আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণের পর খুন হওয়ার নারকীয় এবং পৈশাচিক ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের আমৃত্যু সাজার রায় ঘোষণা করলেন শিয়ালদহ দায়রা আদালতের মাননীয় বিচারক অনির্বাণ দাস। কী রায় হয়, তা নিয়ে রাজ্যের প্রতিটি মানুষ এবং বাইরের রাজ্যের তা জানার জন্য উদগ্রীব ছিল। মহামান্য হাইকোর্ট এই কেসের তদন্তভার তুলে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইয়ের ওপর। দীর্ঘ তিনমাস ধরে তদন্ত করে সিবিআই চার্জশিট জমা দিয়েছিল। এবং ৫১ জন সাক্ষীর এই ঘটনা নিয়ে বয়ান রেকর্ড করে। কেন্দ্রীয় সংস্থার দেওয়া তথ্যপ্রমাণ ভিত্তির ওপর বিচারক সঞ্জয় রায়কে দোষী সাব্যস্ত করে এই আমৃত্যু কারাবাসের আদেশ দিলেন। তিনি সেই সঙ্গে জানালেন, এই ঘটনা বিরলের মধ্যে বিরলতম নয় এবং আসামি অতীতে কোনও অপরাধ করেছে বলে তার কোনও রেকর্ড নেই— যা রায়কে অনেকটাই প্রভাবিত করেছে। সেই সঙ্গে বিচারক ১৭ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণে মৃতের পরিবারকে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে সরকারকে— যেহেতু চিকিৎসককে কর্তব্যরত অবস্থায় ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছে। যদিও মৃত চিকিৎসকের মা-বাবা এই ক্ষতিপূরণ চাননি। বিচারক আইন মেনে তা করেছেন।
মহামান্য বিচারক তাঁর রায় দিলেন বটে, কিন্তু এই রায়ে খুশি হতে পারলেন না মৃতের মা-বাবা, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জুনিয়র চিকিৎসক অন্যান্য মন্ত্রী এবং বিশিষ্টজনেরা তাঁরা দাবি করেছিলেন সঞ্জয় রায় যে অপরাধে অপরাধী, তার জন্য তার মৃত্যুদণ্ড তথা ফাঁসির রায় দেবে আদালত। তা হল না। মুখ্যমন্ত্রী এই রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে ঘোষণা করলেন এই অপরাধীর ফাঁসির দাবি জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে যাওয়া হবে। সরকারের হাতে কেসটি থাকলে, সঞ্জয় রায়ের ফাঁসিই হত। জুনিয়র চিকিৎসকরা বলেছেন, এই চিকিৎসকের ওপর পাশবিক অত্যাচার সঞ্জয় রায় একা করেনি বা করতে পারে না। কিন্তু তার সহযোগী যারা ছিল এই হত্যা এবং তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার কাজে তাদের কাউকেই খুঁজে পেল না সিবিআই। চিকিৎসকের মা-বাবাও বলেছেন, এই অপরাধীর সঙ্গে আরও যারা যুক্ত ছিল তারা যত বড় মাপেই হোক, তাদেরও খুঁজে বের করে তাদের শাস্তি দিতে হবে। তাদের অভিযোগ, একটা বড় যড়যন্ত্র এই ঘটনার পিছনে কাজ করছে, কিন্তু বড় আশ্চর্যের ব্যাপার যে, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সঞ্জয় ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পেল না। বিশিষ্ট চিকিৎসকরাও বলেছেন, এই পৈশাচিক কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আরও কয়েকজন বড় বড় মাথা, তাদের কেন সিবিআই খুঁজে পেল না— তাও একটি বিরাট রহস্য। তাদের দাবি এই রহস্যের উন্মোচন করতে হবে।
