স্বপনকুমার মণ্ডল
ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক জীবনানন্দ দাশের কবিতায় শুধু নয়, তাঁর কবিমনস্কতাতেও পাশ্চাত্য কবিদের প্রভাব নানাভাবে বিকশিত হয়েছে। রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কবিতায় অভিমুখই যেখানে পাশ্চাত্যমুখী, সেখানে তাঁর কবিসত্তায় স্বাভাবিক ভাবেই পাশ্চাত্যের ছায়া কায়া বিস্তারের সম্ভাবনা ছিল। অথচ সেই ছায়ার মায়া অচিরেই তিনি কাটিয়ে উঠেছিলেন। সেদিক থেকে রবীন্দ্রবৃত্ত থেকেই নয়, পাশ্চাত্যের ভাবাদর্শ থেকেও তাঁর প্রভাবমুক্তি ছিল সময়ের অপেক্ষামাত্র। আধুনিক কবি হিসাবে তাঁর মৌলিক কবিসত্তার স্বতন্ত্র আভিজাত্যের মূলেই ছিল মুক্তির স্বকীয় আকাশ। সেখানে গ্রহণের ফের আছে, আছে মুক্তির অন্তর্লীন আলোও। এজন্য পাশ্চাত্য সমকালীন কবিদের প্রভাব এড়িয়েও জীবনানন্দ দাশের অভিযাত্রা এগিয়ে চলেছিল। পাশ্চাত্য প্রভাব এলেও তা তাঁর অগ্রে সক্রিয় হয়ে হাঁটেনি, বরং পশ্চাতে সরে পড়েছে। টি এস এলিয়টের ইতিহাসচেতনা তাঁর কবিসত্তায় নিবিড়তা লাভ করেছে। সেখানে অসীম অতীতচারিতার সঙ্গে সমকালীনতার সমন্বয়ে গড়ে তোলা ঐতিহ্য নিবিড়তা লাভ করে। এলিয়ট তাঁর ‘Tradition and Individual Talent’(১৯১৯) প্রবন্ধে জানিয়েছেন : ‘The historical sense which is a sense of timeless as well as the temporal and of the timeless and of the temporal together, is what makes a writer a writer tradition.’ অন্যদিকে জীবনানন্দ তাঁর ‘কবিতার কথা’য় বলেছেন, ‘কবির পক্ষে সমাজককে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।’ সেই চেতনা ও জ্ঞানে বর্তমান জগতের মূল্যবোধের মধ্যেই সমগ্র বিশ্ব ও তার কালপ্রবাহ বর্তমান। এজন্য জীবনানন্দের কবিসত্তায় বর্তমানের অস্তিত্বে অতীতের ঐতিহ্য ও আভিজাত্যবোধ বারেবারে ফিরে এসেছে। অস্তিত্বের সোপানে কবিমানসের ইতিহাসযাপন স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। উর, ব্যাবিলন, নিনেভে, মিশর, পেগান গ্রীস, কনফুসিয়াসের চীন থেকে বিদিশা, উজ্জয়িনী বা ধর্মাশোকের ভারতবর্ষ প্রভৃতি স্থানে তাঁর অবাধ বিচরণ। অবশ্য জীবনানন্দ দাশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যচেতনায় মধ্যে সত্তার শূন্যতাবোধে স্মৃতির আশ্রয় নয়, বরং স্মৃতির মধ্যে সত্তাকে খুঁজে পাওয়ার চেতনা বিস্তার লাভ করে। তাঁর কবিসত্তায় ‘exile, anguish, ignominy & misery’ অর্থাৎ নির্বাসন, যন্ত্রণা, অপমান ও দারিদ্রের আধুনিক বস্তুবিশ্ব থেকে মুক্তির দিশায় স্বকীয় মানসের সেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আকাশ গড়ে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সেখানে ‘বনলতা সেন’-এর ‘হাজার বছর ধরে আমি হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’ র বিস্তার থেকে ‘রূপসী বাংলা’র ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়’-এর প্রত্যাশা সবই আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে এজরা পাউন্ড ও এলিয়টের চিত্রকল্প (যেমন,বিষন্নতার চিত্রকল্পে ‘হেমন্তের