‘বহিরাগত’ শব্দটা সত্যিই বড় মজার বিশেষ করে আবার বিজেপির সংজ্ঞা অনুযায়ী। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মুখে ‘বহিরাগত’ শব্দটি উচ্চারিত হলে কারা কানে আঙুল দিয়ে ‘এক ভারত’-এর জয়গান গায়, তারাই আবার কী অনায়াসেই নিজেদের শাসিত হরিয়ানায় ‘এক ভারত’-কে ব্রাত্য করে রাজ্যের প্রাইভেট সেক্টরে ভূমিপুত্রদের জন্য পঁচাত্তর শতাংশ পদ সংরক্ষণ করে ! ধন্য বিজেপির ‘জাতীয়তাবাদ’! বাংলার বুকে গুজরাত, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ থেকে উড়ে আসা নেতারা বহিরাগত না হলেও, পূর্ব মেদিনীপুরে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু অবশ্যই ‘বহিরাগত’।
‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মধ্যে যাঁরা প্রাদেশিকতা’র উগ্র গন্ধ পেয়ে থাকে, তারাই আবার ‘গুজরাতি অস্মিতা’র নাকিকান্না কাঁদতে বিশেষ পারদর্শী। জনৈক নেতা দল বা সরকারের নীতি সিদ্ধান্ত আদর্শর প্রতিবাদ মানেই ‘গুজরাত আক্রান্ত’! জনৈক নেতা সমালােচিত হলেই কোণঠাসা হলেই ‘গুজরাতি অস্মিতা’র প্রসঙ্গ তুলে যাবতীয় ব্যর্থতা থেকে জনগণের দৃষ্টি বিভ্রম করতে চাওয়ার, গুজরাতি আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কি জঘন্য অপচেষ্টা!
যাদের মনন এবং রাজনীতি জুড়ে সর্বদা ‘ভূমিপুত্র / বহিরাগত’ ইস্যু খেলা করে, তারাও যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে ‘বহিরাগত’ শব্দটির উচ্চারণ শুনে কানে আঙুল দিয়ে ‘গেল গেল’ রব তােলে, তখন সত্যিই হাস্য সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অপরদিকে মমতা দেবীর উচ্চারিত ‘বহিরাগত’ শব্দটি সম্পূর্ণ যথার্থ ও নির্দোষ। হ্যা, ‘বহিরাগত’ শব্দটার মাধ্যমে বাংলায় ‘বাঙালি-অবাঙালি’ বিভেদমূলক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে না, শুধু বহির্বঙ্গ থেকে উড়ে এসে বাংলার চরিত্রহনন করে যাওয়া বিজেপির নেতাদের ‘বহিরাগত’ আখ্যায় ভূষিত করা হচ্ছে যা আভিধানিক অর্থে সম্পূর্ণ যথার্থ।
আর ‘বহিরাগত’ শব্দের মাধ্যমে বিজেপি ‘সংস্কৃতি’কেও বােঝানাে হয়েছে যা সনাতন বাঙালি সংস্কৃতি ঐতিহ্য সংবেদনশীলতার নিরিখে একেবারেই বেমান, যা বাংলার বুকে অনুপ্রবেশ বৈ কিছুই নয়। এটি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য যে ‘গােমাতা’ কেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িকতা তা রক্ষার নামে নিরীহ মানুষ খুন, ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তিবাদীদের হত্যালীলা, জঘন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মসজিদ ধ্বংস, গির্জা জ্বালানাে, দলিতদের উপর নৃশংসতা, ‘লাভ জিহাদ’-এর বিষ মন্থন বিজেপি শাসিত এবং প্রভাবিত রাজ্যগুলির একচেটিয়া।
লালন-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কাজী নজরুল ইসলামের ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক উত্তরাধিকার বহন করা পশ্চিমবঙ্গ এই নৈতিক দূষণ থেকে অনেকাংশেই মুক্ত থেকে সম্প্রীতির মরুদ্যান হিসাবে বিরাজ করছে। তাই এই পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপির সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক সাম্রাজ্যবাদী ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ নীতি রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দের উদার সেকুলার বাংলায় শুধু বহির্ভূত কেন, ভিনগ্রহী বললেও অত্যুক্তি হয় না। কখনও বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে পড়ছে, কখনও রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীতে ‘জন্মগ্রহণ’ করেছে, কখনও ধর্মনিরপেক্ষতার শেষ কথা বিবেকানন্দের ভূমিতে ‘হিন্দু রাজ’ কায়েমের হুমকি প্রদান করা হচ্ছে, অমর্ত্য সেন ‘জমিদখলকারী’র মর্যাদা পাচ্ছেন।
আর বাংলার ভাষা সংস্কৃতি আবেগ থেকে বিজেপি কত যােজন দূরে অবস্থান করে, তা তাে দিবালােকের মতাে প্রতিনিয়ত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিজেপি ‘সােনার বাংলা’ গড়ার এমনই স্বনিযুক্ত অভিভাবক যে বাঙালির ভােট চাওয়ার সময়েও বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রয়ােজন বােধ করে না। ভােটের বক্তৃতা থেকে আরম্ভ করে প্রার্থী তালিকার বিজ্ঞপ্তি, সম্পূর্ণ রাজনীতিটাই এদের বিহার উত্তরপ্রদেশের ভাষাময়। এইরূপ বাংলা-বাঙালি বিদ্বেষী রাজনৈতিক মানসিকতাকে বহিরাগত বলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পথ আছে কি?
প্রকৃতপক্ষে বাংলার নিরিখে তারাই ঘরের মানুষ যারা বাংলা ভাষা সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে সম্মান করে, শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে সে জন্মসূত্রে তিনি বঙ্গভাষী হােন বা নাই হােন। সে কারণেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে আরম্ভ করে ভি বালসারা, অমৃক সিং অরােরারা বাংলার বড়ই আপনজন। অপরপক্ষে যারা বাংলার বুকে গ্রাসাচ্ছাদন করে বাংলার ভাষা সংস্কৃতিকে ঘৃণা করে, বাংলার হিন্দিকরণে নিমজ্জিত থাকে, বাংলাকে নিশ্চিহ্ন করা হিন্দ সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন করে, ভিন রাজ্য থেকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আমদানি করে, গােবলয়ের উৎসব রামনবমী উদযাপনের নামে উগ্র হিন্দুত্বের পেশী প্রদর্শন করে দাঙ্গা হাঙ্গামায় নিমজ্জিত হয়, আগুন উদ্রেককারী রামরথ যাত্রা আর বাবরি ধ্বংসের সঙ্গে জড়িত বিভেদকামী ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান তুলে বাংলার পরিবেশকে কলুষিত করে, তারা বাঙালিই হােক বা অবাঙালি– বাংলার বুকে তারা অবশ্যই বহিরাগত।