প্রবীর মজুমদার
‘আরবরা কোথায়? আরবরা কোথায়?’ ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে ধসে যাওয়া ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে, মৃত শিশুদের কোলে তুলে ক্যামেরার সামনে অসহায়ভাবে চিৎকার করে এই একটাই প্রশ্ন করেছিল গাজাবাসীরা। সেই মর্মস্পর্শী ছবি দেখেছে সারা পৃথিবীর মানুষ। কেন আরব প্রতিবেশীরা ইসরায়েলি বোমা হামলা থেকে তাদের রক্ষা করছে না?
২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের হামলায় ২৬০০ ইসরায়েলি নিহত এবং আড়াইশ জনের মতো অপহৃত হয়েছিল। তারপর থেকে সবার দৃষ্টি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। সবার মনে প্রশ্ন ছিল, ইসরায়েল কতোটা তীব্রভাবে এর প্রতিশোধ নেবে আর এ অঞ্চলের আরব দেশগুলোর জনগণ ও সরকারের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে?
ফিলিস্তিনের উপর হামলা দেখে সারা বিশ্বের অমুসলিমদের ব্যক্তিগত কষ্ট, হতাশা, প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। মুসলিম নয় এমন দেশের ছাত্র সংগঠনগুলো প্রতিবাদ মিছিল বের করে। খোদ ইসরায়েলের নাগরিকরা প্রতিবাদ মিছিল করেছে।
মুসলমান প্রধান দেশগুলো সবসময় ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন এবং ‘নিপীড়িত’ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আসলেও বড় ধরণের সংকট এলে পুরো মুসলিম বিশ্বকে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে খুব একটা শক্ত অবস্থান নিতে দেখা যায় না। এমনকি মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি কিংবা আরব লীগও ইসরায়েলের সাথে সংকটকালে ফিলিস্তিনের পক্ষে খুব জোরালো কোন ভূমিকা নিতে পারে না। আজকে ফিলিস্তিনিদের কোন আরব মুসলমান ভাই রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। তাদের আশ্রয় দেয়নি। এমনকি ফিলিস্তিনির একটা বড় অংশ যে জর্ডান দখল করে নিয়েছে বহু আগে সেকথা তো কেউ ভুলেও উল্লেখ করে না। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থী কোথায় যাবে?
২০২৩ এর অক্টোবরে গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাস ইসরায়েলি ভূখণ্ডে অতর্কিতে ভয়াবহ হামলার পর নিরবচ্ছিন্ন বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। উভয় পক্ষের আক্রমণে বহু বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে ইরান ছাড়া আর কোন দেশকেই উচ্চকণ্ঠে কথা বলতে দেখা যায় নি। বরং কোন কোন মুসলিম দেশের প্রতিক্রিয়া ছিলো একেবারেই নখদন্তহীন। মুসলিম বিশ্বের জনগণ ফিলিস্তিনের পক্ষে একাট্টা হলেও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতার কারণে সরকারগুলোর পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়া অসম্ভব। এর পিছনে আছে অন্য বাস্তবতা। গণতন্ত্র এবং প্রতিনিধিত্বশীল সরকার মুসলিম বিশ্বে খুবই কম এবং এ ধরনের দেশগুলোর সরকারকে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রভাবশালী পশ্চিমী দেশগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয় বলে পশ্চিমীদের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে যাওয়ার সুযোগ তাদের নেই।
আবার ফিলিস্তিনে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন পিএলও, গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাসের পাশাপাশি আরেক সংগঠন হেজবুল্লাহকেও বিভিন্ন প্রভাবশালী মুসলিম দেশ সমর্থন দিয়ে থাকে বলে প্রচার আছে। যেমন হামাস ইরান-সমর্থিত বলে বর্ণনা করে পশ্চিমীরা। অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ও সৌদি আরবের মতো প্রভাবশালী আরব দেশগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরায়েলের সাথে তাদের সম্পর্ক জোরদার করেছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই ফিলিস্তিনিদের স্বার্থকে দুর্বল করেছে বলেও মনে করেন অনেকে। মুসলিম বিশ্বে প্রভাবশালী আরব দেশগুলোর, কেউ কেউ ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে আবার কেউ কেউ স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়ায় আছে। নিজেদের ক্ষমতাকে তারা চিরস্থায়ী করে রাখতে চায়। সংগত কারণেই তারা হয়তো মনে করে পপুলার সেন্টিমেন্ট যাই হোক ইসরায়েলকে ঘাঁটানো তাদের ঠিক হবে না। এ কারণেই তাদের কণ্ঠ উচ্চকিত দেখা যায় না। