মানুষের উৎসব, মানুষের প্রতিবাদ: অনন্য নজির বাংলার

‘রাতদখল’-এর আন্দোলন দুই মাস অতিক্রান্ত হতে চলেছে। আন্দোলন মূল্যায়নের সময় হয়তো এখনও আসেনি, এটি এখনও ‘ঘটমান বর্তমান’। তবে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলায় অন্যতম বড় গণআন্দোলন হিসাবে এই আন্দোলন ইতিমধ্যে ঐতিহাসিক গুরুত্ব লাভ করেছে। আরজিকর মেডিকেল কলেজে চিকিৎসক-ছাত্রী হত্যা-ধর্ষণের ন্যায়বিচার চেয়ে এই আন্দোলনের শুরু, কিন্তু বাস্তবে উচ্চারিত হোক বা না-হোক সরকারের সার্বিক ‘অন্যায়’-এর বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার চাইতেই সারা রাজ্যের মানুষ আজ পথে নেমেছে। আরজিকর মেডিকেল কলেজের ঘটনা এক স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছে।

দুর্গাপূজার ঢাকে কাঠি পড়লেই বাঙালি ভুলে যাবে, এই আনন্দে বিভোর ছিল রাজ্যের শাসক দল। আশঙ্কা একটা ছিল শাসকের, তাই ‘উৎসবে ফেরার আহ্বান’ দেওয়া হল। পাল্টা মানুষ আন্দোলনের উৎসব আহ্বান করল। মহালয়ার পরেও রাস্তা ছাড়ল না বাঙালি, প্রতিপদে পদযাত্রা, দ্বিতীয়ায় মিছিল, কলকাতা যেন নতুন ইতিহাস রচনা করতে চলেছে। এই পর্যন্ত ঠিকই চলছিল।

এই পরিস্থিতিতে পুজো কেমন কাটবে, এবার এই প্রশ্ন সঙ্গী করেই উৎসবে সামিল হয়েছিলেন বাংলার মানুষ। উৎসব শেষে প্রশ্ন উঠছে , দুর্গাপুজো অর্থাৎ বাংলার সেরা উৎসবটি কেমন কাটল? সর্বজনীন দুর্গোৎসবে এই প্রশ্নটিও ছিল সর্বজনীন -বিগত বছরগুলির থেকে এবারের উৎসব ছিল কতটা ভিন্ন? উৎসবের মেজাজের ফারাকটি এবার বোঝার চেষ্টা করেছেন বহু মানুষ। উপলব্ধি করার চেষ্টা চালিয়েছেন, তিলোত্তমার বিচার আদায়ে নাগরিকের ব্যাকুলতার পরিধি কতখানি। আর তা করতে গিয়ে তাঁরাও অনেকেই নানা ভাবে ফারাক গড়ে দিয়েছেন। এর আগে এভাবে গণ-মানুষকে একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে এতটা সম্পৃক্ত হতে এবং এমন নিবিড় পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় দেখিনি।


প্যান্ডেলের ভিড় নিয়ে সকলে একমত ছিলেন না। কারও কারও চোখে শহরের বিশেষ কোনও পুজোর পরিচিত ভিড় এবার নজরে পড়েনি। এই বক্তব্যের সঙ্গে যারা সহমত হতে পারেননি, তাঁরা আবার এবারের ভিড়কে জনজোয়ার বলতেও রাজি নন। উৎসবে শামিল হতেও কেউ মানা করেনি। মানুষ উৎসবে কীভাবে সামিল হল সেটাই মুখ্য এবং তা এবার সম্পূর্ণ আলাদা, নতুন। বাংলায় দুর্গাপুজোয় এমন সংযম, উৎসব এমন উচ্ছ্বাসহীন কখনও দেখা যায়নি। এটাও প্রতিবাদের এক রূপ।

