• facebook
  • twitter
Sunday, 27 April, 2025

পয়লা বৈশাখ ও বাঙালি জাতি সত্তার আকাশে কালো মেঘ

পৃথিবীর সব কিছুই যেহেতু চলে ইংরেজি ক্যালেন্ডার মেনে সেহেতু আধুনিক প্রজন্মের কাছে এই পয়লা বৈশাখকে তারা একলা (১লা) বৈশাখ করেই এগিয়ে যাচ্ছে।

পয়লা বৈশাখ বাঙালির জীবনে এক গভীর প্রত্যাশা নিয়ে আসে। তার আবেগ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভালো লাগা, নতুন বছরের জন্য নতুন নতুন স্বপ্ন তৈরি হয় তাদের মনের আকাশে। এক আনন্দ বার্তা বয়ে যায় চারদিকে। নতুন জামাকাপড়ের সঙ্গে নতুন নতুন স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়। পৃথিবীর প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীরই নিজস্ব দিনপঞ্জিকা অনুসারে তাদের নিজস্ব বছরের প্রথম দিনটি রঙিন হয়ে ওঠে। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রান্তের ভিন্ন ভাষাভাষীরা এই দিনটিকে ‘বেঙ্গলি ডে’ বলে অভিহিত করেন। এই দিনটি তাদের কাছে নতুন বর্ষ বরণের দিন। পয়লা বৈশাখ একটি আদ্যোপান্ত সেক্যুলার উৎসব। এই কথা বললাম এই কারণে যে পূর্ব-পশ্চিম অর্থাৎ বর্তমানের বাংলাদেশের বাঙালিরাও কিন্তু এই বাঙালি সত্তা নির্মাণে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের এক ঐক্যবদ্ধ সাধনার মধ্য দিয়েই এই বাঙালি সত্তার বৃত্তটি পূর্ণ হয়ে উঠেছে। অনেক আগে থেকেই। বাঙালির এই সেক্যুলার বাঙালি সত্তাকে রক্ষার জন্যই পশ্চিম পাকিস্তানের সংসদে পূর্ববঙ্গে মাতৃভাষা বাংলার জন্য প্রথম দাবিটি উত্থাপন করেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।

এই দাবিকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই জন্ম হয় বর্তমান বাংলাদেশের। সে বড়ো সুখের সময়। বাঙালির ও বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির গর্বের ইতিহাস। নতুন দেশের জন্য জাতীয় সঙ্গীত দলমত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে নিজেদের আত্মার তাগিদে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে নিল কবিগুরুর লেখা, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে। বাঙালি জাতির সে এক গণ উৎসবের দিন যেন। দিকে দিকে রবিঠাকুরের, নজরুলের গান, কবিতা। মধুকবি থেকে শুরু করে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সব কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের শিল্প নিয়ে যে চর্চা শুরু হলো তাতে মনে হলো— যেন বাঙালি জাতির আর এক নবজাগরণের সূচনা। নতুন দেশের নতুন পতাকার নকশাও এঁকে দিলেন শিল্পী শিবনারায়ণ দাস।

নতুন দেশের নতুন পতাকা হাওয়ায় শুধু নিজেই উড়ল তা নয়, যেন ডানা মেলে অখণ্ড ও ঐতিহ্যমণ্ডিত বাঙালি জাতির সেক্যুলার সংস্কৃতির এক গৌরবময় সেই উড়ান। বাঙালি আবার ছিনিয়ে নিল তার স্বকীয়তা ও ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মৌলবাদী ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনবাদী পশ্চিম পাকিস্তানের কাছ থেকে। এ ছিল বড়ো আনন্দের দিন। কিন্তু ধীরে ধীরে সব কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল এবং যাচ্ছে। বিশেষ করে গত বছর ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে এক মুষলপর্বে সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেল রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের জন্য। এই পর্বে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের স্মৃতিকে মুছে ফেলার জন্য এক মৌলবাদী চক্রান্ত। ধর্মনিরপেক্ষতার বিভিন্ন স্মৃতি ও উপাদানগুলোকে ধ্বংস ও মুছে ফেলার এক ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়া। পৃথিবীর সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি যিনি একজন বাঙালি তিন তিনটি দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা তাঁর লেখা জাতীয় সঙ্গীত যা এতদিন পর্যন্ত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের বুকের ধন, তাকে বাদ দিয়ে নতুন জাতীয় সঙ্গীত রচনা ও প্রবর্তনার এক দুঃসহ অপচেষ্টা।