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে প্রভাবশালী আরব বিশ্বে গণতন্ত্র বা নির্বাচনের বালাই নেই। ইসরায়েলের সাথে সমঝোতা বা ভারসাম্য রক্ষা করে চলা তাদের জন্য জরুরি।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর শাসক পরিবারগুলো ক্ষমতার প্রশ্নে কোন ধরনের আপোষ কখনোই করে না। আবার এসব দেশে গণতন্ত্র বা জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ব্যবস্থাও কাজ করে না। তারপরেও অনেকেই মনে করেন লিবিয়া ও সিরিয়ার ঘটনার পর আরব দেশগুলোর রাজপরিবারগুলো নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার বিষয়টি নিয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন। মুসলিম দেশগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ জটিল রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্য নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ার কারণেই ফিলিস্তিনের পক্ষে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারছে না। বেশিরভাগ দেশেই দুটি প্রবণতা—জনগণ ফিলিস্তিনের পক্ষে বেশি কিন্তু সরকারগুলোর কথায় জোর কম। তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার জটিলতার কারণেই তারা শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারে না। আবার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসক নির্বাচন করার সুযোগ আছে ইরানে। দেশটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বলয়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল শক্ত অবস্থান নিয়ে আসছে। অন্যদিকে তুরস্ক বিবৃতিতে শক্ত ভাষা ব্যবহার করলেও নেটোর সদস্যপদসহ বেশ কিছু বিষয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে কৌশলী ভূমিকা নিতে হচ্ছে। এর বাইরে অন্য দেশগুলোর সরকার ও জনগণের চিন্তার মধ্যেই প্রচুর ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে। এছাড়া অনেক দেশ থেকে আমেরিকান সমর্থন সরে যাচ্ছে। ফলে তাদের জন্য ইসরায়েল সিকিউরিটি গ্যারান্টার হিসেবে কাজ করছে। ইরান ছাড়া বেশিরভাগ দেশেরই পাশ্চাত্য নির্ভরতা অনেক বেড়েছে। সে কারণে তাদের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়।
মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই গণতন্ত্র নেই এবং সে কারণে এসব দেশের সরকারকে সমঝোতা করে চলতে হয়। পশ্চিমীদের চটিয়ে কেউ নিজের ক্ষমতাকে দুর্বল করতে চায় না। মিসর, তিউনিসিয়ার মতো দেশও এর বাইরে নয়। সবাই জানে সোচ্চার হলেই চাপ আসবে। বরং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ইসরায়েলের সাথে তাদের সমঝোতা জরুরি।একই কারণে ওআইসি বা আরব লীগও চুপচাপ থাকে। পাশাপাশি রাজতন্ত্রের বাইরে থাকা দেশগুলো- বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সোচ্চার হওয়ার মতো প্রভাবই নেই।
যদিও এ নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ শোনা যায় বিভিন্ন মহল থেকে। অনেকে মনে করেন ইসরায়েলকে ঘিরে আরব দেশগুলোতে চিন্তার ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন এসেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় থেকে। আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ট্রাম্পের ভূমিকা আর ওই অঞ্চলে ইরানের সাথে বিরোধিতার কারণেই অনেক আরব দেশ ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক তৈরির প্রক্রিয়ায় জড়িয়েছে। তবে সবমিলিয়ে এসব কিছুই মূলত ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম বিশ্বকে শক্ত অবস্থান নেয়ার ক্ষেত্রে দুর্বল করে রেখেছে।
