• facebook
  • twitter
Saturday, 28 September, 2024

পাশ্চাত্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা অনেকটা ভারতের মতোই

ইউরোপের মতো ভারতেও দক্ষিণপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টি মুসলিম প্রভাব ক্ষুণ্ণ করতে বদ্ধপরিকর। তাই বিজেপি’র মতো পার্টির উত্থান সংখ্যাগুরু হিন্দুদের পক্ষে কিছুটা স্বস্তির বিষয়।

ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক পরিবর্তন আধুনিককালে ভারতের রাজনীতিতে আর তেমন প্রভাব ফেলে না। কিন্তু ইউরোপ তথা বিশ্ব রাজনীতিতে এই ঘটনার বিশেষ তাৎপর্যস্থ বহন করতে পারে। সারা ইউরোপে অতি দক্ষিণপন্থীদের দাপট এখন বহু চর্চিত বিষয়। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে গিয়ে ঐতিহাসিকভাবে দক্ষিণ ঘেঁষা কনজারভেটিভ পার্টিকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে বামপন্থী পরিচিত লেবার পার্টি যেন হঠাৎ করে বলে উঠল ‘থামো!’

কিন্তু থামো বললেই আর সব থেমে থাকে না। ইউরোপ যে প্রশ্নে দক্ষিণ দিকে ঝুঁকেই যাচ্ছে, তা হল সেখানকার দেশগুলোতে ক্রমবর্ধমান মুসলিমভীতি। ওইসব দেশে মুসলমানেরা প্রধানত তাদের পিতৃভূমি থেকে আগত। সম্প্রতি সেটা যেন এক বিস্ফোরিত রূপ গ্রহণ করেছে। প্রায়ই বিভিন্ন জলপথে মুসলমান জনসমষ্টি লোকচক্ষুর আড়ালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে যাচ্ছে। বেশকিছু বেআইনি জলবাহিনী সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে অর্থাৎ নিমজ্জিত হয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা ব্যর্থ করে দিলেও এখনও মধ্যপ্রাচ্য থেকে দলে দলে জনসমষ্টি ইউরোপের দেশে দেশে শরণার্থী দাবি নিয়ে হাজির হচ্ছে। এদের খবর আামরা প্রায়শই সংবাদমাধ্যমের প্রচার থেকে জানতে পারি।
এসব ঘটনা দেখে ইউরোপের দেশগুলোতে ক্রমশ তাদের দেশের লোকদের মধ্যে নানারকম প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অনাহুত আগন্তুকরা তাদের দেশে যেমন একদিকে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে বলে আশঙ্কিত হয়ে পড়েছে, তেমনি তাদের দেশের নিজস্ব কৃষ্টি সহ সর্বব্যাপী এক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং পড়বে বলে ভীত হয়ে উঠেছে। এরই প্রতিক্রিয়ায় প্রতিরোধ বাহিনী হয় গড়ে উঠেছে, নয় অতি দক্ষিণপন্থী দলে দলে লোক ভিরে যাচ্ছে। শুধু ইউরোপ নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও একই লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে।

এসব ঘটনা অনেকটা আমাদের অসমের মতো। ওখানে বাঙালিদের আধিক্য দেখে পরবর্তীকালে দেশ ভাগাভাগির পরে আরও অনেক বাঙালি হিন্দু শরণার্থী এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি মুসলমানদের প্রবেশ চোখে পড়ার মতো। ওখানে শুরু হয় বঙ্গাল খেদাও আন্দোলন, সেটাই বিশেষভাবে মুসলমান বিরোধিতায় চলে যায়।

ইউরোপ তথা পাশ্চাত্য দেশে ক্রমাগত মুসলিম অনুপ্রবেশের ঘটনায় সেসব দেশের ভূমিপুত্রদের সেই পরিমাণে আশঙ্কা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারই ফলস্বরূপ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মোটামুটি মজবুত হলেও পাশ্চাত্যে তার বিরোধ ক্রমাগত স্পষ্ট হতে শুরু হয়েছে। এখন দক্ষিণপন্থীদের জয়ধ্বনি যেন বিশ্বজুড়েই স্পন্দিত হচ্ছে।

