• facebook
  • twitter
Thursday, 30 January, 2025

অবহেলিত মাতৃভাষা

আমরা আজকাল বাংলা গান শুনি না

প্রতীকী চিত্র

কবিতা মুখোপাধ্যায়

সম্প্রতি প্রয়াত উইলিয়াম রাদিচে’কে দেখার এবং শোনার এক বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছিল বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। সেই আলোচনা চক্রে তাঁর বক্তব্য বিষয় ছিল রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুবাদ প্রসঙ্গে। খুব সুন্দর বাংলায় তিনি তাঁর বক্তব্য রাখছিলেন। শিক্ষক-শিক্ষিকা সহ ছাত্রছাত্রীরা মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন তাঁর বক্তব্য। সামনে দাঁড়ানো এক ইংরেজ আলোচককে এভবে বাংলা বলতে শুনে আমার বুক গর্বে ভরে উঠেছিল। প্রায় ৪০ বছর আগে শোনা সেই বক্তব্যের একটা কতা আজও আমার কানে বাজে। তাঁর বক্তব্য ছিল— অনুবাদ সবসময় আক্ষরিক হওয়া ঠিক নয়। প্রতিটি ভাষার কিছু শব্দ থাকে যার আক্ষরিক অনুবাদ সেই শব্দটির তাৎপর্যকে বিনষ্ট করে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন সেই শব্দটিকে তার মাতৃভাষার রূপেই রাখা। বিশেষ করে কবিতার ক্ষেত্রে। এ প্রসঙ্গে তিনি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ’ কবিতাটির— ‘বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল্’ / পুরানো সেই সুরে কে যেন ডাকে দূরে—/ কোথা সে ছায়া সখী, কোথা সে জল! / কোথা যে বাঁধা ঘাট, অশথতল! …’’ (বধূ) তাঁর কথায় ‘ঘাট’— এই কথাটির আক্ষরিক অনুবাদ করলে কবিতাটির মাধুর্য বিস্মিত হবে। তাই তিনি ‘ঘাট’ কথাটিই ব্যবহার করেছেন ওই কবিতাটি অনুবাদের সময়।

২০২৪-এ বিদেশি এই কবি-অনুবাদক, যিনি বাংলা ভাষা শিখে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেবার নিরলস চেষ্টা করেছিলেন, তিনি প্রয়াত হন। আর আমরা বাঙালিরা সচেষ্ট থাকছি কীভাবে মাতৃভাষাটিকে পরিহার করে হিন্দি, ইংরেজিকে মাতৃভাষার সমতুল করে তুলতে। শুধু ভাষা বা সংস্কৃতি নয়, আমাদের মধ্যে এমনও প্রবণতা ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে যে আমরা সতর্ক যত্নে ভুলতে চেষ্টা করি নিজের মা-বাবা, ভাই-বোনকেও, ওদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছি আত্মসুখের জন্য।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি ভাষা শিক্ষা বিভাগের একজন আংশিক সময়ের জার্মানি ভাষার শিক্ষিকার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তিনি বারবারা সেনগুপ্ত। উনি জন্মসূত্রে জার্মানি, বিবাহ সূত্রে বাংলার শান্তিনিকেতনে। তিনি কি সুন্দর বাংলা বলতেন। শুধু তাই নয়, পরতেন শাড়ি। বলার বিষয় এটাই যে, বিশ্বের সবচাইতে সুন্দর যে মহিলাদের পোশাক আজ বাংলার ঘরেই তা ব্রাত্য। সব বয়সের মহিলারাই এখন সযত্নে চেষ্টা করেন শাড়িকে পরিত্যাগকরতে। কারণ হিসেবে উঠে আসে অনেক যুক্তি। অথচ খেটে খাওয়া মেয়েটি যখন গাছ কোমড় করে শাড়ি পরে সাইকেল চড়ে কাজে যায়, তার কোনও অসুবিধা হয় না। আসলে নীরদ সি চৌধুরী খুব সঠিকভাবেই বলেছিলেন, ‘আত্মঘাতী বাঙ্গালী’। শুধু অন্যের অনুকরণ করতে গিয়ে বাঙ্গালী ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু এক জাতিতে পরিণত হচ্ছে।

মোদের গরব, মোদের ভাষা আ-মরি বাংলা ভাষা এই বোধেই আমরা উত্তীর্ণ হতে পারলাম না। পৃথিবীর অন্যতম মিষ্টি ভাষা যা বহু রত্ন ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ সেই ভাষাটিই আজ আমাদের কাছে ব্রাত্য। শুধু ২৫-এ বৈশাখ আর বাংলার নববর্ষের দিন আমরা বাঙালির সাজে সেজে নিজেদের মহান দায়িত্ব পালন করে থাকি। আর সারা বছর শুধু ইংরেজি-হিন্দি কপনাই, এবং বাংলার সংস্কৃতির শ্রদ্ধা করি। মাতৃভাষার বাইরে অন্য ভাষা শিক্ষায় কোনও অসুবিধা নেই, বরং একাধিক ভাষা শিক্ষা আখেরে মাতৃভাষারই উন্নতি সাধনে সহায়ক হয়। বাংলার যারা সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় অগ্রণী তারা সবাই কিন্তু একাধিক ভাষা জানতেন। বা অন্য ভাষায় লিখেও থাকেন। আমরা বুঝি ভুলে গেছি মধুকবি মাইকেলের কথা, যিনি মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে হতে চেয়েছিলেন ইংরেজি ভাষার একজন সফল কবি। কিন্তু তিনি বিফল হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত নিজের মায়ের কোলে ফিরে আসেন, চর্চা শুরু করেন মাতৃবাষায়। তাঁর সেই বিখ্যাত সনেট, ‘হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;—/ তা সবে, (অবোধ আমি।) অবহেলা করি, / পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ / পরদেশে ভিক্ষা বৃত্তি কুক্ষণে আচরি। / … যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে! / … মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণি জালে।’ কবির চৈতন্যের উদয় হয়েছিল তাই তো পেয়েছি মেঘনাদ বধ কাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, বীরঙ্গনা কাব্য, বাংলা চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী।