হিম ঘাস, প্রেতচাঁদ, মরা নদী, শীতের কুয়াশা, শূন্য মাঠ প্রভৃতি) ও ডব্লিউ বি ইয়েটসের স্বপ্নচিত্রের (যেমন, মুখোশপরা ভাঁড়, ক্লাউনের মেলা বা লুপ্ত বিড়ালের শূন্য হাসি প্রভৃতি) ব্যবহারও জীবনানন্দের কবিতায় মধ্যে প্রতীয়মান। অবশ্য ইয়েটসের বার্ধক্যের বিকারে দুঃস্বপ্নের মতো জীবনবিমুখ চেতনা জীবনানন্দে ছিল না। হতাশার মধ্যেও তাঁর জীবনের আরতি বন্ধ হয়ে যায়নি। এজন্য ‘আট বছর আগের একদিন কবিতা’য় শেষে সেই জীবনাসক্তি জেগে ওঠে : ‘হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার ? / আমিও তোমার মতো বুড়ো হব—বুড়ি চাঁদটারে আমি ক’রে দেবো / কালিদহে বেনোজলে পার; / আমরা দু-জনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।’ আসলে জীবনানন্দের কবিতায় পাশ্চাত্য প্রভাব কিছুমাত্র ছায়া পড়লেও তার কায়া কবি জীবনানন্দের স্বকীয়। ‘বনলতা সেন’ কবিতায় এডগার এলান পো’র ‘হেলেনের প্রতি’ কবিতাটির চিত্রকল্পের আদলটি উঠে এসেছে। জীবনানন্দের ‘চুল তার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য’ই পো’র কবিতাটিতে পাওয়া যায়, ‘The hyacinth hair, the classic face’রূপে।
‘শ্রাবন্তী’-‘বিদিশা’ও গ্রীস ও রোমের স্মৃতিতে প্রতিরূপ লাভ করেছে, ‘To the glory that was Greece! And the grandeur that was Rome!’। অথচ সে-সব চিত্রকল্পের প্রতিরূপ লক্ষ করা গেলেও, তা যে তার অনুরূপ নয়, জীবনানন্দের চিত্রকল্পেই প্রতীয়মান। অনুকরণ বা অনুসরণ নয়, বরং স্বকীয় কবিসত্তাতেই তাঁর স্বতন্ত্র আভিজাত্য। সনেটের ক্ষেত্রেও তাঁর নিজস্ব কবিসত্তা প্রবহমান। শেকসপিয়রীয় (স্তবক ৮+৬=১৪, অন্তমিল কখখককখখক+ চছজচছজ), পেত্রাকীয় (৪+৪+৪+২, কখকখ + গঘগঘ + পফপফ + চচ) বা ফরাসীয় (৮+২+৪) সনেটের কোনো নির্দিষ্ট ছক জীবনানন্দে নেই। তাঁর জীবিতকালে প্রকাশিত গ্রন্থে সনেটে ‘শকুন’ (‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’) ও ‘পথহাঁটা’(‘বনলতা সেন’) দুটিই তিন চরণের স্তবক (৩+৩+৩+২)। দুটিরই মাত্রা সংখ্যা ২৬(৮+৮+১০)। আবার ‘রূপসী বাংলা’র সনেটগুলোয় ২২ থেকে ২৬ মাত্রা লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে তাঁর সনেটগুলোর শিল্পরূপ প্রচ্ছন্ন থেকে কবিতার কাব্যগুণকেই পরিস্ফুট করেছে। সেদিক থেকে বলা যায়, পাশ্চাত্যের ছায়াতেও কবি জীবনানন্দের আলো স্বমহিমায় ভাস্বর।
অন্যদিকে রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কবিকণ্ঠ হিসাবে জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে মতানৈক্য নেই। তাঁর কাব্য-কবিতার বিষয় ও আঙ্গিক, ভাষা-শৈলি বা প্রকাশের অভিজাত স্বাত্নত্র্যেই তা প্রতীয়মান। কবি জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর কবিতা বোঝার জন্য কতকগুলি মতবাদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা প্রয়োজন। সেগুলি হল, ‘ইম্প্রেশনিজম’(Impressionism), ‘ফবিজম’ (Fauvism), ফিউচারিজম’(Futurism), ‘কিউবিজম’ (Cubism), ‘এক্সপ্রেসিজম’ (Expressionism), ‘সুরিয়ালিজম’ (Surrealism) প্রভৃতি মতবাদ প্রথমে শিল্পে এবং পরে সাহিত্যে প্রভাব বিস্তার করেছে। অধিকাংশ মতবাদই ফ্রান্সে গড়ে উঠেছে। কোনোটি রঙের, কোনোটি আকার-আকৃতির।