আরব দেশগুলোতে রাজতন্ত্র বা একক শাসন থাকায় যেভাবে জনগণের মতামত উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন সেটি আবার বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে সম্ভব হবে না। তাই প্রভাব বিস্তারের মতো ক্ষমতা না থাকলেও এসব দেশকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে শক্ত ভাষাতেই কথা বলতে হয়।
ভূ-কৌশলগত স্বার্থ এবং আরব দেশগুলোর সংকট ছাড়াও ফিলিস্তিন সমস্যাটি সময়ের সাথে সাথে মিলিয়ে গিয়েছে। আরব জাতীয়তাবাদের মতো যে ধারণাগুলো একসময় মধ্যপ্রাচ্যের মানুষেরা হৃদয়কে ধারণ করতো, সেগুলো এখন অতীতের প্রতিধ্বনি মাত্র। এই অঞ্চলের বেশিরভাগ তরুণ প্রজন্ম ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল, কিন্তু তারা সংঘাতের কারণ এবং উৎস জানে না কারণ এই বিষয়গুলো আর স্কুলে পড়ানো হয় না৷আজ, বিশ্বায়নের সাথে সমাজ এমনকি পরিচয়ও বদলে গেছে। নতুন নেতাদের ক্ষেত্রেও তেমনই কিছু ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, উপসাগরীয় দেশগুলোতে, যেমন সৌদি আরবে মোহাম্মদ বিন সালমানের মতো নতুন প্রজন্মের নেতা এসেছেন, যারা বেশিরভাগই পশ্চিমে শিক্ষিত, যারা আরব নন এবং তাঁরা ফিলিস্তিনকে কোন সমস্যা হিসাবে দেখেন না।
গাজার চলমান ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছিল ২০২৩-এর ৭ই অক্টোবর। সেদিন ইসরায়েলে এক হামলাতেই ২৬০০ নিরীহ সাধারণ ইসরাইলীকে শেষ করে দিয়েছিল হামাস। আজ দেড় বছর পর গাজাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। এতে হামাসের মাস্টারমাইন্ডদের কিছুই হয়নি। তারা ফাইভ স্টার হোটেলে বসে ঠান্ডা পাণীয় হাতে গভীর পর্যবেক্ষণ করছে। গাজার এই হাল দেখে নিশ্চয় আরো বেশি ডলার আসবে। ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিন জুড়ে আওয়াজ উঠেছে হামাসের বিরুদ্ধে। ফিলিস্তিনরা যেদিন বুঝবে এই ডলার তাদের শিক্ষা চিকিৎসা কর্মসংস্থানের জন্য নয়, যুদ্ধের জন্য আসে, সেদিন তারা হামাসসহ জিহাদী দলগুলোকে পরিত্যাগ করবে। সেদিনই ফিলিস্তিনি সমস্যার পথ খুলে যাবে। ফিলিস্তিনে কিছু যুদ্ধবাজদের ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। ফিলিস্তিনিদের পকেটে পাথর নিয়ে না ঘুরে কাজে যোগ দিতে হবে। সমাধান এটাই। বিষয়টা সহজ মনে হলেও আদতে খুবই কঠিন। এই সমাধান ফিলিস্তিনিদের হাতে। তারা আর যুদ্ধের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হতে চাইবে কিনা সেটা তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ইসরায়েলের নিরলস বোমাবর্ষণের মুখে অবরুদ্ধ গাজার হতাশ ফিলিস্তিনিরা যখন আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করছে , তখন কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন কেন প্রতিবেশী মিশর এবং জর্ডান তাদের আশ্রয় দিচ্ছে না? দুটি দেশ, যারা ইসরায়েলের বিপরীত দিকে অবস্থান করছে এবং যথাক্রমে গাজা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরের সাথে সীমান্ত ভাগ করে নিয়েছে, তারা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিশ্বের পঞ্চাশটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের কেউ যখন ফিলিস্তিনের পক্ষে জোরালোভাবে দাঁড়ায়নি, অনেকেই বিস্মিত হচ্ছেন। অথচ ইতিহাস জানলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকত না।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। একটি মুসলিম দেশও বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ায়নি। তারা সবাই পাকিস্তানের পক্ষেই ছিল। আজ যেমন খলিফার ভান করা এরদোয়ান কিংবা সৌদি বাদশাহরা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, সেসময়ও তাঁরা নিঃসংকোচে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিলেন।
ফিলিস্তিনিদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হলো – তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কোনো অমুসলিম পরাশক্তিও নেই। সেদিন ভারত যেমন পাশে ছিল বাংলাদেশের। ফিলিস্তিনের পাশে আজকে বড় কোন “অমুসলিম রাষ্ট্র” থাকলে নিশ্চিত ফিলিস্তিনের শরণার্থীদের ঠাই সেখানে হতো। অন্তত ইতিহাস তাই বলে।