• facebook
  • twitter
Thursday, 31 October, 2024

মাতৃসাধক বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম

কয়েকদিন পর নজরুল সানন্দে লালগোলায় গেলেন। যোগীরাজ বরদা মজুমদারে চরণে লুটিয়ে পড়ে আবেগে বিহ্বল হয়ে বললেন, ‘আপনার কৃপায় ছেলের দেখা আমি পেয়েছি। আমার মন এখন শান্ত হয়েছে।’

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ফাইল চিত্র

শিবশঙ্কর দাস

বাংলার আধ্যাত্ম জগতে সাধক কবি কাজি নজরুল ইসলাম এক অবিস্মরণীয় নাম। এই মহান কবিকে সাধারণ মানুষ জানেন বিদ্রোহী কবিরূপে, দেশপ্রেমিক রূপে, সুরকার, গীতিকার ও শিল্পীরূপে, সংগীত পরিচালকরূপে। কিন্তু এই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছাড়া ও নজরুলের আর একটি নিগূঢ় পরিচয় আছে, যা তাঁর মাত্র কয়েকজন অন্তরঙ্গ সুহৃদ ছাড়া কেউ জানতেন না। তা হল নজরুল ছিলেন একাধারে মাতৃসাধক ও মহানযোগী। এই মহান মাতৃসাধক কবি নজরুল বহুবার ছুটে গেছেন তারাপীঠে। মহাপীঠ তারাপীঠে তিনি তারামায়ের জন্য এত অবিরত ভাববিহ্বল হয়ে ক্রন্দন করতেন যে, তারাপীঠের সাধুসন্ত ভক্তগণ অবাক নয়নে তাঁকে দেখতেন।

ভারতের এই প্রাচীনতম মহাতন্ত্রপীঠ ও সিদ্ধপীঠে বসে মাতৃসাধক নজরুল একাধিক অনবদ্য শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন। শ্যামামায়ের প্রতি নজরুলের প্রেমভক্তি ও শরণাগতিরত চিত্র ছড়িয়ে আছে নজরুলের সহস্র সহস্র গানে, তাঁর রচিত এই আনন্দ অমৃত খণ্ডিত শ্যামাসংগীতে বাংলার মাটিতে আকাশে বাতাসে চিরতরে সমুজ্জ্বল আছে। তাঁর বিখ্যাত অতুলনীয় সৃষ্টি— ১) বল রে জবা বল, ২) আমার কালো মায়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন, ৩) খেলিছ এ বিশ্বলয়ে বিরাট শিশু আনমনে। এইভাবে মাতৃসাধক নজরুল ইসলাম শ্যামাসংগীত ও ভক্তিগীতি রচনা করে চির অমর হয়ে রয়েছেন। তাই বাংলার জগতে রবীন্দ্রসংগীতের পরেই নজরুলগীতির স্থান চিহ্নিত হয়েছে। তাই বাংলার কোটি কোটি সংগীতরসিক নরনারীর কাছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল সংগীতের জনপ্রিয়তা সূর্য ও চন্দ্রের ন্যায় সমাদৃত। তারপরে নক্ষত্ররূপে দ্বিজেন্দ্রগীতি, অতুলপ্রসাদ ও রজনীকান্ত সংগীত উল্লেখযোগ্য।

কবি নজরুলের আধ্যাত্ম সাধনার আলোক দিশারী ছিলেন যোগীরাজ বরদাচরণ মজুমদার লালগোলা মহেশ নারায়ণ একাডেমি স্কুলের প্রধানশিক্ষক। এই যোগীরাজ বরদাচরণ মজুমদারের সঙ্গে সাধক কবি নজরুলের আলাপ হয় নিমতিতা গ্রামের এক বিয়ের আসরে, নজরুল গিয়েছিলেন বরযাত্রীর দলে আর অন্যপক্ষে আমন্ত্রিত অতিথিরূপে সেখানে উপস্থিত ছিলেন যোগীরাজ বরদাচরণ মজুমদার। প্রশান্ত গম্ভীর দিব্যকান্তি এই যোগসিদ্ধ মহাপুরুষকে দেখে সাধক কবি নজরুল গভীরভাবে মুগ্ধ হন। আলাপ করলেন সাগ্রহে, আলাপক্রমে আত্মিক যোগে পরিণত হল। কিন্তু এই আত্মিক যোগ এক বিচিত্র ঘটনার মাধ্যমে নিবিড় একাত্মতায় পরিণত হল। সাধক কবির চিরতরে তাঁর আধ্যাত্ম গুরুরূপে বরণ করে নিলেন যোগীরাজ বরদাচরণকে। এই আলৌকিক ঘটনাটি আপন বৈশিষ্ট্যে ও বৈচিত্র্যে অতুলনীয়।

