তাইল্যান্ডে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিমস্টেক সম্মেলনে যোগাযোগকারী দুই প্রধান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বাংলাদেশের তদারকি সরকারের প্রধান মহম্মদ ইউনূস খানের মধ্যে শুধু শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। দুই প্রধানের মধ্যে বৈঠক হবে কি হবে না, তা নিয়ে দিল্লির সাউথ ব্লক এবং ঢাকার মধ্যে জল্পনা-কল্পনা ছিল বিস্তর। সম্মেলনের পর নৈশ ভোজেও দেখা গেল দুই প্রধানের পাশাপাশি বসা। শরীরী ভাষায় এটা বোঝা গেল কেউ কাউকে চেনেন না। তাঁদের পাশে বসা নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলিকে দেখা গেল এই দুই প্রধানের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে।
এই সম্মেলনে মোদী ও ইউনূস খানের মধ্যে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছিল ঢাকা। প্রধান উদ্দেশ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বন্দি বিনিময় চুক্তির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের হাতে ছেড়ে দেওয়া তাঁর বিচারের জন্য। শেষ পর্যন্ত এই দুই প্রধানের বৈঠক হল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী খান সাহেবকে বললেন, দুই দেশের মধ্যে যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে রয়েছে, তাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে এবং সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করতে। সেই সঙ্গে মোদী তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন বাংলাদেশে যে হিন্দু সংখ্যালঘুরা আছেন, তাঁদের নিরাপত্তা বিধান সরা। কারণ তাঁরা বাংলাদেশেরই নাগরিক। তাছাড়া তিনি বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে উন্নতি কামনা করেন।
ইউনূস খান প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা এখন নিরাপদ। তিনি জানালেন, তদারকি সরকারের আমলে বাংলাদেশের সংস্কারের কাজ পুরোদমে চলছে। গত জুলাই-আগস্ট মাসে যে গণ অভ্যুত্থান ঘটবে, তাতে দেশের বিস্তর ক্ষতি হয়েছিল। এখন সেই ক্ষতিপূরণের অর্থাৎ সংস্কারের কাজ চলছে। তারপর তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন ভারতে অবস্থানরত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঢাকার হাতে তুলে দিতে। কারণ হাসিনা ভারতে অবস্থান কালে যেসব বিবৃতি দিয়ে চলেছেন, তা বাংলাদেশের পক্ষে ক্ষতিকর। তিনি নানা উস্কানিমূলক বিবৃতি দিচ্ছেন, যা বাংলাদেশ মেনে নিতে পারছে না। তাই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হোক—আইনানুসারে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে তার বিচার হবে তাঁর অপরাধের জন্য। কিন্তু হাসিনাকে ভারত ছেড়ে দেবে কি দেবে না, তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কোনও মন্তব্য করেনি। সাউথ ব্লক মনে করে শেখ হাসিনা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন, সুতরাং তাঁর ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে যে বন্দিচুক্তি রয়েছে, তা খাটে না। হাসিনাকে ছেড়ে দিলে বাংলাদেশ সরকার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে জেলে পাঠাবে এবং বিচারের নামে প্রহসন সৃষ্টি করে তাঁর প্রাণনাশের কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ভারতও চায় তদারকি সরকার সংস্কার কাজের সঙ্গে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি শুরু করুক এবং বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিক। রাজনৈতিক মহল মনে করে বিমস্টেক সম্মেলনে দুই দেশের প্রধানের মধ্যে যে বৈঠক হল, তাতে ইতিবাচক কিছু পাওয়া গেল না। এদিকে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচনের দাবি জানিয়্ছে। কিন্তু ইউনূস খান বলেছেন, নির্বাচন করতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। কারণ বাংলাদেশে এখন যে অর্থনৈতিক দূরবস্থার মধ্যে চলছে, তার মধ্যে নির্বাচন করা আদৌ সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহল মনে করে প্রস্তাবিত নির্বাচনে আওয়ামি লিগকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হলেও এই দল যাতে আবার ক্ষমতা লাভ না করতে পারে, তার জন্য বিএনপি জামায়াত ইসলামি, মৌলবাদী এবং পাকিস্তানপন্থীরা সবরকম চেষ্টা করবে। তাছাড়া গণ অভ্যুত্থানের জন্য আওয়ামি লিগের নেতা-কর্মীদের হত্যা করা হয়েছে। যাঁরা এখনও বেঁচে আছেন, তাঁরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে বিএনপি যে ক্ষমতায় আসবে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
এদিকে পাকিস্তান ও চিন বাংলাদেশে তাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের জোট সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আসবেন এই মাসেই। তিনি সঙ্গে নিয়ে আসছেন একটি বাণিজ্যিক দল। পাকিস্তান বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সংস্কার ও উন্নয়নের কাজে কীভাবে সাহায্য করতে পারে, বাণিজ্যিক দলের সদস্যরা তা নিয়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনা করবে। এদিকে ইউনূস খান সম্প্রতি চিনে গিয়ে বেজিং সরকারের কাছ থেকে বিপুল অ্ঙ্কের টাকার ঋণ ও অনুদান নিয়ে দেশে ফিরেছেন সম্প্রতি। তার অর্থ বাংলাদেশকে ঋণের ফাঁদে জড়াচ্ছে চিন। পাকিস্তান ও চিন যেভাবে বাংলাদেশে তাদের আধিপত্য বিস্তার করছে, তাতে চরম অস্বস্তিতে রয়েছে ভারত সরকার। কারণ চিন ও পাকিস্তান যদি বাংলাদেশে এভাবে প্রভাব বিস্তার করেই চলে, তাহলে ভারতের কাছে তা বিশেষ উদ্বেগের কারণ হবে। বেজিং বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতি কল্পে সবরকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে।
অপরদিকে পাকিস্তানে আর্থিক অবস্থা খারাপ হলেও, বাংলাদেশকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পাকিস্তানের মন্ত্রী। উপপ্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিকও বাংলাদেশে এলে আশ্চর্যের কিছু থাকবে না।