আবার কোনোটি প্রকাশের প্রকৃতিতে স্বতন্ত্র। ‘ইম্প্রেশনিজম’ আলো-ছায়ার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কোনো দৃশ্য দেখার পর মনের আয়নায় যে ছাপ পড়ে শিল্প-সাহিত্যে আলো-ছায়ায় সজীবতা লাভ করে, তাই ইম্প্রেশনিজম-এর প্রভাব। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নানাভাবে তার প্রকাশ ঘটেছে। অন্যদিকে ইম্প্রেশনিজমের বিরুদ্ধে মূলত চারটি মতবাদ গড়ে ওঠে। ফবিজমের ফব মানে বন্যজন্তু। ১৯০৫-এ এই মতবাদটি গড়ে ওঠে ফ্রান্সে। লুই ভক্সেলেস কথাটি প্রথম চালু করেন। ১৯০৬-এ নিউ ইম্প্রেশনিস্টিক আর্টের বিরুদ্ধে একদল শিল্পী বিদ্রোহ করে চড়া রঙে ও রেখায় প্রাকৃতিক পটভূমিকে নতুন করে তুলে ধরার আন্দোলনে ফবিজম মূর্ত হয়ে ওঠে। চিত্রশিল্পী মাতিসের ছবিতে তার পরিচয় পরিস্ফুট হয়। গাড় টকটকে রঙের ব্যবহারই সেখানে প্রাধান্য পায়। রঙই তার প্রাণ-গতি ও নাটকীয়তার প্রকাশ। চিত্রধর্মিতাই তার বিশেষত্ব। জীবনানন্দ দাশের কবিতাতেও তা লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে ১৯০৯-এ ইতালিতে গড়ে ওঠা ফিউচারিজমে গতি, ১৯০৭-১৪-তে রাশিয়ায় গড়ে ওঠা কিউবিজমে গঠনে (চিত্রশিল্পী সেজানের স্থাপত্যসুলভ ঘনত্ব প্রকাশে আঁকা ছবিতে তার পরিচয় প্রথম।) এবং ১৯১২-১৩তে গড়ে ওঠা এক্সপ্রেসিনিজমে বিকার প্রাধান্য লাভ করে। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় কিউজিজম বাদে অন্যগুলি অল্পবিস্তর প্রাধান্য লাভ করে। অন্যদিকে তাঁকে কবিতায় ইম্প্রেশনিস্ট কবির পরিচয় সমধিক। জীবনানন্দ দাশের তার পরিচয় নানাভাবে উঠে এসেছে। তাঁর অসংলগ্ন এবং ছিন্নবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশিত বিভ্রান্তিকর কবিতায় ইম্প্রেশনিজমের প্রভাব বর্তমান। এছাড়া তাঁর কবিতায় সুদূর প্রসারিত কবিদৃষ্টির বিস্তার, রঙে রূপান্তরিত চিত্রে সময়ের চলমানতা থেকে দেশজ ও গদ্যগন্ধী শব্দের নিরঙ্কুশ ব্যবহার, আলো-অন্ধকারের রূঢ় বৈপরীত্য, আঙ্গিকের ধ্রুপদী শিল্পীদের সুস্পষ্ট ও সুশৃঙ্খল শৈলীর অনুকরণহীনতা প্রভৃতির মাধ্যমে তার পরিচয় লক্ষণীয়।
পাশ্চাত্য মতবাদগুলি নানাভাবে জীবনানন্দের কবিপ্রকৃতির মধ্যে সবুজ হয়ে উঠেছে। ফবিজম তাঁর কবিতায় নানা রঙে প্রস্ফুটিত। চিল হয়ে ওঠে ‘সোনালি ডানার চিল’, রৌদ্র হয় ‘রক্তাভ রৌদ্র’। এসবই ফবিজমের রখের বহুমাত্রিক খেলা। বর্ণবাহারি প্রকৃতি তার মজ্জায়, তার সজ্জায়। জীবনানন্দের কবিতাতেও তা সুলভ। যেমন, ‘বনলতা সেন’ কাব্যের ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতায় উঠে এসে সেই বর্ণাঢ্যতা : ‘রামধনু রঙের কাচের জানালা, / ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায় /………/ পর্দায় গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ/ রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ।’ এরকম ফবিজমের নিদর্শন জীবনানন্দের কবিতায় নানাভাবে উঠে এসেছে। ‘বনলতা সেন’ কাব্যের ‘বনলতা সেন’ কবিতায়, ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’, ‘অন্ধকার’-এ ‘নীল কস্তুরী আভার চাঁদ’, ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যের ‘বিড়াল’ কবিতায় ‘জাফরান-রঙের সূর্য’, ‘শিকার’ কবিতায় ‘টিয়ার পালকের মতো সবুজ’, ‘মোরগফুলের মতো লাল’ বা ‘নদীর জল মচকাফুলের পাপড়ির মতো লাল’, ‘হাওয়ার রাত’-এ ‘চিতার উজ্জ্বল’, ‘আমি যদি হতাম’-এ ‘সোনার ডিমের মতো/ ফাল্গুনের চাঁদ’, ‘সিন্ধুসারস’ কবিতায় ‘হেলিওট্রোপের মত দুপুর’ প্রভৃতিতে তার পরিচয় সমুজ্বল। অন্যদিকে একই রঙকে জীবনানন্দ ফবিস্টদের মতো নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন। যেমন, শাদা রঙের প্রতি কবির তীব্র প্রকাশ নানা ভাবে উঠে এসেছে। ‘বনলতা সেন’-এর ‘সবিতা’ কবিতায়, ‘দুধের মতন শাদা নারী’, ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যের ‘হাওয়ার রাত’-এ ‘স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মতো / উড়ছে সে’, ‘সিন্ধুসারস’ কবিতায়, ‘জানি পাখি, শাদা পাখি, মালাবার ফেনার সন্তান’, ‘পরিচায়ক’ কবিতায়, ‘বরফের মতো শাদা ঘোড়াদের তরে’ প্রভৃতি।
অন্যদিকে ফিউচারিজমের সঙ্গেও ফবিজমের অপূর্ব মেলবন্ধনও জীবনানন্দ দাশের কবিতায় মেলে। ‘সিন্ধুসারস’ কবিতাই তার পরিচয়। আসলে ফিউচারিস্টদের চেতনাতেই রঙের বহুরূপী বিস্তার বর্তমান। স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে ফবিজমও এসে পড়ে। রঙের তারতম্যে সময়ের প্রতিফলন ঘটে। চলমান দৃশ্যে রঙের রূপান্তর ঘটে। ভোরে উদিত সূর্য থেকে বিকেলে অস্তগামী সূর্যের রঙেই তা সহজবোধ্য হয়ে ওঠে। সেখানে রঙের তারতম্যে গতির পরিচয় নিবিড়তা লাভ করে। আসলে ফিউচারিস্টদের গতির প্রাধান্যে Motion, Speed আপনাতেই সক্রিয় হওয়ায় তাতে রঙের রূপান্তর স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ান্তরে রঙের রূপও বদলে যায়। ইম্পেশনিজমেও তা লক্ষণীয়। সেখানে ভাবের প্রকাশে আলোআঁধারি রূপবৈচিত্র উঠে আসে। সকাল দুপুরে গড়িয়ে যায়, দুপুর বিকেল হয়ে ওঠে। সেখানে অবশ্য স্মৃতি-সত্তার বিষয়টি প্রাধান্য লাভ করে। অন্যদিকে ফিউচারিস্টদের সময়ের নানামাত্রিক রঙের দীপ্তি নানাভাবে প্রকট হয়ে ওঠে। সেখানে Age of speedকে প্রকাশই লক্ষ্য। ফিউচারিস্টদের দার্শনিক ভিত্তি বের্গসঁ’র গতিবাদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। চলমান জীবনের প্রতিচ্ছবি সেখানে মূর্ত হয়ে ওঠে। জীবনানন্দ দাশেও তা লক্ষণীয়। রোমাণ্টিক কবি না হয়েও তাঁর কবিতায় ফিউচারিজমের প্রভাব পড়েছে। ‘বনলতা সেন’ কাব্যের ‘বুনো হাঁস’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’র ছায়া নবরূপ লাভ করেছে : ‘বুনো হাঁস পাখা মেলে— শাঁই শাঁই শব্দ শুনি তার,/ এক-দুই-তিন-চার-অজস্র-অপার-’। আবার ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যের ‘হাওয়ার রাত’ কবিতায় মশারির উড়ন্ত চিত্রে অভিনব চিত্রকল্প রচিত হয়েছে : ‘এক একবার মনে হচ্ছিল আমার— আধো ঘুমের ভিতরে হয়তো–/মাথার উপরে মশারি নেই আমার/ স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মতো উড়ছে সে।’ অন্যদিকে ফিউচারিস্টদের যুগজ্বরও জীবনানন্দে প্রতিফলিত। সেদিক থেকে সময়ের গতিতে যেমন age of speed and steel, তেমনই age of feverও উঠে আসে। গতির বাঁধনহারা প্রকৃতি যেমন যেমন মানুষকে উদ্দীপ্ত করে, তেমনই ক্লান্ত করেও দেয়।