পূর্ব ইউরোপ ঘটনাক্রমে প্রথমে জার্মান নাৎসীদের দখল মুক্ত হবার পরে পরেই রুশ কমিউনিস্ট পূর্ণ কবজায় চলে যায়। ফলে সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোনও শিকড় গড়ে উঠতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবেই হাঙ্গেরিতে ভিক্টর ওর্বান নামে এক দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদ সেখানে ক্ষমতা দখল করে বসে. তাঁর মুসলিম অভিনিবেশ অভিযান সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব এখন আর অজানা নয়। তাঁর পার্টির মেনিফেস্টোতে বলা হয়েছে হাঙ্গেরিতে কোনও মসজিদ তৈরি নিষিদ্ধ করা হবে, ইসলামিক বিদ্যালয় তুলে দেওয়া হবে এবং কোরান ধর্মপুস্তকের কোনও স্থান হাঙ্গেরিতে থাকবে না। ইউরোপের অন্যান্য দেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল যখন ওর্বান হাঙ্গেরিতে এইসব কাজগুলিতে থেকে বিরত থাকল। কারণ ইউরোপ ইউনিয়নে থাকা ওর্বানের পক্ষে অনেক বেশি প্রয়োজন। ইউরোপ ইউনিয়ন এখনও পুরোপুরি মুসলিম বিশ্বের প্রতিস্পোর্ধী এক ভৌগোলিক স্থান নেওয়ার কোনও আগ্রহ দেখাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।

এতদসত্ত্বেও হাঙ্গেরির সঙ্গে অনুদার পন্থায় পোল্যান্ডের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপিত হয়েছে। চেক প্রজাতন্ত্র এবং শ্লোভাকিয়ার সঙ্গেও এক ধরনের আদর্শগত সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু পুরোপুরি সেটা কোনও স্থায়ী রূপ গ্রহণ করতে পারেনি। কারণ হাঙ্গেরি যদিও রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ সমর্থন করে পোল্যান্ড তার বিরোধিতায় সরব।

এহ বাহ্য। ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের দেশ নেদারল্যান্ড যেন হঠাৎ বিগড়ে গিয়ে গিট ওয়াহিল্ডার্স নামে একজন অতি দক্ষিণপন্থীকে ২২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী করে দিল। তার দলকে উদারপন্থীরা কোনওরকম সহযোগিতা করতে অপারগ হয়ে যায়।

ওয়াইল্ডার্সের দল শুধুমাত্র সংহত ইউরোপ ইউনিয়নের মূলধারাকে মেনে নিতে অপারগ নয় তারা মুসলিম বিরোধী এবং অভিনিবেশকারীদের প্রতিহত করতে তৎপর। প্রায় একই সুরে ইতালিতে গ্লোরিয়া মেলেনি অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রী রূপে আত্মপ্রকাশ করলেন। তিনি আবার ইতালির ফ্যাসিস্ট একনায়ক ব্রুনো মুসোলিনির সমর্থনে অনেক কথা বলে থাকেন।

প্রায় একই সঙ্গে ইউরোপের অন্যান্য দেশ শুধু দক্ষিণ নয়, অতি দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে। অস্ট্রিয়া, জার্মানি এবং বেলজিয়ামের মতো দেশেও অভিনিবেশ অভিযান স্পষ্ট হবার লক্ষণ দেখা যাবার পরে পরেই অতি দক্ষিণ ঘাড়ে যেন ইউরোপের দেশগুলো ভর করতে চাইছে। অতি সম্প্রতি ফ্রান্সে নির্বাচন হয়ে গেল। সেখানে প্রথম দফায় সর্বদিকে পরিচিত মেরিন লে পেনের দক্ষিণপন্থী দল তুমুল সফলতা লাভ করে। পরবর্তী পর্যায়ে বাম-মধ্যবর্তীরা একত্রিত হয়ে লে পেনের পার্টিকে বেশ কিছুটা কোণঠাসা করে দেয়। কিন্তু ভবিষ্যৎ ফ্রান্স তথা অন্যান্য ইউরোপের দেশগুলোর রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির দিকে নজর রাখা বিশ্ববাসীর পক্ষে অতি প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।

