বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ঢাকার রমনা ময়দানে বিশাল সমাবেশে তাঁর সেই সাড়া জাগানো বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘এই বাংলায় হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর মানুষজন বাস করে, তাঁদের রক্ষা করা তোমাদের কর্তব্য— দেখবে যাতে আমাদের বদনাম না হয়।’ আজ তার স্বাধীন বাংলাদেশে শুধু হিন্দু নয়, বৌদ্ধ নয়, অন্যান্য বিভিন্ন ধর্মের মানুষের জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছে। তাঁদের ওপর অকথ্য অত্যাচার পীড়ন হচ্ছে।
ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, সম্পত্তি ধ্বংস হচ্ছে— তাঁদের অনেককে খুন করে রক্তের বন্যা বইয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন মুজিবুর রহমানের সেই নির্দেশ বেমালুম ভুলে গিয়ে তাঁর অসংখ্য মর্মর মূর্ত্তি সারা বাংলাদেশে ভেঙে ফেলা হয়েছে। ইসকনের সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর গ্রেপ্তারের পর বাংলাদেশ এখন অগ্নিগর্ভ। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ, তিনি নাকি বাংলাদেশকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর আশু মুক্তির দাবি জানিয়ে, ওই বাংলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ পথে নেমেছে। তার আঁচ এই বাংলাতেও— প্রকৃতপক্ষে ভারত সহ বিশ্বের অনেক দেশ ব্রিটেন, আমেরিকা বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনাবলীর নিন্দা করে আটক সন্ন্যাসীর মুক্তির দাবি জানিয়েছে। মুক্তির দাবি জানিয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও, যিনি এখন ভারতে আছেন। যদিও তাঁর আমলেও সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার হয়েছে।
শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত মহম্মদ ইউনূস খান, যিনি এখন তদারকি সরকারের প্রধান, সম্পূর্ণ ব্যর্থ বাংলাদেশে শান্তিশৃঙ্খলা আনতে। ব্যর্থ হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের ওপর লাগাতার অত্যাচার ও পীড়ন বন্ধ করতে। সন্ন্যাসীর মুক্তির দাবিতে কলকাতা উত্তাল। বিভিন্ন সংগঠনের তর্ফে মিছিল বের করে কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভে সামিল হচ্ছে। তাদের দাবি অবিলম্বে চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের নিঃশর্ত মুক্তি এবং হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর অত্যাচার বন্ধ করা। প্রতিদিন বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও ইসকনের মন্দির এবং কালী মন্দির ভাঙার ঘটনা ঘটছে। তাঁর সরকার বাংলাদেশের বর্তমান তদারকি সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছে অবিলম্বে বন্দি সন্ন্যাসীর মুক্তি সহ হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার বন্ধ করতে।
তার উত্তরে ঢাকার শালিনতাবিহীন জবান, ‘ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর অত্যাচরের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। তা নিয়ে ভারত সরকারের কোনও লজ্জাবোধ নেই। উল্টে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে অযাচিত পরামর্শ দিচ্ছে। ভারতের এই দ্বিচারিতা অত্যন্ত নিন্দনীয়।’ সুতরাং ঢাকার এই বিবৃতি মনে করাচ্ছে মহম্মদ ইউনূস সরকার কট্টর মৌলবাদীদের এবং পাকিস্তানপন্থীদের চাপের ফলে বাধ্য হয়ে এই বিরতি। ভারত সরকারের সাউথ ব্লক একবার নয়, অন্তত তিনবার ঢাকাকে সতর্ক করেছে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ বন্ধ করতে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যদি তা না শোনে, তা হলে তার ফল হবে ভয়ানক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশে যা ঘটছে, তার নিন্দা করছে— কিন্তু ঢাকার তাতে কী আসে যায়?
আসলে রাজনীতির বাস্তুকাররা যে যা বলুক না কেন, বাংলাদেশ এখন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে থাকতে চায় না। কারণ কট্টর মৌলবাদীরা এবং পাকিস্তানীরা চায় বাংলাদেশ হবে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র, যেখানে ইসলাম ধর্মের অনুশাসন মেনেই দেশ চলবে। বাংলাদেশের সংবিধানও সংশোধিত হচ্ছে মৌলবাদীদের কতা মতো— অর্থাৎ তারা যা চায়, সেই মতো। আর নোবেলজয়ী ইউনূস এই মৌলবাদীদের হাতের পুতুল। তাঁর নিরপেক্ষ কোনও ভূমিকা আছে বলে মনে হয় না। যদি সত্যিই বাংলাদেশ একটি ইসলামিক রাষ্ট্র হয়, তাহলে এখনও সব সম্প্রদায়ের মানুষ মিলে প্রায় ২ কোটি সংখ্যালঘু রয়েছে এই দেশে। তাদের কী হবে? অর্থাৎ ইসলামি রাষ্ট্রে অন্য ধর্মাবলম্বীদের কোনও অধিকার রক্ষিত হবে না। ইউনূস খানের অতীত দেখলে বোঝা যায়, তিনি কোনও পদে থাকলে, সেই পদ আঁকড়ে ধরে দীর্ঘদিন থাকতে চান। সুতরাং বাংলাদেশে আশু নির্বাচন হলে, তদারকি সরকার থাকবে না, তা এই খান সাহেব চান না। সুতরাং এই তদারকি সরকার যতদিন থাকবে, হিন্দুদের ওপর অত্যাচার চলতেই থাকবে। কট্টর মৌলবাদীরা যে নির্দেশ দিচ্ছে, সেই মতো তদারকি সরকার চলবে।
দিল্লি ইউনূস খানের সরকারকে সতর্ক করেছে বটে, তবে সেই সঙ্গে এটাও বলা হয়েছে, দুই দেশের মধ্যে ব্যবসাবাণিজ্য এবং পণ্য রপ্তানি যেভাবে চলছিল, সেইভাবেই চলবে। বাংলাদেশ আর্থিকভাবে ভারতের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। রাজনৈতিক মহল মনে করে, ইউনূস খানের সরকার হিন্দুদের ওপর যে লাগাতার অত্যাচার চলছে, তা বন্ধ করতে পারছে না— কারণ এই সরকার কট্টর মৌলবাদীদের কথায় উঠছে বসছে। মৌলবপাদীরা আর বিএনপির সমর্থকরা মন্দির, ইসকনের উপাসনাগার ভাঙছে। এই অবস্থায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সুসম্পর্ক এবং মৈত্রীর বন্ধন বিঘ্নিত করছে, তা কতদিন স্থায়ী হবে তা বলা কঠিন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে এখনও মুখ খোলেননি।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, তাঁরা বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। তবে এখন যা চলছে ওই বাংলায়, তা নিন্দনীয়। এ ব্যাপারে ভারত সরকার যে অবস্থান নেয়, তার সঙ্গে তাঁরা সহমত। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশের ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাজ্যসভায় বলেছেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলী তাঁদের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। অবিলম্বে সেখানে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ বন্ধ হোক।