অভিজ্ঞতাভারাক্রান্ত কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুচেতনার মধ্য তার বহুমাত্রিক পরিচয় উঠে এসেছে। কখনও তা শঙ্খচিল শালিকের জন্ম চেয়েছেন, কখনও মেঠো ইঁদুরের মতো মৃত্যুকে দেখেছেন, কখনও আবার কমলালেবুর মধ্যে পুনর্জন্ম খুঁজে ফিরেছেন। এজন্য পার্থিব চেতনায় মুগ্ধতাবোধের তীব্রতায় যেমন জন্মভূমির প্রতি তাঁর শ্রেয়বোধের পরাকাষ্ঠা লক্ষ করা যায় (‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের ‘বাংলার মুখ দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’), তেমনই পরজন্মে ফিরে আসার চেতনাও বিস্তার লাভ করে (‘রূপসী বাংলা’র ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়’)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঔপনিষদিক মৃত্যুচেতনা তথা মৃত্যের মাধ্যমে নবজন্ম লাভের চেতনা জীবনানন্দের ছিল না।
জার্মানের এক্সপ্রেসনিজমের প্রভাবও জীবনানন্দের কবিতায় প্রতীয়মান। তাঁর বিখ্যাত কবি ‘আট বছর আগের একদিন’-এ তা স্পষ্ট। অসুস্থ মানসিকতা, বিকৃত পরিসর, বিশৃঙ্খল প্রকৃতি প্রভৃতির অস্বাভাবিক প্রকাশই এক্সপ্রেসনিজমের লক্ষ্য হয়ে ওঠে। স্বাভাবিক ভাবেই তাতে খরা-বন্যা, ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রভৃতির মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে বিপর্যস্ত পৃথিবীর রূপকে তুলে ধরার মাধ্যমে দৃশ্যমান জগতের অস্বাভাবিক রূপকে মূর্ত করে তোলার প্রয়াস সেখানে নিবিড় হয়ে ওঠে। কেননা এই মতবাদে জীবনের কোনো স্বাভাবিক সমাধান নেই। ক্যারিকেচার বা স্থূল রূপের পরিচয়ে তার ভাষাতেও রহস্যময়তা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। দার্শনিক বেনোদাত্ত ক্রোচের সত্যের চেতনায় মতবাদটি দার্শনিক ভিত্তি। সত্যের আধার প্রজ্ঞা(intuition)। আর প্রজ্ঞাই প্রকাশ বা এক্সপ্রেশন। ভ্যানগগের ছবিতে আকৃতি ও বর্ণের বিকৃতিতে তার প্রকাশ লক্ষণীয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জার্মানে মতবাদটি আন্দোলিত হলেও এর সূচনা হয়েছিল ফ্রান্সে, চিত্রকর হার্ভের মাধ্যমে ১৯০১-এ। ১৯২৪ পর্যন্ত মতবাদটি সচল ছিল। বাংলায় একে প্রকাশবাদ বা অভিব্যক্তিবাদ বলা হয়। বাইরের কৃত্রিম প্রকাশের বিপ্রতীপে অন্তরের স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের প্রকাশে মতবাদটি স্বাভাবিক ভাবেই সক্রিয়তা লাভ করে। সেদিক থেকে এক্সপ্রেশনিস্টদের প্রকাশের মধ্যে স্বেচ্ছাচারী, বিস্ফোরকধর্মী, বিশৃখলাপরায়ণ ও গতিশীলতাই কবিতার শৈলী হয়ে ওঠে। স্বাভাবিক ভাবেই এতে যুক্তি বা সঙ্গতির অভাববোধ তীব্র মনে হয়। কবিতায় উদ্ধৃতির যদৃচ্ছা ব্যবহার হতে শুরু করে, ছন্দ ভেঙে যায়, ভাবেও অসঙ্গতি আসে। বারটোল্ড ব্রেখট, স্ট্রিণ্ডবার্গ প্রমুখের নাটকে, রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’ নাটকে অনুভূতির আবেগময় অভিঘাতে তার পরিচয় বর্তমান। অন্যদিকে জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার মধ্যে তা মূর্ত হয়ে উঠেছে। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, ১৯১২-তে এক্সপ্রেশনিস্ট লেখক গটফ্রিড বেন ‘লাসকাটা ঘর’ নাম দিয়ে একটি লিফলেট ছড়িয়েছিলেন।