জাতীয় পতাকাকে পরিবর্তন করার এক ভয়ঙ্কর হীন ও নীচ মানসিকতা। এতো বাঙালি এতদিনের ঐতিহ্যমণ্ডিত ধর্মনিরপেক্ষতার উপর, বাঙালি জাতিসত্তার উপর কুঠারাঘাত! এপার ওপার মিলিয়ে তো একই জাতি, ভাষা ও সাংস্কৃতিক সত্তা। স্বাভাবিকভাবেই সমগ্র বাঙালি সত্তার কাছে এ বড়ো দুর্দিন। পয়লা বৈশাখ বাঙালির বড়ো আবেগের দিন। প্রথমত নতুন বছরের শুরু এবং এ মাস তো আমার কাছে বাঙালির হৃদয়ের আশ্রয় রবি ঠাকুরের মাস। স্বাভাবিকভাবেই বর্ষবরণের একটা আলাদা মাত্রা বাঙালিমাত্রই আছে। তাই বাংলাদেশে ১৮৮৯ সালে এই দিনটিকে স্মরণীয় এবং উজ্জ্বল করে রাখার জন্য শুরু হয় ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। পরবর্তীকালে এই শোভাযাত্রাকে আরো অর্থবহ এবং সামগ্রিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য এর নাম দেওয়া হয়। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। এই মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য জীবনের একটি অসাধারণ অর্থ যেন বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। তাই তো এই বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কো এক অসাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দেয়।

বাংলাভাষা যেমন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার একটি দিন বাইশে ফেব্রুয়ারিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল তেমনি এই বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রাও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার ফলে বাঙালি জাতির ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিই জয়ী হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এখনকার বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা এই বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রার নামটাও পরিবর্তন করে দিল। তার বদলে এই বর্ষবরণের শোভাযাত্রার নাম রাখল ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। দুটি কথা এখানে বলতেই হচ্ছে। ‘মঙ্গল’ শব্দের অর্থ হলো কল্যাণ বা হিত। এই কল্যাণ কামনার মধ্যে রয়েছে এক উদার মানসিকতার পরিচয়। অন্যদিকে ‘আনন্দ’ শব্দের অর্থ হলো মজা, সুখ বা পুলক। মানব কল্যাণের থেকে এখন বর্ষবরণের শোভাযাত্রার অভিমুখ মজা ও পুলকের দিকে। প্রশ্ন জাগে কার মজা? কার পুলক? এর সঙ্গে আরো একটি প্রশ্ন উঁকি মারছে অবধারিতভাবে। তাহলো, ইউনেস্কো তো বর্ষবরণের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

