে প্রাণসঞ্চার করেছিল সভাসমিতির বক্তৃতা৷ মানুষ দেশবন্ধু, মওলানা আজাদ, সুভাষচন্দ্র, গান্ধিজির ভাষণ শুনতে যেতেন অন্তরের তাগিদে৷
বামপন্থীদের সভায় হাজার হাজার শ্রোতা আগ্রহ ভরে শুনতেন জননেতার কথা৷ হরেকৃষ্ণ কোঙার, হীরেন চ্যাটার্জি, সোমনাথ লাহিড়ী, মহম্মদ ইসমাইলের মতো মানুষের বক্তৃতা মানুষ শুনতেন মনোযোগ দিয়ে৷ সৈয়দ বদরুদ্দোজার কথা শুনতে গ্রামের মানুষ চুম্বকের মতো ছুটে আসতেন৷ এসইউসিআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা শিবদাস ঘোষের বক্তৃতা শুনতে শহিদ মিনার ভরে যেত৷ দলীয় সমর্থক ছাড়াও সভায় আসতেন বিরোধী দলের মানুষ৷ সুবোধ ব্যানার্জির সভা হয়ে উঠল যথার্থ ‘মাস মিটিং’৷ তখন সামাজিক দায়বদ্ধতা, আদর্শ, আবেগ মিশে থাকত রাজনৈতিক সভায়৷
এখন সময় পাল্টেছে৷ বদলেছে সমাজ, অর্থনীতি৷ বদলে গেছে রাজনীতি, রাজনীতির ভাষা৷ রাজনৈতিক বিরোধিতা করতে গিয়ে প্রতিপক্ষকে অপমান করা হত না৷ সুবক্তা অনেকেই ছিলেন না৷ কিন্ত্ত আগে অশালীন শব্দবিশেষ ব্যবহূত হতে দেখা যেত না৷ এখন বিরোধী দলের গণআন্দোলনকে অনেকেই মর্যাদা দেন না৷ তুমুল আন্দোলনকে এখন মিডিয়া ভাষা দিয়েছে ‘বিক্ষোভকারীদের ধুন্ধুমার’ নামে৷ রাজনৈতিক সমালোচনার নামকরণ হয়েছে কটাক্ষ৷ দুর্নীতি ধরা পড়লে অন্তত সময় ধরে চলে তল্লাশি আর জিজ্ঞাসাবাদ৷ কেউ বলতে পারবে না তদন্ত কোথায় থামবে৷ রাজনীতি থেকে মতাদর্শ হারিয়ে যাচ্ছে বলেই জমছে লোভ আর দুর্নীতির পাহাড়৷ তৈরি হচ্ছে সীমাহীন নীতিহীনতা৷ এই অবস্থায় রাজনীতির আদর্শ আর থাকে না৷ এখন মানুষ প্রয়োজনে দলে নাম লেখাচ্ছে৷ রাজনৈতিক দলগুলি সেটা ভালো করে বোঝে বলেই মানুষকে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ এখানেই মানুষের মর্যাদার মেরুদণ্ড ভেঙে যাচ্ছে৷ তাই ব্যাপারটা এইরকম— দলে থাকব প্রয়োজনে, ঝান্ডা ধরব প্রয়োজনে৷ ক্ষমতার রং বদলালে নিজেরাও প্রয়োজনে রং বদলাব৷
এ এক অদ্ভুত অদলবদল খেলা৷ মতাদর্শহীন দলের নেতাদের কথা তাই আজ ফাঁকা বুলি মনে হয়, সেইজন্য রাজনৈতিক বক্তব্য শোনার তীব্র তাগিদ আর চোখে পড়ে না৷ রাজনীতির কথা নিয়ে পাড়ার আড্ডায় তর্কের কাটাছেঁড়াও চোখে পড়ে না৷ চারিদিকে লোভ, পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি আর সঠিক শিক্ষার অভাব, মানুষের ভালো-মন্দ বোধশক্তিকে দিন দিন নষ্ট করে দিচ্ছে৷ শুধু ডিগ্রি নয়, মনের শিক্ষার আজ বড় অভাব৷ মানুষের ধৈর্য্য অনেক কমে যাচ্ছে৷ সভাতে শুধুই সংখ্যা দেখানোর প্রতিযোগিতা৷ রাজনৈতিক সভায় ভিড় বাড়ছে, কিন্ত্ত তারা কিছুই শুনছে না, কিছুই বুঝছে না৷ অনেকে দল বেঁধে সভায় আসছেন, দলের পয়সায় খাওয়াদাওয়া করছেন, চিড়িয়াখানা মিউজিয়াম দেখে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন৷ রাজনীতির কথা শুনতে কেউ সভায় আসছেন না৷ রাজনীতি সম্পর্কে অনাগ্রহ মানুষকে রাজনীতি থেকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে দিচ্ছে৷
গণতন্ত্র মানুষের কাছে আস্থার তন্ত্র৷ এই আস্থা আছে বলেই রাজনৈতিক মতাদর্শের দিকে মানুষ অগ্রসর হয়৷ জনগণ, দল, রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়েই রাজনীতির মূল জায়গা৷ রাজনীতি তো সমাজ কীভাবে চলবে, তারই নীতি৷ তাই এখানে রাজনীতির সঙ্গে জ্ঞান ও সামাজিক শিক্ষার বিষয়টি গভীরভাবে মিশে আছে৷ রাজনীতি যে একটা সামাজিক অধিকারের মাধ্যম, এই সত্যকে দাঁড় করাতে হবে সাংস্কৃতিক আধারের ওপর৷ দেশ, মানুষ, মানুষের কষ্ট, বিপন্নতা, হূদয়কে প্রভাবিত করে বলেই সামাজিক দায়বদ্ধতার তাড়নায় মানুষ রাজনীতিতে আসেন৷ যথার্থ মতাদর্শই মানুষকে সঠিক রাজনীতিতে উন্নীত করে৷ উন্নত রাজনীতি চর্চার অভাবই আজ রাজনীতির আদর্শহীনতাকে গড়ে তুলছে৷ মানুষ তাই সস্তার রাজনীতি, চমকের রাজনীতিতে গা ভাসাচ্ছে৷ দেশের মূল সমস্যাকে ভুলে মানুষ খুব সহজেই ধর্মাউন্মাদনা, জাতপাত, হীন ব্যক্তিস্বার্থ, অপরের প্রতি বিদ্বেষ, স্বার্থপরতা নিয়ে মেতে থাকছে৷ তাই উন্নত রাজনীতির বক্তৃতা এখন কে শোনাবে, আর শুনবেই বা কে?