‘লাসকাটা ঘর’-এর কথা ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাতেও বর্তমান। স্ত্রীপুত্র নিয়ে সুখস্বাচ্ছন্দ্যময় পারিবারিক সুখী জীবন পেয়েও আত্মহত্যা করে সেই ‘লাসকাটা ঘর’-এ টেবিলের উপরে শায়িত লোকটির মৃত্যুর কারণ থেকে বাদাহীনের পথের কথায় এক্সপ্রেশনিজমের পরিচয় নিবিড় হয়ে উঠেছে। রহস্যময় উপস্থাপনায় অতিরঞ্জিত প্রকাশে ভাষা স্বাভাবিক ভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে : “কোনোদিন জাগিবে না আর/ জানিবার গাঢ় বেদনার/ অবিরাম— অবিরাম ভার/ সহিবে না আর—‘/ এই কথা বলেছিলো তারে / চাঁদ ডুবে চ’লে গেল—অদ্ভুত আঁধারে / যেন তার জানালার ধারে/ উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এল।’ আবার মজাদার নাটকীয় বিভঙ্গী উঠে এসেছে : ‘অশ্বত্থের শাখা/ করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে/ করেনি কি মাখামাখি?/ থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে/ বলেনি কি : ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে? ! চমৎকার !/ ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার! / জানায়নি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার ?’ শুধু তাই নয়, ভাষার কুহেলিকা অভিব্যক্তিকে আরও রহস্যঘন করে তুলেছে : ‘অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—/ আরো এক বিপন্ন বিস্ময় / আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে/ খেলা করে ; আমাদের ক্লান্ত করে,/ ক্লান্ত— ক্লান্ত করে;’। যদিও এই ভাষার কুহেলিকা জীবনানন্দ দাশের পূর্বেও লক্ষ করা যায়। তাঁর ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র ‘বোধ’ কবিতায় সেই বোধের পরিচয়ে তারই উত্তরসূরি: ‘আলো-অন্ধকারের যাই— মাথার ভিতরে / স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে; / স্বপ্ন নয়— শান্তি নয়— ভালোবাসা নয়, / হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয় ;/ আমি তারে পারি না এড়াতে’। সেই বোধই আরও ঘনীভূত হয়ে ‘আট বছর আগের একদিন’-এ অভিব্যক্ত হয়েছে। অন্যদিকে জীবনানন্দের আরও অনেক কবিতাতেই ভাষার কুহেলিকায় প্রকাশ লক্ষ করা যায়। তাঁর বস্তুবিশ্ববিমুখী মনের মগ্নচৈতন্যের ভাষায় এক্সপ্রেশনিজমের পথ বেয়েই তাঁর সুরিয়ালিজম বা পরাবাস্তবতা বা অধিবাস্তবতার প্রকাশ নিবিড় হয়ে উঠেছে।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সুরিয়ালিজমের প্রভাব অত্যন্ত প্রকট। বাংলায় তিনিই সুরিয়ালিস্ট কবি হিসাবে নন্দিত হন। রিয়াল বা বাস্তবের চেয়েও অতি বাস্তব বা বাস্তবের অন্তরে আরও গভীর বাস্তবচেতনায় সুরিয়ালিজমের বিস্তার। অবশ্য তা যেমন কবিতায় অবচেতন মনের ছবি আঁকা নয়, তেমনই বিভিন্ন ভাবে কল্পনার জগতের হদিশ দেওয়াও নয়। চেতন ও অচেতন, অন্তর ও বাইরের জগতের মধ্য দৈহিক ও মানসিক বেড়া ভেঙে দেওয়াই তার বিশেষত্ব। বাস্তব ও কল্পনার মাঝের মানসিক ব্যবধান সেখানে অস্বীকৃত হল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তীব্র অভিঘাতে ১৯১৫-১৬তে ডাডাইজমে যে শিল্প-সাহিত্যের প্রচলিত বিবিধ প্রথা, রীতি বা বক্তব্যকে অস্বীকার করার প্রবণতা জেগে ওঠে, তার প্রতি বিরূপ হয়ে ডাডাবাদীদেরই কিছু লেখক সুরিয়ালিজমে সামিল হয়েছিলেন। স্মরনীয়, উদ্দেশহীন ডাডাইজম বেশিদিন টেকেনি। ১৯২২-এ শেষ হয়ে যায়। আর ১৯২৩-২৪-এ সুরিয়ালিজমের যাত্রা শুরু হয়। মনস্তাত্বিক আঁদ্রে ব্রেতোঁ এই মতবাদের হোতা। এতে অবচেতন মনের অর্গল গেল খুলে, চেতনমনের যুক্তিশৃঙ্খল হল মুক্ত। স্বাভাবিক ভাবেই রচনায় এল স্বতঃস্ফূর্ত ভাবের প্রকাশ মূর্ত হয়ে প্রতিমায় আবেদনক্ষম হয়ে উঠল। আসলে যা ছিল ভাবজগতে, তাই চিন্তা-কল্পনা আর স্বপ্নে একীভবন হয়ে প্রকাশিত হল। সেখানে চেতন মনের বাস্তবতার সঙ্গে মগ্নচৈতন্যের অতিবাস্তবতার অপূর্ব প্রকাশে সুরিয়ালিজম বা পরাবাস্তবতা বা অধিবাস্তবতার বৈপ্লবিক প্রভাব স্বাভাবিক ভাবেই শিল্প-সাহিত্যে ছড়িয়ে পড়ে। কনকনে শীতের প্রকাশে গায়ে কাঁটা দেয় যেমন বোঝা যায়, শরীর হিম হয়ে ওঠার অনুভূতি জেগে ওঠে। রবীন্দ্রসঙ্গীত হাল্কা-ভারী না হলেও বর্ষায় হাল্কা রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে খিচুরি খাওয়ার আনন্দ উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না। সেখানে মনের অবচেতনের সীমা ছেড়ে মগ্ন চৈতন্যলোকে ডুব দিয়ে জীবন ও জগতের অপার রহস্য উদ্ঘাটনে শিল্পী-সাহিত্যিকের প্রয়াস চলে। চোখের দেখায় নয়, অতল মনের চেতনাই তাতে সুগভীর ও সুদূর প্রসারিত। সেক্ষেত্রে ব্যঞ্জনা নয়, তার অভিব্যঞ্জনাই কবিতার স্বতন্ত্র প্রকাশকে আবেদন করে তোলে। সুরিয়ালিজমের বিশেষত্বগুলি নানাভাবেই জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নিবিড় হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, প্রকাশের স্বকীয় কবিসত্তাতেই মতবাদটি তীব্র আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে। ইতিহাসচেতনা, সমাজচেতনা, ইন্দ্রিয়ঘনত্ব প্রভৃতির প্রকাশে তাঁর জীবনসন্ধানী মনের চলনে সুরিয়ালিজমের ঘনিষ্ট যোগ। দীপ্তি ত্রিপাঠী মনে করেন, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র(১৯৩৬) ‘পরস্পর’ কবিতা থেকে জীবনানন্দের সুরিয়ালিজমের প্রভাব লক্ষণীয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রথম কাব্য ‘ঝরাপালক’(১৯২৭)-এ ইমেজিস্টদের প্রভাব ছিল তীব্র। অন্যদিকে যুক্তিগ্রাহ্য বা বিশ্বাসযোগ্য না হলেও সুরিয়ালিজমের ফ্যান্টাসি বা যোগসূত্রহীন কাল্পনিক কবিতাগুলিও মনকে আকৃষ্ট করে তোলে।