ইউরোপের বাইরে কিন্তু পাশ্চাত্য জগতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। সেখানে ভীষণভাবে দক্ষিণকামী ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি পদে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শেষ পর্যন্ত নভেম্বরে নির্বাচন থেকে সরে আসার পর আমেরিকার রাজনৈতিক অস্থিরতা স্বাভাবিকভাবেই বড় আকার ধারণ করেছে। যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে জয়লাভ করেন, তবে সমস্ত পশ্চিম দেশেই দক্ষিণপন্থীরা বড় বড় পদচারণা করার সুযোগ পেয়ে যাবে। তার ফলে বিশ্বজুড়েই চরম অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে। ওদিকে রাশিয়া ইউক্রেনে শেষ পর্যন্ত কী অবস্থায় উপনীত হয়, সেটা এখনও স্পষ্ট হয়ে উঠছে না।

এর মধ্যে যারা ইংল্যান্ডের নির্বাচনে রক্ষণশীল দলের পর্যুদস্তের মধ্যে লেবার পার্টির ক্ষমতা ধরে রাখার বিষয়েও যথেষ্ট সন্ধিহান। কারণ সেই দেশে রিফর্ম পার্টি নামে একটি দক্ষিণপন্থী দলের আবির্ভাব হয়েছে। ভীষণভাবে অনুপ্রবেশ (মুসলিম) প্রতিরোধী নীতি নিয়ে তারা এবার ১৪ শতাংশ বোট সংগ্রহ করেছে। ইংল্যান্ডের অনুপাতে সেই সংখ্যা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এদের উত্থানের মধ্যেই অতি দক্ষিণপন্থীদের ভবিষ্যৎ ক্ষমতা দখলের তাগিদ এখনই অনুভূত হচ্ছে। তাদের প্রভাবেই বলা চলে বিদায়ী রক্ষণশীল দলের হয়ে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক প্রাক-নির্বাচন কালেই বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিনা অনুমতিতে চলে আসা জনগোষ্ঠীকে তারা দেশে জায়গা না দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেবেন। এখন দেখা যাক সদ্য ক্ষমতায় আসীন শ্রমিক দল (লেবার পার্টি) এই বিষয় নিয়ে কোনও পদক্ষেপ করে কিনা। অবশ্য বেশ কয়েক বছর ধরেই ব্রিটেনে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে বহু মুসলিম জনগোষ্ঠী শিকড় গড়ে তুলেছেন। তিন বছরের অধিক লণ্ডনের মেয়র একজন মুসলিম নেতা। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল ধারেভারে মুসলিম জনগোষ্ঠী হয় অভিবাসন, অনুপ্রবেশ অথবা শরণার্থী রূপে ইউরোপের দেশগুলোতে জাঁকিয়ে বসেছে বলে দেখা যাচ্ছে। ঠিক সেই অনুপাতে ইউরোপীয়দের মধ্যে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্যণীয়ভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে।

অনেকটা আমাদের দেশের মতো। ইউরোপের মতো ভারতেও দক্ষিণপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টি মুসলিম প্রভাব ক্ষুণ্ণ করতে বদ্ধপরিকর। তাই বিজেপি’র মতো পার্টির উত্থান সংখ্যাগুরু হিন্দুদের পক্ষে কিছুটা স্বস্তির বিষয়। যদিও হিন্দু ধর্মে বহুত্ববাদের প্রচলন থাকায় মুসলিম-বিরোধ করাল অফার ধারণ করতে পারছে না এখনও পর্যন্ত।