আমরা তো বাংলা পড়তেই পারি না, কী করে জানব বাংলা ভাষায় মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ বা শঙ্খ, সুনীল, শক্তি, জয় গোস্বামী কী লিখেছেন বা লিখছেন? আমরা আজকাল বাংলা গান শুনি না। প্রেমে, আনন্দে, বেদনায় আমরা বাংলা সিরিয়ালে ব্যবহার করছি। হিন্দি গান, যেন বাংলা গান-কবিতা এ সব ক্ষেত্রে অচল। আমরা ভুলে যাই, ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে…’ মত সিনেমায় ্যবহৃত অসম্ভব সব গানের কথা। সুখে-দুঃখে-আনন্দ-বেদনায় আমরা অনায়াসে ভুলে যাচ্ছি রবীন্দ্রনাথের কথা। বাংলার নববর্ষ নয়, আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি নববর্ষের বরণ। অদ্ভুতভাবে দূরদর্শনের নানা কভারেজে উঠে আসে অর্ধ-উলঙ্গ মেয়েদের উৎকট হিন্দি গানের সঙ্গে উদ্দাম নাচের মাধ্যমে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান।

আসলে বাঙালি তার ভাষা শুধু নয়, সংস্কৃতি বিষয়েও উদাসীন। অনুকরণ প্রিয়তা এতটাই যে বাঙালিরা বিয়েতে এখন মেহেন্দী, সঙ্গীত হয় অথচ ভুলে থাকে অথবা খুব সংক্ষিপ্তভাবে পালিত হয় জলভরা, গঙ্গা-আমন্ত্রণ, আনন্দনাড়ু তৈরির মতো সুন্দর অনুষ্ঠানগুলি। বাঙালির মাতৃভাষা বিষয়ে উদাসীনতা আজকের নয়। বহুকাল ধরেই চলে আসছে বাঙালিদের বাংলা ভাষা বিষয়ে যে উপেক্ষা, সে বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও ওয়াকিবহাল ছিলেন সেটা স্পষ্টভাবে উঠে আসে তাঁর সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার প্রকাশের সূচনা কালে। তিনি বলেছিলেন, ‘যতদিন না সুশিক্ষিত ‘জ্ঞানবন্ত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা ভাষায় আপন উক্তি সকল বিন্যাস্ত করিবেন, ততদিন বাঙ্গালার উন্নতির কোন সম্ভাবনা নাই। এক কথা কৃতবিদ্য বাঙ্গালীরা কেন যে বুঝে না, তাহা বলিতে পারি না। যে উক্তি ইংরেজিতে হয় তাহা কয়জন বাঙ্গালীর হৃদয়ঙ্গম হয়? … যে কথা দেশের সকল লেকে বুঝে না, বা শুনে না, সে কথায় সামাজিক বিশেষ কোনও উন্নতির সম্ভাবনা নাই।’

বঙ্কিমচন্দ্রের অভিমত, ‘বাঙ্গালা ভাষার প্রতি বাঙ্গালীর অনাদরেই, বাঙ্গালীর অনাদর বাড়িতেছে। সুনিশ্চিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা রচনায় বিমুখ বলিয়া, সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা রচনায় বিমুখ।’ বঙ্কিমচন্দ্রের সময় থেকে আমরা অনেক দূরে চলে এসেছি। আমাদের অধঃপতন আরও তীব্র হয়েছে। আমরা শুধু বাংলা ভাষা ব্যবহার নয়, সংস্কৃতি, জীবনচর্চা, পোষাক সব বিষয়েই বাংলাকে উপেক্ষা করে চলেছি। অন্য রাজ্যের অ-বাংলাভাষী মানুষের যত প্রবেশ ঘটছে তই দিন দিন আমরা আমাদের অস্তিত্ব হারয়ে ফেলছি। শুধু শহর নয়, গ্রামও আজ এই প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। যে কোনও রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কে গেলে হিন্দি-ইংরাজি বিজ্ঞাপন শুধু নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মী হিন্দিতেই কথা বলে থাকেন। গ্রাহকের অসুবিধা বিবেচনা না করেই।

২০২৫ যদি বাঙ্গালীকে নিজস্ব মর্যাদা ফেরাতে হয় তবে সর্বাগ্রে প্রয়োজন মাতৃভাষাকে মর্যাদা দেওয়া, অন্য ভাষাকে উপেক্ষা না করেই। সেই সঙ্গে প্রয়োজন সর্বস্তরে প্রশাসনের কিছু দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেওয়া, দোকানের নাম তেকে শুরু করে, এখানে যত প্রতিষ্ঠান আছে (কেন্দ্রীয় সরকার), বা ব্যাঙ্ক, সমস্ত কর্মীদের অবশ্যই বাংলা জানতে হবে। সেই সঙ্গে সমস্ত হিন্দি, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বাংলা ভাষা বিষয় হিসেবে রাখতেই হবে। নতুন বচরে আমরা বাঙ্গালীরা সচেতন হই নিজেদের আত্মমর্যাদা, নিজেদের ঐতিহ্য বিষয়ে নতুবা অদূর ভাবষ্যতে বাঙ্গালী হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে, যার কিছু ইঙ্গিত বোধ হয় দেখা যাচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে।