পুলক মিত্র
‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ এই স্লোগানকে হাতিয়ার করে ক্ষমতায় এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদি৷ ২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল বিজেপি যে নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করেছিল, তাতে ৬০ মাস অর্থাৎ ৫ বছরের মধ্যে সুশাসন আর উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল৷
মোদি নিজে সুশাসনের ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন৷ তাঁর কথায়, সুশাসন হল, যে সরকার গরিবদের জন্য ভাববে, গরিবদের কথা শুনবে৷ দেশের এমন উন্নয়ন হবে, যার সুফল সবাই ভোগ করবে এবং প্রত্যেকে তাকে স্বাগত জানাবে৷
প্রশ্ন হল, মোদি কি তাঁর প্রতিশ্রুতি রেখেছেন? জিডিপি বৃদ্ধির নিরিখে ভারত এখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম দেশ৷ ২০২৮ সালের মধ্যে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের কথা বলছেন মোদি৷
জিডিপি কী? একটি নির্দিষ্ট সময়ে, সাধারণত এক বছরে দেশের সব উৎপাদনের উপাদানগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে মোট যে পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্ম উৎপাদিত হয়, তার সমষ্টিকে মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি বলা হয়ে থাকে৷
ভারত এখন বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ৷ ২০১৪ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১২৫ কোটির মতো৷ বর্তমানে তা ১৪০ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে৷ জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ কর্মক্ষম৷ বেশি জনসংখ্যার অর্থ, অপেক্ষাকৃত বড় কর্মীগোষ্ঠী, যাঁরা পণ্য উৎপাদন ও পরিষেবা প্রদান করবেন৷ সেই সঙ্গে পণ্য বিক্রির বড় বাজারও তৈরি করবেন৷ তাই ভারতের জিডিপি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম হওয়ার মধ্যে আশ্চর্য্যের কিছু নেই৷
দেশের বিকাশ বা অগ্রগতির যে ঢক্কানিনাদ প্রধানমন্ত্রী বাজাচ্ছেন, তা তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে মিলছে না৷ গত নভেম্বরে ছত্তিশগড়ে এক সভায় তিনি বলেছিলেন, কেন্দ্রীয় সরকার ২০২৮ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ আরও ৫ বছরের জন্য দেশের ৮০ কোটি গরিব মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ এর অর্থ হল, ১৪০ কোটি দেশবাসীর মধ্যে ৮০ কোটির কাছে উন্নয়ন পৌঁছয়নি৷ দেশের আর্থিক বিকাশ ঘটলেও, দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের দু’বেলা পেট পুরে খাওয়ার ক্ষমতা নেই৷
এবার আসা যাক, মাথাপিছু জিডিপি-র কথায়৷ এই তালিকায় বিশ্বের সেরা ১০০টি দেশের মধ্যেও ভারতের নাম নেই৷
গত মাসে টানা বেশ কয়েকদিন ধরে আম্বানি পরিবারের জমকালো প্রাক-বিবাহ অনুষ্ঠান টিভির পর্দায় দেখেছেন দেশবাসী৷ নীতা আম্বানি হিরের যে নেকলেস পরেছিলেন, তার মূল্য কয়েকশো কোটি টাকা৷ অনন্ত আম্বানির দামি ঘড়ি, আন্তর্জাতিক পপ তারকার অনুষ্ঠান, ১০ দিন ধরে জামনগর বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, বিশ্বের তাবড় তাবড় ভিভিআইপি-দের আনাগোনা… এ সবই আমরা দেখেছি৷
পাশাপাশি আরও একটি তথ্য আমাদের নজরে এসেছে৷ তা হল, দেশের ৬৭ লক্ষ শিশু (১৯.৩%) ‘শূন্য খাদ্য’ (জিরো ফুড) বিভাগে পড়ে৷ এর মানে হলো, দেশে ৬৭ লাখ এমন শিশু রয়েছে, যারা গত ২৪ ঘণ্টায় কোনো দুধ বা কোনও খাবার খায়নি৷ এদের বয়স ৬ থেকে ২৩ মাসের মধ্যে৷
বিশ্বখ্যাত মার্কিন পত্রিকা ‘দ্য ল্যানসেট’-এর সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে যে, শূন্য-খাদ্য বিভাগে বিশ্বের ৯২টি নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় ভারত তৃতীয় স্থানে রয়েছে৷ গিনি (২১.৮%) এবং মালি (২০.৫%) যথাক্রমে প্রথম এবং দ্বিতীয়৷ ২০১৯-২১ সালে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সমীক্ষার ভিত্তিতে এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে৷
গত বছরের অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল ১১১ নম্বরে৷ সরকার অবশ্য এই রিপোর্ট খারিজ করে দিয়েছে৷
২০১৯ সালে সরকারি রিপোর্টে বলা হয়েছিল, দেশে বেকারত্বের হার ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছে গিয়েছে৷ অথচ ওই বছরেই মোদি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন৷
৫ বছর পর আমরা সম্প্রতি দেখেছি, ৬০ জনের বেশি ভারতীয় নাগরিক কাজের জন্য যুদ্ধকবলিত ইজরায়েলে যাচ্ছেন৷ এর থেকেই দেশের নির্মম বাস্তব ছবি ধরা পড়ছে৷ দেশে কাজ নেই৷ তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ইজরায়েলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ৷
গত নভেম্বরে আইআইএম ব্যাঙ্গালুরুর ১০০ জনের বেশি পড়ুয়া ইন্টার্নশিপের সুযোগ পাননি৷ সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই বছরেও প্রথম সারির আইআইটি-গুলির ৩০ শতাংশ স্নাতক চাকরির জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন৷
তবে ফোর্বস ধনীদের তালিকা অনুযায়ী, ২০১৪ সালের পর থেকে মুকেশ আম্বানির মোট সম্পদ ৫ গুণ বেড়ে ১১৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছে৷ আর গত এক দশকে গৌতম আদানির সম্পদ বেড়েছে ২৭ গুণ৷
অক্সফাম ইন্ডিয়ার ২০২৩-এর রিপোর্ট বলছে, দেশের ৬০ শতাংশের বেশি সম্পদ মাত্র ৫ শতাংশ ভারতীয়ের দখলে রয়েছে৷ ২০১২ থেকে ২০২১ সালের দেশে যত সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে, তার ৪০ শতাংশ মাত্র ১ শতাংশ ধনীর দখলে গিয়েছে৷
হ্যাঁ, কথা রেখেছেন মোদি৷ এটাই মোদির উন্নয়ন, যা প্রত্যেকের জীবনকে স্পর্শ করেছে৷
আমাদের কি মনে পড়ছে, পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মোদি কী বলেছিলেন? ২০১২ সাল৷ মনমোহন সিং তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী৷ মোদি বলেছিলেন, ‘‘পেট্রোলের এই মূল্যবৃদ্ধি কেন্দ্রীয় সরকারের দেশশাসনের অযোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছে৷’’
২০১২ সালের মে মাসে দিল্লিতে লিটার পিছু পেট্রোলের দাম ছিল ৭৩ টাকা, মুম্বইয়ে ৭৮ টাকা৷ এখন দিল্লিতে পেট্রোলের দাম লিটার পিছু ৯৪ টাকা এবং মুম্বইয়ে ১০৪ টাকা৷
ডলারের তুলনায় টাকার দাম কমে যাওয়ার জন্যেও মনমোহন সিং সরকারকে কাঠগড়ায় তুলেছিলেন মোদি৷ ২০১২ সালে এক জনসভায় মোদি বলেছিলেন, ‘‘যেভাবে দিন দিন টাকার দাম পড়ছে, তাতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দাঁড়াতেই পারবে না ভারত৷ ২০১৩ সালে ডলার প্রতি টাকার মূল্য ছিল ৫৮ টাকা৷ এখন তা পৌঁছে গিয়েছে ৮৩ টাকায়৷
গরিবদের জন্য ভাবনা এবং গরিবদের কথা শোনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোদি৷ ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বরের দুঃস্বপ্নের সেই দিনটির কথা মনে পড়ে৷ মাত্র ৪ ঘণ্টার নোটিশে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে দিয়েছিলেন৷ সরকার কি তখন সত্যিই গরিবদের কথা ভেবেছিল? নগদ টাকার ওপর ভর করে যে সব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান হয়ে থাকে, সেখানে বড় বিপর্য্যয় নেমে এল৷ পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে হাজার হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হলেন৷ লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ হারালেন৷ সরকার কি একবারও এঁদের কথা ভেবেছিলেন? গরিব শ্রমিকরা খাবার বা অন্য কিছু কেনার টাকা কোথা থেকে পাবেন? সরকার কি ভেবেছিল, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কীভাবে ক্ষতি সামাল দেবেন? গরিব বা ধনী, যাই হোন না কেন, জরুরি প্রয়োজনে মানুষ কোথা থেকে অর্থ পাবেন?
যে কালো টাকা রুখতে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পরে দেখা গেল, তার কিছুই হয়নি৷ সুপ্রিম কোর্টে নোটবন্দি মামলার বিচারপতি বি ভি নাগারত্ন সম্প্রতি বলেছেন, ‘‘…৯৮ শতাংশ অর্থই রিজার্ভ ব্যাঙ্কে (আরবিআই-এর হিসেবে ৯৯.৩ শতাংশ) ফিরে এসেছে৷ তবে কালো টাকা উদ্ধার হল কোথায়? আমার মনে হয়, এটা ছিল কালো টাকাকে সাদা টাকায় পরিণত করার ভালো পদ্ধতি৷’’
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদি কী বলেছিলেন, তা কি মন দিয়ে শুনেছেন? বিভিন্ন জনসভায় দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রতিশ্রুতির কথা? তিনি বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে সুইস ব্যাঙ্ক থেকে সমস্ত কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে আনবেন এবং প্রত্যেক দেশবাসীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে পৌঁছে দেবেন? সুইস ব্যাঙ্ক থেকে কত লক্ষ কোটি কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন, জানাবেন কি প্রধানমন্ত্রী?
গত ১০ বছরে স্টার্টআপ, ডিজিটাল ইন্ডিয়া, স্কিল ইন্ডিয়া, জি ২০, ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি সহ আরও অনেক গালভরা শব্দ শুনেছি৷ আসলে মোদি হলেন, এমন এক ব্যক্তি, যিনি শুধুই প্রতিশ্রুতিই দেন, কিন্ত্ত সেই প্রতিশ্রুতি রাখেন না৷