ভিড় নিয়ে পর্যবেক্ষণের ফারাকটুকু ছাড়া সকলেই একমত, উৎসব ঘিরে আনন্দের বন্যা বয়ে যাওয়া ছবিটার এবার দেখা মেলেনি। তেমন আবহই ছিল না। যদিও আবহাওয়া যতটা বিশ্বাসঘাতকতা করবে মনে করা হয়েছিল, ততটা করেনি। বৃষ্টি হয়েছে বিক্ষিপ্ত, ছিঁটেফোটা। তবু প্যান্ডেলের ভিড়, নতুন জামা-কাপড় পরে ঠাকুর দেখতে বেরনো মানুষ, তাদের বেশিরভাগের মধ্যেই যেন সচেতন প্রয়াস ছিল উচ্ছ্বাস, উল্লাস, উন্মাদনা যথাসম্ভব চেপে রাখা। এমনকী কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরণীদের যে সব আচরণ বাকিদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, অনেক সময় আইন-শৃঙ্খলার সমস্যায় গড়ায়, তেমন ঘটনা, উচ্ছৃঙ্খলতা এবার চোখে পড়েছে কম। এভাবেই নির্যাতিতার জন্য ন্যায় বিচার দাবিতে সামিল ছিল তারা।

উৎসবের মধ্যেই জুনিয়র ডাক্তাররা ধর্মতলায় অনশন আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছেন। উৎসবের মাঝখানেই গণ-মানুষ অনশনরত ডাক্তারদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে কত মানুষ তাঁদের প্রতি সমর্থন, সহমর্মিতার হাত বাড়াতে হাজির হয়েছিলেন, মুখে মুখে, সমাজমাধ্যমে সে প্রশ্ন ছড়িয়ে দিয়েছে কোনও কোনও মহল। সংখ্যাটা হয়তো বড় মুখ করে বলার মতো নয়। ময়দানের ভিড়, মিছিলের দৈঘ্য বহুকাল জনসমর্থনের মাপকাঠি নয়। পুজোয় যে মানুষ উৎসবে থেকেও আনন্দ-উন্মাদনায় গা ভাসালেন না; সংখ্যায় তারা কত, কে বলতে পারে?

সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন আসলে এক অসম যুদ্ধ। আজ এই অসম যুদ্ধে সামিল বাংলার ছাত্র-যুব-জুনিয়র ডাক্তার-প্রবীণ নাগরিক-সহ সমাজের এক বড় অংশ। আর রাষ্ট্র যখন তার নখ দাঁত নিয়ে আরও বেশি আক্রমণাত্মক তখন সেই লড়াইয়ে শুধু আবেগ নয় কৌশলও দরকার হয়। হ্যাঁ কৌশলও। কেননা সরকার প্রতিনিয়ত তার কৌশল করে চলেছে। বিভেদের রাজনীতি, আন্দোলন ভাঙার রাজনীতি, ভয় দেখানোর হরেক কৌশল।

এখন প্রশ্ন হল, আমার পরিচিত কয়েকজনের মতামতকে কি সামগ্রিক চিত্র বলা যায়? সংখ্যার নিরিখে কখনওই বলা যায় না। কিন্তু কয়েকজনের অভিন্ন জবাব যে বহুজনের মনের কথা হতে পারে, সেটা মানতে আশা করি খুব বেশি মানুষ আপত্তি করবেন না। সেটা কীসের ইঙ্গিত? উৎসবে সহমর্মি, সমব্যথী থাকার এমন নজির, প্রাপ্তি বিরল। যদিও নজরকাড়া উচ্ছ্বাস, উন্মাদনার অনুপস্থিতিকে উৎসবের অপ্রাপ্তি মনে করি না। এই সুবাদে বরং বাংলার সেরা উৎসবে আমাদের সামাজিক চেতনাকে খানিক পরিচ্ছন্নও করা গেল।

‘জাস্টিস ফর তিলোত্তমা’-র আন্দোলন সেই গণচেহারা নিয়েছে কিনা সে প্রশ্ন কেউ তুলতেই পারেন। লিঙ্গ-শ্রেণি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের অংশগ্রহণ থেকে মনে হয়, এখানে জাস্টিস মানে নিছকই আরজি করের ঘটনার বিচার নয়। বিচার তো বিচারালয় করবে। এত মানুষ তাহলে জাস্টিসের দাবিতে সরকারের দুয়ারে কড়া নাড়ছেন কেন? আসলে মানুষ অবস্থা, ব্যবস্থার বদল চাইছেন। চাইছেন সরকারের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গির বদল, পেশ করছেন আন্দোলনের প্রতি সহমর্মি হওয়ার দাবি। অনেকেই মনে করেন, এ বছর দুর্গা কার্নিভ্যাল বন্ধ রেখে সরকার সহমর্মিতার অনন্য নজির গড়তে পারত। সরকার তার মানবিক মুখ দেখাতে পারত। সেই সুযোগ সরকারের কাছে ছিল।