একদিন আকস্মিকভাবে নজরুলের প্রাণাধিক শিশুপুর ‘বুলবুল’ অকাল মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সদা আনন্দময় প্রাণ প্রাচুর্য্যে পরিপূর্ণ নজরুল আকস্মিক এই প্রচণ্ড আঘাতে স্তব্ধ হয়ে গেলেন পুত্র শোকে জর্জরিত নজরুল পাগলের ন্যায় ছুটে এলেন লালগোলায় যোগীরাজ বরদাচরণ মজুমদারের কাছে। এখানে এসে শোকে বিহ্বল নজরুল কিছুটা শান্তি পেলেন। যোগীরাজ কবিকে দিলেন অনাবিল সান্ত্বনা, তার সাথে যোগমার্গের অনন্ত শান্তি ও মোহমুক্তির পথের সন্ধান দিলেন পরম যত্নের সাথে। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রিয়তম শিশুপুত্র বুলবুলের অকালমৃত্যু কিছুতেই ভুলতে পারছেন না শোকাহত নজরুল। একদিন সকাতরে নজরুল যোগীরাজকে বললেন, ছেলেটিকে একবার দেখার অদম্য ইচ্ছা কিছুতেই দমন করতে পারছি না। বিগত আত্মা কি তার স্থূলদেহে ফিরে আসতে পরে। মহাশক্তির সিদ্ধ মহাযোগী বরদাচরণ মজুমদার। পুত্র শোকে কাতর নজরুলকে করুণাভরে বললেন, ‘ছেলেকে দেখার খুব ইচ্ছে? বেশ, দেখতে পাবে, কিন্তু দেখো, কোনও কথা তাকে তুমি বোল না।’

এই পরম বিস্ময়কর আশ্বাস শুনে নজরুল সানন্দে রাজি হয়ে কলকাতায় নিজগৃহে ফিরে এলেন। কিছুদিন পর একদিন নজরুল তাঁর পূজাগৃহে বসে একমনে জপ করছেন। জপ করতে করতে তন্ময়তার মত এসেছে। হঠাৎ একটি শিশুর পায়ের শব্দে তিনি চোখ মেলে তাকালেন। মহাবিস্ময়ে দেখলেন তাঁর প্রাণাধিক প্রিয়পুত্র শিশু বুলবুল স্থূলদেহ ধারণ করে ঠিক পূর্বের মতো ছোট ছোট পা ফেলে অগ্রসর হয়ে তার জামাকাপড় ও খেলনা ভর্তি আলমারিটা খুলল। তারপর মনেরআনন্দে সব নাড়াচাড়া করে দেখল। একটু পরে আালমারিটা বন্ধ করে পিতার দিকে ফিরে তাকিয়ে সেই মধুর পরিচিত হাসি হাসল। সেই হাসির মধ্যে শোকস্তব্ধ পিতাকে যেন সান্ত্বনা দিল যে সে ঠিকই আছে। তারপর বুলবুল মিলিয়ে গেল ঘর থেকে।

কয়েকদিন পর নজরুল সানন্দে লালগোলায় গেলেন। যোগীরাজ বরদা মজুমদারে চরণে লুটিয়ে পড়ে আবেগে বিহ্বল হয়ে বললেন, ‘আপনার কৃপায় ছেলের দেখা আমি পেয়েছি। আমার মন এখন শান্ত হয়েছে।’ পরবর্তীকালে যোগীরাজের প্রদর্শিত পথে যোগ সাধনায় আপ্তকাম হন যোগীবর নজরুল। মাতৃসাধনার সাথে যোগ ও তন্ত্র সাধনা করে তিনি অধ্যাত্ম রাজ্যে গভীরভাবে প্রবেশ করেন।

উত্তরকালে তাঁর এই অধ্যাত্ম গুরু যোগীরাজ বরদাচরণ মজুমদার প্রসঙ্গে একাধারে মাতৃসাধক কবি ও যোগী নজরুল সশ্রদ্ধ চিত্তে ও সবিনয়ে লেখেন, ‘আমার যাহা কিছু শক্তির প্রকাশ হইয়াছে— কাব্যে, সংগীতে, অধ্যাত্ম জীবনে, তাহার মূল যিনি, আমি যাঁহার শক্তি প্রকাশের আধার হইয়াছে বলিয়াই জানাইলাম। লোকে শ্রীরামচন্দ্রকেই দেখে, তাঁহার পশ্চাতে যে ব্রহ্মার্ষি বশিষ্ঠ, যাঁহার সাধনার ফল শ্রীরামচন্দ্র, তাঁহার কথা কয়জন ভাবে?