জীবনানন্দের অধিকাংশ বিখ্যাত কবিতাতেই সুরিয়ালিজমের ছায়া প্রতীয়মান। ‘বনলতা সেন’ কবিতায় তাঁর অপূর্ব প্রকাশ : ‘হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাটিতেছি পৃথিবীর পথে, / সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে / অনেক ঘুরেছি আমি ; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে / সেখানে ছিলাম আমি ; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে ; / আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, / আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।……।’ সনেটটিতে ‘হাজার বছর ধ’রে’ বাংলা বা বাঙালির ইতিহাস ধরে অগ্রসর হলে পথ শুধু আরও প্রাচীনত্বে বা তার আভিজাত্যে অথবা তার ধূসর-অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতে হারিয়ে যায় না, ইতিহাসচেতনায় তালগোল পাকিয়ে তোলে। অথচ তার কালপরিচয়ের মধ্যেই অমোঘ আকর্ষণ ‘আমি’ত্বের পরিচয়কে অপূর্ব ভাবসৌন্দর্য দান করে। ‘বনলতা’ও পাঠকের মনোলতাকে নিজের দিকে টেনে রাখে। অন্যদিকে ‘বনলতা সেন’(১৯৪২) কাব্যের ‘হরিণেরা’ বা ‘অবশেষ’ প্রভৃতি কবিতাতেও সেরূপ পরিচয় বিদ্যমান। স্বপ্নের চিত্রকল্প সেখানে স্বপ্নেই মিশে গেছে। অন্যদিকে জীবনানন্দের কাব্যিক উৎকর্ষে সুরিয়ালিজমের পরশ বহুমাত্রিক। ‘রূপসী বাংলা’(১৯৫৭-এ কাব্যটি প্রকাশিত হলেও কবিতাগুলি অনেক পূর্বে লেখা।) কাব্যের মৃত্যুচেতনায় বা স্মৃতিমেদুর আবেগের মধ্যেও তার বিস্তার লক্ষ করা যায়। ‘আবার আসিব ফিরে’ বা ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ প্রভৃতি সনেটের মধ্যেও সেই ভাবসৌন্দর্য উঠে এসেছে। অন্যদিকে ‘মহাপৃথিবী’(১৯৪৪) কাব্যের ‘শ্রাবণ রাত’, ‘স্বপ্ন’, ‘নিরালোক’, ‘সাতটি তারার তিমির’(১৯৪৮) কাব্যের ‘ঘোড়া’, ‘সেই সব শেয়ালেরা’, ‘হাঁস’ প্রভৃতি কবিতায় সুরিয়ালিজমের পরিচয় নিবিড় হয়ে আসে। ‘ঘোড়া’ কবিতাটিকে জীবনানন্দের সুরিয়ালিয়াস্টিক চেতনাই স্বতন্ত্র আভিজাত্য প্রদান করেছে। ঘোড়ার মধ্যে দিয়ে জীবনের ইতিহাস নয়, ইতিহাসের মধ্যে রহস্যময় অপরাজেয় জীবনের অস্তিত্ব অভিনব ভাষ্য লাভ করে : ‘আমরা যাইনি ম’রে আজো—তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয় : / মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে ;/ প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন—এখনও ঘাসের লোভে চরে / পৃথিবীর কিমাকার ডাইনোমোর প’রে…।’ আসলে জীবনানন্দ দাশের কবিচেতনায় সভ্যতাবিমুখতায় তাঁর অন্তর্দৃষ্টি যত প্রসারিত হয়েছে, ততই তাঁর মননবিশ্বে সুরিয়ালিজমের প্রভাব তীব্রতা লাভ করেছে। সত্যসন্ধানী কবির মানসনেত্রে বাস্তবের অতিরেকে অতিবাস্তবের পরশ তাই স্বাভাবিক মনে হয়। আবার সেই কবি সভ্যতার নগ্ন বাস্তবতাকেই শুধু নয়, নগ্ন মানসচিত্রের সুগভীর চিত্রকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ক্যামেরাম্যান হয়ে থাকেননি, শিল্পীর তুলিকে লেখনী করে তুলে তাকে জীবননিষ্ঠ করে তুলেছেন, জীবনসত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। এজন্য জীবনানন্দের সত্যসুন্দর মূর্তি পরাবাস্তবতার আবেশের ঘোরে বন্দি না থেকে জীবনপ্রত্যয়ী চেতনায় প্রতিমার হাতছানি বয়ে আনে। শেষ পর্যন্ত তিনি যে কোনো মতবাদে আবদ্ধ না থেকে মুক্ত জীবনানন্দে সমান সচল কবি হিসাবেই তাঁর স্বকীয় প্রকাশ আকাশ হয়ে উঠেছে।