রহস্য তো বটেই। ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কলকাতা পুলিশ মূল অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে গ্রেপ্তার করে এবং সে অপরাধ স্বীকারও করেছে। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন ফার্স্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচার হবে এবং অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড হবে। কারণ এই জঘনতম অপরাধের জন্য আসামির মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কোনও শাস্তি হতে পারে না। কিন্তু বিচারের ভার চলে গেল সিবিআইয়ের ওপর। ওই সংস্থা ৯০ দিন পর চার্জশিট জমা দিল। যদিও বলা হয়েছে তদন্তের কাজ এখনও শেষ হয়নি, হয়তো আরও একটি সাপ্লিমেন্টারি সার্জশিট পেশ করতে পারে সিবিআই, তাতে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য অপরাধীর নামও থাকতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
এই চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় উত্তাল হয়েছিল সারা রাজ্য। জুনিয়র চিকিৎসক এবং অন্যান্য সংগঠন ‘জাস্টিস ফর আরজি কর’— এই দাবি নিয়ে যে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন, তা ইতিহাসে লেখা থাকবে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, অন্যান্য রাজ্যের জুনিয়র চিকিৎসকরাও পথে নেমেছিলেন চিকিৎসকদের এই আন্দোলনের সমর্থনে। বিদেশেও এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে আলোচিত হয়েছে এবং কঠোরতম শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। কলকাতা শহর চিকিৎসকদের এই আন্দোলনে মুখরিত থাকত প্রায় প্রতিদিন। সমাজের সমস্ত শ্রেণির মানুষ, বিশিষ্ট নাগরিক, বিনোদন জগতের শিল্পী ও কলাকুশলী, কবি-সাহিত্যিকরা জুনিয়র চিকিৎসকদের দাবির সমর্থনে পথে নেমেছিলেন। কলকাতার শহরের মহিলারা মোমবাতি জ্বালিয়ে মিছিল করা ছাড়াও, এক রাত জেগেছিলেন আন্দোলনের সমর্থনে। ক্রীড়া জগতের মানুষ এবং কলকাতার তিনটি খ্যাতনামা ক্লাব মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল এবং মহমেডানের সমর্থকরাও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে পায়ে পায়ে হেঁটেছিলেন— দাবি— ‘জাস্টিস ফর আরজি কর।’ তিলোত্তমা এই ধরনের ব্যাপক আন্দোলন সম্প্রতিক কালে দেখেনি।
এত ব্যাপক আন্দোলনেও যখন সারা মিলল না প্রশাসনের, তখন জুনিয়র চিকিৎসকরা তাদের দাবির সমর্থনে আমরণ অনশনে শামিল হলেন। বেশ কয়েকদিন চলার পর, অনশনকারী চিকিৎসকদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা খারাপ হল— প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন যে ভূমিকা পালন করেছিলেন জুনিয়র চিকিৎসকদের অনশন তুলে নিতে, তা প্রশংসনীয়। তিনি মৃতের মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে তাঁদের সান্ত্বনা, সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি দোষীদের কঠোরতম শাস্তির আশ্বাস দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনার পর তাঁদের মুল দাবিগুলির বেশির ভাগই মেনে নিলেন এবং সেই মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করার আশ্বাস দিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় খুশি হয়ে চিকিৎকরা অনশন আন্দোলন তুলে নিয়ে কাজে যোগ দিলেন। কিন্তু তাঁরা ঘোষণা করলেন যে পর্যন্ত না তাঁদের দাবি বাস্তবায়িত হবে— তাদের আন্দোলন বলবে। সরকার তাঁদের দাবি মেনে নিয়ে তা কার্যকরও করল। যদিও চিকিৎকেরাও পুরোপুরি খুশি হলেন না। তাঁদের দাবি, এই খুনের সঙ্গে অধরা যাঁরা, তাঁদের ধরতে হবে। এবার সিবিআই যার হাতে তদন্তভার, তদন্ত এত ধীর লয়ে চলল যে, চিকিৎসা এই সংস্থার গয়ংগচ্ছ ভাব দেখে সমালোচনায় বিদ্ধ করলেন। পুরো ৯0 দিন পর সিবিআই চার্জশিট জমা দিল। তা পরের ঘটনা সঞ্জয় রায়ের আমৃত্যু সাজার ঘোষণা আদালতের। বিচারের বাণী শুনে খুশি হল না কেউ।