তাহলে নিশ্চয়ই এখন ‘আনন্দ যাত্রা’র আর কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থাকল না! এবার আসি একটু অন্য প্রসঙ্গে। এপার বাংলাতেও কি নববর্ষ বরণের সেই ঐতিহ্য বহমান? একটু গভীরে ডুব দিলে দেখা যাবে অন্য চিত্র। আগে পয়লা বৈশাখের সঙ্গে শহর থেকে গ্রামে গঞ্জে সর্বত্র এক ঘন আবেগ লক্ষ্য করা যেত। তার মধ্যে ধর্মীয় অনুষঙ্গ জড়িয়ে ছিল না একথা কিন্তু বলা যাবে না। ছোটবেলায় দেখেছি পয়লা বৈশাখের সকালে উঠে বড়দের সঙ্গে বাড়ির সবাই মিলে হৈচৈ করে গঙ্গা স্নানে যেতে হতো। যেখানে গঙ্গা নেই সেখানে অন্য নদী বা বড় জলাশয়ে সবাই স্নান করত। মনে করা হতো বছরের প্রথম দিন এই স্নানটা ছিল পবিত্র। এই পবিত্র স্নান করতে পারলে নাকি সারাটা বছর ভালো যাবে। এটা নিতান্তই একটা বিশ্বাস। এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তবুও যেন ওই স্নানের মধ্যে একটা আলাদা অপূর্ব ভালোলাগা মিশে থাকত। তারপর বাড়ি গিয়ে নতুন জামাকাপড় পরে বাড়ির বড়োদের এবং প্রতিবেশী জ্যাঠা, কাকা, মাসি, পিসি, দাদু ঠাকুমা থেকে শুরু করে বয়সে বড়ো পাড়াতুতো দাদা দিদিরা কেউই বাদ যেত না। একটা সামাজিক বন্ধন আঁটোসাঁটো হয়ে উঠত। তারপর এই পয়লা বৈশাখে বিভিন্ন জায়গায় বৈশাখী মেলা তো ছিল।

জিলিপি, বাদাম, পাঁপড় ভাজার সঙ্গে ভেঁপু বাঁশি তো ছিলই। শুধু কি তাই? পয়লা বৈশাখে যেকোনো বাড়িতে সে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত বা অতি নিম্নবিত্ত হলেও সাধ্যমতো একটু ভালো রান্না, খাবার দাবারের ব্যবস্থা করা হতো। একেবারে দেশীয় খাবার দাবার। কিন্তু সে জায়গাটাও হারিয়ে যাচ্ছে। এখন আর কষ্ট করে কেউ বাড়িতে রান্নাবান্না করতে চান না। অনলাইনে অর্ডার দিয়ে দেওয়া হয় খাবারের। কেউ কেউ তো আবার বাইরে রেস্টুরেন্টে চলে যাচ্ছেন। এর ফলে বাঙালির চিরাচরিত ঐতিহ্যবহনকারী মা, পিসিদের রান্নাগুলো উঠেই যাচ্ছে। প্রত্যেক জাতির রন্ধনশিল্পের একটা ঐতিহ্য আছে — আমরা সে জায়গাটা থেকেও নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছি এবং নিজেদের অতি আধুনিকতার রাংতায় মুড়ে ফেলছি। হারাচ্ছি বাঙালির বাঙালিয়ানার ঐতিহ্য। এরপর বিভিন্ন দোকানে হালখাতার উৎসব। কি সামাজিক বন্ধন! সেদিন বড়ো-ছোট- মাঝারি খদ্দেরের মধ্যে কোনো ভাগাভাগির ব্যাপারই ছিল না দোকানদারের কাছে। সবাই যে অতিথি।

সে সব আজ ইতিহাস। এখন বিগ বাজার আর অনলাইন। কোনো সামাজিক যোগাযোগ নেই। দোকানদার আর ক্রেতাদের মধ্যেকার সেই সামাজিক ও মানবিক সম্পর্ক উধাও হয়ে গিয়েছে। বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম ব্যাকডেটেড মানসিকতা বলেই বর্তমান প্রজন্ম মনে করে। এর ফলে পয়লা বৈশাখ বা বর্ষবরণের সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর সব কিছুই যেহেতু চলে ইংরেজি ক্যালেন্ডার মেনে সেহেতু আধুনিক প্রজন্মের কাছে এই পয়লা বৈশাখকে তারা একলা (১লা) বৈশাখ করেই এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলা তথা বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ও বাঙালি সত্তার ক্ষয়ক্ষতি শুরু হয়ে গেছে। সেই ক্ষয়ক্ষতির শব্দ আপনারা কি শুনতে পাচ্ছেন কেউ? বাঙালি সত্তার আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা — নিশ্চয়ই আপনাদের চোখে এখন না পড়লেও একদিন ঠিক চোখে পড়বে।